জিয়া আশরাফ চালডাল ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও)। শৈশব কেটেছে ঢাকায়। নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে চলতে তিনি ভালোবাসেন। এমনকি বাজারে কোনো নতুন ফোন এলে তিনি আগে সেটির বৈশিষ্ট্যগুলো দেখেন, কীভাবে এই ফোনের মধ্যে চালডাল ডটকমের অ্যাপটি আরও সহজভাবে নকশা করে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে ভাবেন। সব সময় নিজেকে হালনাগাদ রাখাটা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
‘অনেকে মনে করেন লোক দেখানোর জন্য নতুন ফোন ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু নতুন ফোন ব্যবহার করা শুধু জানার জন্য। প্রতিদিনই প্রযুক্তি পরিবর্তন হচ্ছে। সফটওয়্যার, অ্যাপ এমনকি জীবনযাপনও পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু আমি একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, তাই এর সঙ্গে থাকাটা আমার শখ ও চ্যালেঞ্জ।’ বললেন জিয়া আশরাফ। ঢাকার গুলশানে ১৩ জুন কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
দেশে–বিদেশে ঘোরাফেরা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গান শোনা, নতুন নতুন কলম সংগ্রহ করা জিয়ার শখ। এই তালিকায় আরও আছে গেম খেলা। দাবা, সিম সিটি আর ভাইস সিটি গেম বেশি খেলেন তিনি। বাচ্চাকে সময় দিতে আর গাড়ি চালাতেও পছন্দ করেন। জানালেন, নিজের সংগ্রহের কলমের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মন্টব্ল্যাঙ্ক স্টাওয়াকার কলমটি। ‘আমার স্কুল শেষ করার পরে টাকা জমিয়ে এই দামি কলমটি কিনেছি ১৫ বছর আগে। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সইগুলো এখনো এ কলম দিয়ে করি।’ প্রিয় শখের তালিকায় জিয়ার আরও আছে গান শোনা ও বন্ধু বানানো। সব সময়ের সঙ্গী আইফোন সিক্সএস ও হুয়াওয়ের মেট ২০ প্রো।
জিয়া আশরাফের বাবা বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক উজ্জল। জিয়া বলেন, ‘আমার জীবনে বাবার অবদান অনেক। আমার শিক্ষক তিনি। আমাকে সব সময় পথ দেখিয়েছেন। বাবা সব সময় পড়াশোনা শেষ করে যেটা ভালো লাগে, সেটা করতে বলতেন। আগে পড়াশোনা। আর যেটা করতে হবে সঠিকভাবে করতে হবে, এমন শিক্ষাই আমাকে দিয়েছেন আমার বাবা। আমি চালডাল ডটকম চালাচ্ছি, সততার সঙ্গে কাজ করছি—এটা আমার বাবাই শিখিয়েছেন। চলচ্চিত্রতারকার ছেলে হয়েছি বলে নায়ক হতে হবে এমন কথা কখনো বলেননি। আমার বাবার সময়ের অনেক অভিনয়শিল্পীর ছেলেমেয়েরা অভিনয় করছে। আমি কেন করি না? এমন প্রশ্ন অনেকেই করেন। কিন্তু আমি ব্যবসা করি। এখানেও আমার বাবা আমাকে সাহায্য করেছেন। কখনো বলেননি তোমাকেও অভিনয় করতে হবে, নায়ক হতে হবে।’
বাবা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল ছেলের প্রতিটি সাফল্যেই আনন্দ পান। বললেন, ‘আমি চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলাম আর আমার ছেলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নায়ক। মানুষকে সেবা করে যাচ্ছে নিজের অবস্থান থেকে, এটাই তো বড় আনন্দ। লক্ষ্য ঠিক থাকলে সফলতা আসবেই।’ গতকাল রোববার ছিল বাবা দিবস। ‘বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তো প্রতিদিনেরই। তারপরও বাবা দিবসে রাতে বাবাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাই।’
কলেজ পেরিয়ে জিয়া ভর্তি হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়লেন বিপণন নিয়ে। তখন থেকেই ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। তবে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যোগ দিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তারপর একটা তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সেখানে ভালোভাবেই কাজে লাগছিল। দুই বছর চাকরি করলেন। সে সময় জিয়ার মা অসুস্থ হলেন। তাঁকে নিয়ে যেতে হবে ভারতে। থাকতেও হবে দুই-তিন মাস। অফিস এত দিন ছুটি দিতে রাজি হলো না। চাকরিটা ছেড়েই দিলেন জিয়া।
আলাপচারিতায় এল চালডাল ডটকমের শুরুর কথা। জিয়া বললেন, ছোটবেলার বন্ধু ওয়াসিম আলীম বাংলাদেশে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে একটা বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে কাজ করছিল। একদিন আমাকে জানাল দেশের জন্য কিছু করতে চায়। নিজেরাই কিছু করা যায় কি না আমাকে আইডিয়া দিতে বলল। আর ও বাংলাদেশে চলে এল। আমাদের আরেক বন্ধু তেজশ বিশ্বনাথও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। তিনজনেরই ইচ্ছা ব্যবসা করার। কিন্তু কীভাবে শুরু করব, কী দিয়ে শুরু করব, কিসের ব্যবসা করব; কিছুই ঠিক নেই।
তখন ২০১৩ সাল—অনলাইন বাণিজ্য ক্রমে বেড়ে উঠছে বাংলাদেশে। তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন অনলাইনে একটা ব্যবসা করবেন। অনেক আলোচনার পর ঠিক করলেন কঠিন ব্যবসাটাই বেছে নেবেন তাঁরা। এরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনলাইন দোকান খোলার পরিকল্পনা করলেন তাঁরা।
‘আমরা যখন শুরু করলাম, তখন অনলাইন দোকান মানুষের কাছে পরিচিত নয়, তার ওপর আবার বাসার কাছের পণ্য অনলাইনে কেনার কথা তো চিন্তাই করতে পারত না কেউ! সবার কাছেই মনে হলো, এটা একটা পাগলামি ছাড়া কিছুই না। কিন্তু আমরা তখন নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছি।’ বললেন জিয়া। এরপর শুরু হলো একটা ভালো নাম খোঁজা। একদিন রিকশায় করে কোথাও যাওয়ার সময় সেই রিকশাচালক বললেন, ‘মামা চালডালের দাম বেড়েছে, আমাকে দশ টাকা বাড়াইয়া দিয়েন।’ জিয়ার মাথায় তখনই ঢুকে গেল এই নামটাই সেরা। তখন বন্ধু ওয়াসিমকে জানালেন। নাম হয়ে গেল চালডাল ডটকম।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চালডাল ডটকমে জিয়া আশরাফ বনানীর বাসার পাশের এক মুদি দোকান থেকে মুদিপণ্যগুলো বাসায় এনে এনে ছবি তুলে ওয়েবসাইটে দিতেন। ২ জুলাই প্রথম অর্ডার এল, জিয়া নিজেই ডেলিভারি শুরু করলেন। এভাবে ধীরে ধীরে গুদাম ভাড়া নিতে হলো আর কর্মী বাড়তে থাকল।
জিয়া আশরাফের এক ভাই অটিজমে আক্রান্ত। তাই তিনি প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষদের জন্য একটা ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে চান। তিনি বললেন, ‘আমার ভাইয়ের মতো যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্যও কিছু একটা করার পরিকল্পনা করি আমরা। আমাদের তিন বন্ধুর পরিকল্পনা শুধু ব্যবসা করা না। মানুষকে সেবা দেওয়া এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা। আমরা জেলা ও বিভাগীয় শহরে আমাদের চালডাল ডটকম নিয়ে যাচ্ছি। যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে।’
স্ত্রী তানজিনা ফেরদৌস ও মেয়ে জুনেহেরা আশরাফকে নিয়ে ছোট সংসার জিয়া আশরাফের। তাঁর এখনকার সব ভাবনাই চালডাল নিয়ে। ‘চালডাল আর আমি একই সুতোয় বাঁধা। ফলে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে চালডালকে নিয়েই স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন থেকেই বলতে চাই, চালডাল ডটকম ই-কমার্স সাইটগুলোর রোল মডেল হিসেবে দাঁড়াতে চায়।’