ক্লাস চলছে, কেউ একজন হয়তো স্যারের ক্যারিকেচার করার চেষ্টা করছে, আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে একাধিক সমঝদার। মিটিংয়ে হয়তো কেউ হিজিবিজি এঁকে খাতা ভরাচ্ছে, পাশ থেকে চোরা চোখে তা উপভোগ করার মতো শিল্পরসিকেরও অভাব নেই। আর সত্যিকারের চিত্রশিল্পী যখন জনারণ্যে বসে আঁকেন, তখন তো রীতিমতো মচ্ছব! আদিকালে চিত্রশিল্পীরা যখন গুহাচিত্র আঁকতেন তখনো নিশ্চয়ই এমনটাই হতো। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অনেক আঁকিয়ে গ্রাফিকস ট্যাবলেট দিয়ে ছবি আঁকছেন। একে তো আঁকাআঁকি, তার ওপর নতুন মাধ্যম, সব মিলিয়ে আগ্রহ বিপুল। স্লেটের মতো একটা বস্তুর ওপর কলম দিয়ে লেখা হচ্ছে, স্লেটে কোনো রেখাই ভাসছে না। তবে সামনের মনিটরে ফুটে উঠছে চমৎকার এক ছবি—বিস্ময়করই বটে। গ্রাফিকস ট্যাবলেট বস্তুটি আদতে কী? কেমন করেই–বা আঁকে তা দিয়ে?
গ্রাফিকস ট্যাবলেট কী?
গ্রাফিকস ট্যাবলেট আরও অনেক নামে পরিচিত। কেউ বলেন ড্রইং প্যাড, কেউ পেন ট্যাবলেট, আবার কেউবা ডাকেন ডিজিটাল আর্ট বোর্ড নামে। যে নামেই ডাকুন, গ্রাফিকস ট্যাবলেট কম্পিউটারের ইনপুট ডিভাইস। মানে যন্ত্রটি কি–বোর্ড বা মাউসের মতো কাজ করে। আগেই জেনেছেন, গ্রাফিকস ট্যাবলেট দেখতে ছেলেবেলার স্লেটের মতোই। কাজের ধরনও প্রায় একই রকম। স্লেটে চক দিয়ে লেখা হয়। আর গ্রাফিকস ট্যাবলেটের বোর্ডের ওপর লেখা হয় স্টাইলাস নামক কলম দিয়ে। বোর্ডের আঁচড়ের ডিজিটাল সিগন্যাল চলে যায় কম্পিউটারে, ছবি আকারে ভেসে ওঠে পর্দায়। অর্থাৎ বোর্ডে যা আঁকবেন, ঠিক তা–ই দেখা যাবে কম্পিউটারের পর্দায়। অতএব বুঝতেই পারছেন, কাগজে আঁকতে পারলে গ্রাফিকস ট্যাবলেটেও আঁকতে পারবেন আরামসে। গ্রাফিকস ট্যাবলেটের আবার অনেক ধরন। যেমন স্লেটের মতো বোর্ড আর স্টাইলাসের প্যাকেজটিকে বলা হয় পেন ট্যাবলেট। আঁকার বোর্ডেই পর্দা আছে এমন প্যাডগুলো পরিচিত পেন ডিসপ্লে নামে। আর একদম স্বাধীন, মানে ড্রইং প্যাডটিই যখন কম্পিউটার, তখন সেটিকে বলা হয় পেন কম্পিউটার।
কেন দরকার?
খুব সহজ উত্তর—গ্রাফিকস ট্যাবলেট দিয়ে ছবি আঁকবেন। কাগজ বা ক্যানভাসেও আপনি আঁকতে পারেন, চাইলে পাথরেও। এই মাধ্যমগুলোর মতো গ্রাফিকস ট্যাবলেটও একটি মাধ্যম। রংতুলি যেমন আপনাকে ছবি এঁকে দেয় না, গ্রাফিকস ট্যাবলেটও ঠিক তেমনটাই। রংতুলি ব্যবহার করে ছবি আঁকা হয়, গ্রাফিকস ট্যাবলেটও এই কাজই করে। অনেকেই ভাবেন, ডিজিটাল আর্ট মানে তো যন্ত্রটাই এঁকে দিচ্ছে। ডাহা ভুল ধারণা। আঁকবেন শিল্পী, গ্রাফিকস ট্যাবলেট সে ক্ষেত্রে তুলির মতোই আঁকার উপকরণ হিসেবে কাজ করবে। মোটকথা, ডিজিটাল মাধ্যমে আঁকতে চাইলে গ্রাফিকস ট্যাবলেট দারুণ কাজে আসবে। বিশেষ করে যাঁরা অলংকরণ, কমিকস, অ্যানিমেশন বা যেকোনো ধরনের ডিজাইনের কাজ করতে চান, তাঁদের জন্য চমৎকার এক অস্ত্র। এর সুবিধা অনেক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সময় বাঁচায়, ভুল হলেও শুধরে নেওয়া যায়, কাগজ–কালির খরচ নেই এবং বৈচিত্র্যময়। আরেকটি বড় সুবিধা হলো, বেশির ভাগ গ্রাফিকস ট্যাবলেট চালাতে কম্পিউটারের পাওয়ারই যথেষ্ট।
গ্রাফিকস ট্যাবলেট কেনার আগে
কিছু বিষয় জেনে রাখা ভালো। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম কার্টুনিস্ট মেহেদী হকের সঙ্গে। আঁকাআঁকি শুরু করেছিলেন কাগজ–কলম দিয়ে। গ্রাফিকস ট্যাবলেট ব্যবহার করছেন বেশ কয়েক বছর হলো। তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোই পরামর্শ হিসেবে নেওয়া চলে—
১. অনেকেই আফসোস করেন, আমার কম্পিউটারের র্যাম কম, ফটোশপটা পুরোনো ভার্সনের, এটা নেই, ওটা নেই…। মনে রাখবেন, ডিজিটাল আর্টের শুরুর দিকে শিল্পীরা যেসব কম্পিউটার ব্যবহার করতেন, সেগুলোর মেমোরি আজকালকার যেকোনো স্মার্টফোনের চেয়ে অনেক কম ছিল। ফলে বাজারের সবচেয়ে হালনাগাদ বা দামি যন্ত্রটি ছাড়া আঁকা যাবে না, ভাবলে ভুল করবেন।
২. গ্রাফিকস ট্যাবলেট থাকলে ভালো। না থাকলেও ডিজিটাল মাধ্যমে আঁকাআঁকির কাজ দিব্যি করা যায়। কাগজে কালি–কলম দিয়ে এঁকে স্ক্যান করে ফটোশপে রং করেন অনেকেই। গ্রাফিকস ট্যাবলেট থাকলে কাগজ–কলমের দরকার হয় না—এই হলো পার্থক্য।
৩. অনেকেই ভাবেন, বড় আকারের গ্রাফিকস ট্যাবলেটে বেশি সুবিধা। আসলে কিন্তু উল্টো। আঁকাআঁকিতে ছোট গ্রাফিকস ট্যাবলেটগুলোই বরং আরামদায়ক। খরচ কম। বহন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও ভালো। তাই শুরু করতে পারেন ছোট একটা ট্যাব দিয়ে।
৪. আকারের পার্থক্যের চেয়ে গুরুত্বপর্ণ হলো ট্যাবের সেনসিটিভিটি। মানে কলমে কতটা চাপ দিতে হবে তার পার্থক্যেই ভালো–মন্দের হিসাব। কোনো কোনো ট্যাবে স্টাইলাসের চাপ দিতে হয় বেশি, কোনোগুলোতে কম। পেশাদার শিল্পীরা দিনে ৫–৬ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে টানা কাজ করেন। ফলে বেশি চাপ দিয়ে কাজ করলে হাত ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে সেনসিটিভিটি বেশি এমন ট্যাবই বেছে নেওয়া ভালো। তবে নবীনেরা যেহেতু অতটা সময় ধরে আঁকেন না, তাই কম সেনসিটিভিটির ট্যাবেও সমস্যা নেই।
৫. পৃথিবীর বিখ্যাত সব ছবির মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে আঁকা ছবির সংখ্যা অতি নগণ্য। তবে লেখক গল্প লিখলে কেউ জিজ্ঞেস করে না, গল্পটি কাগজে লিখেছেন নাকি মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে? গল্পটাই এখানে মুখ্য। একইভাবে ছবি কোন মাধ্যমে আঁকা হলো, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ছবি হয়ে উঠল কি না, সেটাই দেখার বিষয়। ডিজিটাল মাধ্যমে কপি–পেস্ট করার সুযোগ নেয় অনেকে। তাতে ডিজিটাল মাধ্যম নিয়েই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তাই আঁকাআঁকির জন্য ডিজিটাল মাধ্যম বেছে নিলেও দিন শেষে আপনাকে সত্যিকারের আঁকিয়ে হতে হবে।
কোথায় পাওয়া যাবে?
ঢাকার আগারগাঁওয়ের বিসিএস কম্পিউটার সিটি, পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে গ্রাফিকস ট্যাবলেট পাবেন ৫ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে। চাইলে অনলাইনেও কিনতে পারেন। ব্র্যান্ডের মধ্যে আছে ওয়াকম, হুইঅন, পার্বলো ও জিনিয়াস।