উইন্ডোজ ফোন ভক্তদের মন খারাপ করার কথা। কারণ, একসময়ের জনপ্রিয় উইন্ডোজ ফোনকে বিদায় বলে দিতে হচ্ছে। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট আর উইন্ডোজ ফোন তৈরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম বিভাগের করপোরেট ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বেলফাইওর সম্প্রতি কয়েকটি টুইট করে উইন্ডোজ ১০ মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের জন্য নতুন ফিচার বা হার্ডওয়্যার তৈরি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোন বাজারে উইন্ডোজ ফোনের দখল মাত্র দশমিক এক শতাংশ। তাই এ ধরনের ঘোষণা মোটেও আশ্চর্যের কিছু নয়। তবে অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আসা উইন্ডোজ নির্মাতাদের জন্য এটি হতাশার কথা। চলুন জেনে আসি উইন্ডোজ ফোনের ব্যর্থতার কারণগুলো-
২০০৭ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপল যখন প্রথম আইফোন বাজারে ছাড়ে, তখন মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বলমার দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন, ফোনের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করার কোনো সম্ভাবনা আইফোনের নেই। বলমার তখন গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার বিষয়টিতে এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, মোবাইল ডিভাইসে অ্যান্ড্রয়েড যে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে, তা তিনি ধরতে পারেননি।
যখন আইফোন বাজারে আসে, তখন পর্যন্ত মোবাইল বাজারে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল মাইক্রোসফটের। ওই সময় উইন্ডোজ মোবাইলকে স্মার্টফোনের অন্যতম অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে গণ্য করা হতো। তবে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত মাল্টিটাচ মোবাইল ওএস হিসেবে কোনো অপারেটিং সিস্টেম ছাড়েনি মাইক্রোসফট। অর্থাৎ, প্রথম আইফোন বাজারে ছাড়ার তিন বছর ও প্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন বাজারে আসার দুই বছর পরে মাইক্রোসফট যুদ্ধে নামে।
কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেই স্মার্টফোনের বাজার আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড-এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ডেভেলপাররা উইন্ডোজ ফোনের জন্য অ্যাপ তৈরিতে কোনো লাভ দেখতে পায়নি। জনপ্রিয় অ্যাপ না থাকায় উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি স্মার্টফোন ক্রেতারা। ডেভেলপারদের নানা সুবিধা দিয়ে জনপ্রিয় অ্যাপগুলো উইন্ডোজ ফোনে আনার মরিয়া চেষ্টা চালায় মাইক্রোসফট। কিন্তু যে গতিতে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড এগিয়েছে, তার চেয়ে মাইক্রোসফটের গতি ছিল ধীর। ফলে মাইক্রোসফট শুধু পিছিয়েছে।
স্মার্টফোন নির্মাতারা অ্যান্ড্রয়েডের বিকল্প হিসেবে উইন্ডোজ ফোনকে শুরুতে বিবেচনা করলেও পরে এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ২০১৪ সালে ৭২০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে ফিনল্যান্ডের মোবাইল ফোন নির্মাতা নকিয়াকে অধিগ্রহণ করে মাইক্রোসফট। তবে দুর্ভাগ্যবশত মাইক্রোসফটের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। বিশাল হার্ডওয়্যার বিভাগ চালানোর ভার বহন করলেও উইন্ডোজ ফোন বিক্রি সামান্য বাড়ে।
ওই সময়ে স্টিভ বলমারের কাছ থেকে মাইক্রোসফটের ভার বুঝে নেন সত্য নাদেলা। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে ছিল মাইক্রোসফটের হ্যান্ডসেট ব্যবসাকে বাদ দেওয়া। তিনি ওই সময় ৭ হাজার ৮০০ কর্মী ছাঁটাই করেন।
অবশ্য পুরোপুরি হার্ডওয়্যার ব্যবসা থেকে সরে যাওয়ার কোনো ঘোষণা দেননি নাদেলা। তিনি ঘোষণা দেন, বছরে ছয়টি ডিভাইস উদ্বোধনের মাধ্যমে হার্ডওয়্যার বিভাগকে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। এর মধ্যে দুটি করে ফোন উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজার, এন্টারপ্রাইজ ও ফ্ল্যাগশিপ শ্রেণিতে ছাড়া হবে। তিনি কার্যকরী ফোন পোর্টফোলিও চালানোর কথা বলেন।
২০১৫ সালে উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেমের ঘোষণা দেয় মাইক্রোসফট। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, উইন্ডোজ ফোন ৮ এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্ট ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস কেবল উইন্ডোজ ১০ মোবাইল ওএসে চলাবে। এটি কন্টিনিয়াম ফিচার ও ডিসপ্লে ডকের মাধ্যমে ফুল ডেস্কটপ পিসিতে রূপান্তর করা যাবে। ব্যবসায়ী গ্রাহকদের জন্য এটি দারুণ ধারণা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে দুটি কারণে কন্টিনিয়াম সফলতা পায়নি। একটি হচ্ছে হাই এন্ড বা দামি উইন্ডোজ ডিভাইসের জন্য অনেকেই আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ছাড়তে চাননি। আরেকটি হচ্ছে অল-ইন-ওয়ান কম্পিউটিং ডিভাইসের ক্রেতা কম।
পিসির বাজার মাইক্রোসফট যেভাবে দখল করতে পেরেছে, তা মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে পারেনি। তবে এর মোবাইল ব্যবসা এখনো চলছে। অপারেটিং সিস্টেম ও হার্ডওয়্যারে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে মাইক্রোসফট সফটওয়্যারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েডের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মের ওপর ভর দিয়েই নিজেদের ক্লাউড সেবার ইকোসিস্টেম বাড়াতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
মাইক্রোসফট বিভিন্ন ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের অফিস, আউটলুক, করটানা অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করার জন্য চুক্তি করেছে। এতে গুগলের ডিফল্ট সেবাগুলোর পরিবর্তে বিকল্প পান ব্যবহারকারীরা। সত্য নাদেলার মোবাইল-ফার্স্ট, ক্লাউড ফার্স্ট পরিকল্পনার বিস্তৃতিতে এটা বিচক্ষণ পদক্ষেপ-এটা তো বলাই যায়! তথ্যসূত্র: পিসি ওয়ার্ল্ড, দ্য গার্ডিয়ান।