টাকা দেখলে নাকি কাঠের পুতুলও হাঁ করে—ওসব প্রবাদের কথা। তবে পুতুল হাঁ করুক বা না করুক, মানুষে করে। রাস্তায় এক টাকার কয়েন পড়ে থাকতে দেখলে চোখ চকচক করে ওঠে নিপাট ভদ্রলোকেরও। কিন্তু এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের খানিকটা দূরত্ব যদি না–ই থাকে, তাহলে আর তাঁরা বিজ্ঞানী কেন? আর আপনি যদি এই ধারণায় শিকড় গেঁড়ে বসে থাকেন তাহলে ভুল করবেন। বিজ্ঞানীকুলে জোচ্চোর–বাটপারের অভাব নেই। আবার প্রতিশোধপরায়ণ, হিংসুটে টাকালোভী লোকেরও সমাগমও বিজ্ঞানীকুলে কম নয়। আছেন গোয়েন্দা বিজ্ঞানীও।
সবাই তো আর আইনস্টাইনের মতো আলাভোলা ভালো মানুষটি নন। নিউটনের কথাই ধরা যাক। আইনস্টাইনের আগে মহাবিজ্ঞানী বললে একজনের কথাই মনে হবে, স্যার আইজাক নিউটন। নিউটন কিন্তু মোটেও আলাভোলা ভালো মানুষটি ছিলেন না। রাগী, একরোখা কখনো কখনো বড্ড অসৎও ছিলেন তিনি। আর ছিল টাকার লোভ। নইলে এত বড় বিজ্ঞানী হয়ে কেন অ্যালকেমি চর্চা করেছিলেন, চেয়েছিলেন লোহাকে সোনায় পরিণত করে সম্পদের পাহাড় গড়বেন। কিন্তু বোকা বিজ্ঞানীর মাথায় এটা কেন আসেনি, যখন রাশি রাশি সোনার স্তূপ জমা হবে পৃথিবীর বুকে, তখন আর সেই সোনার দাম লোহার চেয়ে একটুও বেশি হবে না!
নিউটন চিরকুমার ছিলেন। ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ‘লুকেসিয়ান অধ্যাপক’, যে পদটিকে এখনো শিক্ষাক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি পদ বলে মনে করা হয়। মাইনেকড়ি ভালোই পেতেন নিউটন। তবু অবসরের পর জমানো টাকায় তাঁর মন ভরল না। আসলে টাকা জমিয়েছিলেন কিনা কে জানে, হয়তো অ্যালকেমির গবেষণা করতে গিয়ে সব উড়িয়ে ফেলেছিলেন। তিনি গেলেন ব্রিটিশরাজের টাঁকশালের দায়িত্ব নিতে। অনেকে মনে করেন, দায়িত্বটা নিতে তিনি বাধ্য ছিলেন। কারণ ব্রিটিশরাজের হুকুম অমান্য করার সাধ্য তখন কার! আর সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই শার্লক হোমস বনে যেত হলো তাঁকে। অথচ নিউটন যখন গোয়েন্দাগিরি করছেন তার প্রায় দেড় শ বছর পর শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জন্ম।
আসলে নিউটনকে দেওয়া হয়েছিল টাঁকশালের রয়্যাল মিন্ট বিভাগের ওয়ার্ডেনের পদ। রয়্যাল মিন্ট হলো ইংল্যান্ডের ধাতব মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার বিভাগ। সাম্মানিক পদে নিউটনকে নিয়োগ করা হয়েছিল, কাজকর্ম তেমন না করলেও চলত। তবে বিজ্ঞানী বলে কথা, চুপচাপ বসে থাকার বান্দা তিনি নন। সিরিয়াসলি নিলেন কাজটাকে। ফলে ওয়ার্ডেন থেকে পদোন্নতি পেয়ে হলেন সেই বিভাগের প্রধান।
নিউটন যখন টাঁকশালের দায়িত্ব নিলেন তখন ইংল্যান্ডের ঘরে-বাইরে ঘোর দুর্দিন। রাজা তৃতীয় উইলিয়াম মাঝে মাঝে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’–এর সেই হল্লা রাজার মতো চেঁচিয়ে বা নেচে–গেয়ে বলছেন, ‘হা হা হা, বিলেত চলেছে যুদ্ধে! যুদ্ধে যুদ্ধে যুদ্ধে!’ যুদ্ধটা তিনি সুন্ডি রাজার সঙ্গে নয়, করতে চান ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে। তার তোড়জোড় চলছে। এ জন্য দরকার বিপুল টাকা। তাই ব্রিটিশ অর্থনীতিতেও তখন ঘোর দুর্দিন। দেদার জাল হচ্ছে মুদ্রা, আসল-নকলের ফারাক করা মুশকিল।
ইংল্যান্ডে তখন রুপার মুদ্রার প্রচলন ছিল। কিন্তু মুদ্রায় যে পরিমাণ রুপা থাকে তার চেয়ে খোলাবাজারে সাধারণ রুপার দাম অনেক বেশি। ধরা যাক, এক পাউন্ডের একটা মুদ্রায় ৫ গ্রাম রুপা আছে। অন্যদিকে বাজারে ৫ গ্রাম সাধারণ রুপার দাম ১০ পাউন্ড। তাই পাউন্ড গলিয়ে রুপায় পরিণত করলে বিরাট লাভ। তখন রাজা বললেন যে, সব রৌপ্য মুদ্রা তিনি বাজার থেকে তুলে নেবেন। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। দেশ আর দেশের বাইরে থেকে আসছে রাশি রাশি নকল মুদ্রা। তখন সরকারের টনক নড়ল। আইন পাস করিয়ে ঘোষণা করা হলো টাকা জালকারীদের একমাত্র শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড। তারপর রাজা নিউটনকে অনুরোধ করলেন কিছু একটা করতে।
বলবিদ্যার জটিল সূত্রগুলোর সমাধান যাঁর মাথা বেরিয়েছে, যিনি বৈজ্ঞানিক সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বলের কারণে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই বলের কারণে পৃথিবী আর গ্রহরা সূর্যের চারপাশে ঘোরে—তিনি কয়েকজন ছিঁচকে জোচ্চোরকে ধরতে পারবেন না, তা কি হয়!
ওদিকে রাজার এক প্রিয়ভাজন আছেন। অত্যন্ত ধূর্ত চোরাকারবারি। নাম তাঁর উইলিয়াম শ্যালোনার। ব্রিটেনে তখন প্রোটেস্টান্টদের জয়জয়কার। উগ্রবাদী প্রোটেস্টান্টরা ক্যাথলিকদের আক্রমণ করছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে। রাজা এর বিরুদ্ধে কঠোর হস্ত। সাম্প্রদায়িক হিংসা যারা ছড়াচ্ছে, তাদের কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন রাজা। এই ব্যাপারটাকেই তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেন শ্যালোনার। উগ্রবাদী প্রোটেস্টান্টদের উসকে দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন ক্যাথলিকদের ঘরবাড়ি। তারপর যারা এই দুষ্কর্ম করছে তাদেরই ধরিয়ে দিচ্ছেন রাজার পাইক-পেয়াদাদের হাতে। নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে নায়ক বনে যাচ্ছেন।
সেই শ্যালোনারই নিউটনের বিরুদ্ধে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, এই বিজ্ঞানীই আসলে চোরাকারবারির হোতা, এঁকে সরিয়ে দিলেই বন্ধ হবে জাল টাকার কারবার। শুনে নিউটন তো মহাখাপ্পা! তার ওপর তিনি ভীষণ প্রতিশোধপরায়ণ। আর তাঁকেই কিনা চটিয়েছেন ধোঁকাবাজ শ্যালোনার! নিউটন কিছুটা জানতেন শ্যালেনারের দুষ্কর্মের কথা। কানাঘুষাও শুনেছিলেন এই শ্যালেনারই জাল টাকার কারবারিদের চাঁই, তাঁর দৃষ্টি এখন রয়্যাল মিন্টের প্রধান পদটির দিকে। কিন্তু প্রমাণ কই? নিউটন তাই গোয়েন্দা বনে গেলেন। উদ্দেশ্য এক ঢিলে দুই পাখি শিকার, ব্রিটেনের সব টাকা চোরাকারবারিদের ধরা আর মূল হোতা শ্যালোনারকেও শূলে চড়ানো।
ছদ্মবেশ নিয়ে ভিখারি সেজে অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন নিউটন। শহরের চোর-বাটপার, ভিখারিদের সঙ্গে গড়ে তুললেন সখ্য। এ জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করতেও কুণ্ঠা ছিল না তাঁর। ভয় দেখিয়ে, টাকা খাইয়ে দলে ভেড়ালেন শ্যালোনারের চ্যালাদের, বের করে নিলেন তাদের পেটের কথা। ধরা পড়ল ২৮ জন জাল টাকার কারবারি। সেই সঙ্গে প্রমাণ মিলল, শ্যালোনারই পালের গোদা। শ্যালোনার তখন হার শিকার করলেন। চিঠি লিখে ক্ষমা চাইলেন নিউটনের মানহানির জন্য। কিন্তু নিউটনের মন গলেনি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলো শ্যালোনার। ১৬৯৯ সালের কোনো একদিন ফাঁসি হয় শ্যালোনারের। প্রথম কেসেই তাই বাজিমাত গোয়েন্দা নিউটনের।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা, প্রথম আলো
সূত্র: নিউটন অ্যান্ড দা কাউন্টারফেইটার: দা আননোন ডিটেকটিভ ক্যারিয়ার অব দা ওয়ার্ল্ড গ্রেটেস্ট সায়েন্টিস্ট, টমাস লেভেনসন ও সায়েন্স ব্লগস ডট কম