ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত ভ্রমর। প্রজাপতি তেমন না হলেও সাধারণ্যে ধারণাটি কিন্তু এমনই। ধরেই নেওয়া হয় যে, ফুলে ফুলে বিচরণশীল প্রজাপতির মধু পান ছাড়া আর কাজ কী। কিন্তু এ কথা সর্বদা সত্য নয়। কারণ কিছু প্রজাপতি মধু নয়, বরং বিষ পান করে। আর তাও জেনেশুনেই। বর্ণিল এ প্রজাপতি মোনার্ক বাটারফ্লাই নামেই পরিচিত। অনেকে আবার একে মিল্কউইড বলেও ডাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু থাকতে এ প্রজাপতি কেন বিষ পান করে বেড়ায়? এত দিন বিষয়টি অজানা থাকলেও, এখন আর তা নয়। বিজ্ঞানীরা মোনার্ক প্রজাপতির সেই জিন সিকোয়েন্স বের করেছেন, যার জন্য এটি বিষ পানে সক্ষম। এই প্রজাতির প্রজাপতি শুধু মিল্কউইডের রস পান করে। যেসব গুল্ম দুধের মতো রস নিঃসরণ করে, সেগুলোকেই মিল্কউইড বলে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ মিল্কউইডের রস বেশ বিষাক্ত, যা প্রজাপতিগুলোর মৃত্যুর কারণ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। বরং মোনার্ক প্রজাপতি অনেকটা রাজার মতোই নির্লিপ্তভাবে এ রস গ্রহণ করে।
মিল্কউইডের বিষাক্ত রস তার প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। বিশেষত পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এটি এ গুল্মের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ দিয়ে তারা মোনার্ক প্রজাপতিকে নিরস্ত করতে পারে না। এর কারণ নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী। কিন্তু কেউই এর কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বের করতে পারেননি।
অবশেষে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী এর কারণ খুঁজে বের করেছেন। সম্প্রতি নেচার জার্নালে এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, বিবর্তনের পথে তিনটি বিশেষ জেনেটিক রূপান্তরের কল্যাণে এ প্রজাতির প্রজাপতিগুলো নিজেদের মধ্যে এ সক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছে। মাত্র তিনটি জেনেটিক রূপান্তরের মাধ্যমে মোনার্ক প্রজাপতি বিষাক্ত রস প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা সাধারণ মাছির মধ্যে এ তিন ধাপের জেনেটিক মিউটেশন প্রয়োগ করে দেখেছেন এবং একই ফল পেয়েছেন।
এ বিষয়ে অন্যতম গবেষক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী জোসেফ ডব্লিউ থর্টন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘জেনেটিক মিউটেশন আবিষ্কারের পর পতঙ্গের ওপর প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করাটা বিধিবদ্ধ একটি বিষয়। আমরা এটিই করেছি।’
আজ থেকে ৪০ কোটি বছর আগে থেকেই পতঙ্গের খাদ্যের উৎস হয়ে আছে উদ্ভিদ। আর এটিই উদ্ভিদের মধ্যে অনেক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটিয়েছে। এর মধ্যে অনেক ধরনের প্রাণঘাতী রাসায়নিকও রয়েছে। এমনই একটি উদ্ভিদ হচ্ছে মিল্কউইড, যা এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বিষাক্ত রাসায়নিক কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড ব্যবহার করে। এর একটি যথাযথ ডোজ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ কিংবা স্নায়ুতন্ত্রকে অবশ করে দিতে পারে। হাজার বছর ধরে এই বিষাক্ত পদার্থকেই আফ্রিকার শিকারিরা তাদের তিরের ডগায় ব্যবহার করে আসছে। বিষ হিসেবে এটি এতটাই পরিচিত যে, আগাথা ক্রিস্টির রহস্য উপন্যাসেও এটি অনায়াসে ঠাঁই করে নিয়েছে। এটি মূলত প্রাণী দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সোডিয়াম পাম্পকে অকার্যকর করে দেওয়ার মাধ্যমে তার বিষাক্ত ক্রিয়াটি করে। প্রাণী দেহের সোডিয়াম পাম্পের মূল কাজটি হলো ধনাত্মক সোডিয়াম আয়নকে কোষের বাইরে নিয়ে যাওয়া। ফলে কোষের ভেতরে এক ধরনের ঋণাত্মক চার্জের সৃষ্টি হয়। একটি প্রাণীর হৃদ্যন্ত্রকে সচল রাখতে এই সোডিয়াম পাম্পের ক্রিয়া বাধাহীন হওয়াটা ভীষণ জরুরি। একইভাবে স্নায়ুতন্ত্রও মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে এ পাম্পকে ব্যবহার করে। ফলে এ পাম্প ঠিকঠাক কাজ করতে না পারলে, তা যেকোনো প্রাণীর জন্য প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কিন্তু এ সবকিছুকেই তুচ্ছ করে মোনার্ক প্রজাপতি এই বিষ গ্রহণ করে চলেছে। শুধু তাই নয়, নারী প্রজাপতি এসব বিষাক্ত উদ্ভিদের শরীরেই ডিম পাড়ে। আর প্রজাপতির ডানা মেলার আগ পর্যন্ত শুঁয়োপোকাটি যতটা সম্ভব পান করে এ বিষ, যা সঞ্চিত হয় এর বর্ণিল ডানায়। এ বিশেষ সক্ষমতাটি নিয়ে গবেষণা করেছেন অনেকে।
গবেষক দলের নেতা জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানী সুসান ডবলার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, এই বিশেষ সক্ষমতা অর্জনের পথে বেশ কয়েক ধাপের রূপান্তর ঘটেছে প্রজাপতিটির। এ রূপান্তরের পর্যায়টি বের করার লক্ষ্যে এ বিষাক্ত পদার্থ প্রতিরোধী বিভিন্ন পতঙ্গের জেনেটিক সিকোয়েন্সের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয়েছে সেই জেনেটিক সিকোয়েন্সটি, যার সাহায্যে এ পতঙ্গগুলো অনায়াসে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড পান করে। তবে এগুলো একসঙ্গে ঘটে না। তিনটি পর্যায়ে ঘটে। প্রথম ধাপে যে রূপান্তর হয়, তাতে প্রজাপতিগুলো এ রাসায়নিক প্রতিরোধী হতে পারলেও তা পানে সক্ষম হয় না। দ্বিতীয় ধাপে এটি রাসায়নিকটি পানের সক্ষমতা অর্জন করে। আর তৃতীয় ধাপে তা কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড সংরক্ষণের ক্ষমতা অর্জন করে, যা তারা আবার ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে। আর এ প্রতিটি ধাপেই তার শরীরের অভ্যন্তরের সোডিয়াম পাম্পটি প্রয়োজনমাফিক বিবর্তিত হয়।