ছোট চিপ বড় যুদ্ধ: পর্ব-২

মাইক্রোচিপ ঘিরে এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ছবি সংগৃহীত
মাইক্রোচিপ ঘিরে এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ছবি সংগৃহীত
>

ডেটা বা তথ্যকে যদি আধুনিক যুগের তেল বলা হয়, তবে চিপকে বলা চলে ইঞ্জিন, যা ওই তেলকে উপযোগী করে তোলে। যন্ত্রের প্রাণ এই ‘চিপ’ নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই মাইক্রোচিপ নিয়েই এখন কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা হচ্ছে। চিপ তৈরিতে এত দিন শুধু মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়েছে। কিন্তু এখন চিপের রাজ্যে হানা দিচ্ছে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। শুরু হয়ে গেছে ‘চিপযুদ্ধ’। প্রথম পর্বে চিপযুদ্ধের পটভূমি ও পেছনের কারণ জেনেছেন। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব:

মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব ধরে রাখা আর চীনের সুপারপাওয়ার হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়েই মূলত চিপযুদ্ধের শুরু। চিপের বাজারে চীনের মরিয়াভাবে উঠে আসা ঠেকাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তা না হলে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল ঘরে তুলতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন উঠছে, চীনকে ঠেকাতে কত দূর যাবে যুক্তরাষ্ট্র? যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষাবাদীরা চাইছে, সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রের সাপ্লাই চেইনের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই হোক। এতে অবশ্য বৈশ্বিকতার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের ১৬ হাজার সরবরাহকারী রয়েছে, যাদের অর্ধেকের বেশি দেশটির বাইরে। অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চীনের বাজারই তাদের জন্য সবচেয়ে বড়। মার্কিন চিপ নির্মাতা কোয়ালকমের দুই-তৃতীয়াংশ ক্রেতাই চীনা। ফলে মার্কিনরা নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে গেলে উৎপাদক ও গ্রাহকের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র আপাতত চিপের নকশা ও প্রযুক্তিতে চীনের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বসে থাকবে না। চীন সিলিকন ভ্যালির করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা প্রণোদনা দিয়ে কাজে লাগাবে। এ ছাড়া দক্ষ কর্মী আকৃষ্ট করে আরও এগিয়ে যাবে। এর মধ্যে সে লক্ষণ দেখাও যাচ্ছে। সিলিকন ভ্যালির সব প্রতিষ্ঠান কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলো সমর্থন করছে না। চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতাও দেখাতে শুরু করেছে। তারা চিপের বাজারে এগিয়ে যেতে নানা পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। তাদের এ লক্ষ্য সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করেছে ইকোনমিস্ট।

রয়টার্স জানিয়েছে, যন্ত্রে ব্যবহৃত মাইক্রোচিপ তৈরিতে জোর দিয়েছে চীন। সামরিক সক্ষমতা ও স্থানীয় প্রযুক্তিশিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে চীনের এই প্রচেষ্টাই দুশ্চিন্তায় ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন বিষয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়টি পরিষ্কার হয় এমন এক সময়, যখন নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ইলেকট্রনিকস কোম্পানি ফিলিপসের চীনা বিনিয়োগকারীদের বাধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে, বিশেষ করে মিসাইল সিস্টেম তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন চিপ তৈরিতে চীনের সক্ষমতা অর্জনের বিষয়ে ওয়াশিংটন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে অটোমোবাইল ও লাইটি-এমিটিং ডায়োড যন্ত্রাংশের ওপরে চীনের দুটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করা হয়। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের কারণে চীনের বিনিয়োগ নেওয়া হয়নি তাতে।

এ বছরে আরেকটি খবর যুক্তরাষ্ট্রর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টেক জায়ান্ট অ্যাপল আর ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের সিস্টেমে চীনা গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষতিকর কম্পিউটার চিপ স্থাপন করা হয়েছে, এমন খবর প্রকাশ করে ব্লুমবার্গ। তবে এই দুই মার্কিন প্রতিষ্ঠানই এই খবর প্রত্যাখ্যান করে। ব্লুমবার্গ বিজনেসউইক জানায়, চীনা গুপ্তচরেরা প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান ও একাধিক মার্কিন সরকারি সংস্থার ব্যবহৃত যন্ত্রে কম্পিউটার চিপ স্থাপন করে রেখেছে। এই সূত্রগুলোর মধ্যে গোয়েন্দা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর মাধ্যমে বেইজিং ওই সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে গোপন প্রবেশাধিকার পেতে পারে। এই ক্ষতিকর চিপগুলো চাইনিজ পিপল’স লিবারেশন আর্মির একটি ইউনিট স্থাপন করেছে বলে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সব মিলিয়ে চীনা চিপ ঘিরে মার্কিনদের সন্দেহ বাড়তে থাকে।

এ বছরের জুনে বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, ‘মেড ইন চায়না’ বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে চীন। এ নিয়ে তারা একটা মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে। উড়োজাহাজ থেকে দ্রুতগতির ট্রেন—সবকিছু এই মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত। পরিকল্পনাটি নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। এই পরিকল্পনায় যুক্ত রয়েছে চীনের সবচেয়ে বড় শক্তি তার ম্যানুফ্যাকচারিং খাত। সেই শক্তিকেই এখানে কাজে লাগাবে চীন। ২০৪৯ সালে আধুনিক চীন যখন তার প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর উদ্‌যাপন করবে, তখন তারা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হয়ে উঠতে চায়। চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ জন্য চীন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ খাত চিহ্নিত করেছে।

এর মধ্যে আছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ, রোবোটিকস থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, দ্রুতগতির ট্রেন থেকে সামুদ্রিক প্রকৌশল। এই মহাপরিকল্পনায় সরকার বিপুল সহায়তা দিচ্ছে সব সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিকে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যা যা দরকার, তার সবই করছে তারা। আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি গবেষণা এবং উদ্ভাবনেও (আরঅ্যান্ডডি) সাহায্য করা হচ্ছে। সামরিক বাহিনী এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে বলা হচ্ছে। নতুন এ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে চিপ আর এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে জোর দিচ্ছে দেশটি। এটাই যুক্তরাষ্ট্রকে বিরাট দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

সেমিকন্ডাক্টর বা চিপশিল্পের চালিকা শক্তি এখন দুটি। একটি হচ্ছে ভূরাজনীতি। এখন ভূরাজনীতি বলতে চিপশিল্প বনাম যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা যায়। এ খাতে উঠতি শক্তি হচ্ছে চীন। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে পদার্থবিদ্যা। ইকোনমিস্ট বলছে, প্রযুক্তিগত এ যুদ্ধ এমন এক ঐতিহাসিক সময়ে ঘটছে, যখন বিশ্ব মুরসের তত্ত্বের পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেছে। পাঁচ দশক আগে ইলেকট্রনিকস নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন উদ্ভাবক গর্ডন মুর। তিনি বলেছিলেন, একটি নির্দিষ্ট চিপের মধ্যে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা প্রতি দুই বছরে দ্বিগুণ হবে, তবে এর আকার বাড়বে না। মুর এ তত্ত্ব দেন ১৯৬৫ সালে। তাঁর এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মাইক্রোচিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মাইক্রোচিপভিত্তিক গবেষণার লক্ষ্য স্থির করে। ইলেকট্রনিকসের জগতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু মুরের এ তত্ত্ব এখন আর খাটছে না। চিপশিল্পের ভবিষ্যৎ অগোছালো আর অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এখন। সবাই যখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও এআই চিপসের মতো নতুন প্রযুক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, চীনের কাছে সেই সুযোগ ধরে নেওয়ার দুর্লভ সময় এখন।

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এখন তিনটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার মিত্রদের নিয়ে চীনের অন্যায্য চর্চাগুলো ঠেকিয়ে দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে নিজের দেশের উদ্ভাবনে আরও বেশি জোর দেওয়া। তবে চিপ গবেষণায় আরও বেশি জোর দিতে গেলে বৈশ্বিক প্রতিভা অন্বেষণে আরও উদারতা দেখাতে হবে। তৃতীয় উপায় হচ্ছে আরও শক্তিশালী ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া চীনা চিপসমৃদ্ধ বিশ্বের জন্য প্রস্তুত থাকা।

চীনা চিপের আগ্রাসন মোকাবিলা করতে না পারলে কী হবে? উন্নত পরীক্ষাপদ্ধতি উন্নয়নের মাধ্যমে চীনে তৈরি পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সহজে যাতে তথ্য বেহাত না হতে পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।