আপনি কি প্রযুক্তি খাতে চাকরি খুঁজছেন? বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা বাড়ছে। দেশের মধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এর বাইরে ফ্রিল্যান্সিং বা নিজে উদ্যোক্তা হয়েও কাজের সুযোগ রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ। আগ্রহী ব্যক্তিরা তাঁর পছন্দের ও কাজের বিষয়গুলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে যুগের সঙ্গে প্রস্তুত করে নিতে পারেন। এ ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের বেতন ও আয় অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর মধ্যে ক্রিয়েটিভ আইটি, বেসিসের বিআইটিএম, কোডার্স ট্রাস্ট বাংলাদেশ, শিখবে সবাই, ইশিখনের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান নানা বিষয়ে সরাসরি ও অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
বিভিন্ন মেয়াদে এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই ভালো কাজ পেয়েছেন। তাই তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণদাতা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে এখন সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে গ্রাফিকস ও ওয়েব ডিজাইন। এরপর রয়েছে অ্যাপ্লিকেশন ডিজাইন, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট। এরপর যুগের সঙ্গে চাহিদাসম্পন্ন অনেক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে।
বেসিস সূত্রে জানা গেছে, আগে অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতে বাংলাদেশ থেকে কম রেটে ডেটা এন্ট্রির মতো ছোটখাটো কাজ করা হতো, এখন সেখানে গ্রাফিকস ও ওয়েব ডিজাইনের মতো বড় বড় কাজ হচ্ছে। বেড়েছে দেশের তরুণদের আয়। আগে ঘণ্টায় গড়ে ৮–১০ ডলার আয় করলেও এখন তা ১৫ ডলার পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি আয় করছেন গ্রাফিকস ও ওয়েব ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। বাংলাদেশে এখন প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাই এ দুটি বিষয়ে আগ্রহ বেশি দেখা যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ আইটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনির হোসেন বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের দক্ষতা এখন স্থানীয় প্রয়োজনের পাশাপাশি বৈশ্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত হচ্ছে। কারণ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশের বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতার জন্য কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার ফলে চাকরির ওপর নির্ভরশীলতা কমছে। নিজে উদ্যোক্তা হচ্ছেন অনেকেই। তবে এখনকার সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন প্রশিক্ষণ হচ্ছে গ্রাফিক ডিজাইন। কারণ, অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিতে গেলে কিছুটা তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান দরকার হয়। কিন্তু বিভিন্ন খাতের আগ্রহী কম আইটি জ্ঞান নিয়ে গ্রাফিক ডিজাইন শিখে ভালো করতে পারছেন। এর পাশাপাশি নারীরা বাসায় বসে কাজের সুযোগ হিসেবে গ্রাফিক ডিজাইনকে প্রাধান্য দেন। অল্প সময়ে বিষয়টি শিখে চর্চা করলে ভালো করা যায় বলে অনেকেই গ্রাফিক ডিজাইনকে প্রাধান্য দেন। গত বছরেই তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার ব্যক্তি গ্রাফিক ডিজাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এরপর রয়েছে ওয়েব ও সফটওয়্যার–বিষয়ক প্রশিক্ষণে আগ্রহ। তবে ভবিষ্যতে সাইবার নিরাপত্তা, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং ও রোবটিকসের মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
প্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে কাজ করছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। বেসিসের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বেসিস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইটিএম) প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তরুণ ও যুবকদের। বিআইটিএমের ব্যবস্থাপক তালুকদার মোহাম্মদ সাব্বির বলেন, ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইআইপি)’ অধীনে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিকস অ্যান্ড ওয়েব ইউআই ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট-পিএইচপি, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট-ডটনেট, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও), মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট (অ্যান্ড্রয়েড), সার্ভার অ্যাপ্লিকেশন অ্যান্ড ক্লাউড ম্যানেজমেন্ট, আইটি সাপোর্ট-টেকনিক্যাল, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, কাস্টমার সাপোর্ট সার্ভিস, আইটি সেলস ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিকস অ্যান্ড ওয়েব ইউআই ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট-পিএইচপি, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট-ডটনেট প্রভৃতি বিষয়ে।
কোডার্স ট্রাস্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউল গণি ওসমানী বলেন, গ্রাফিকস, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো বিষয়গুলোর চাহিদা এখন বেশি।
দেশি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রাইডসিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মনোয়ারুল ইকবাল বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনার, এআই ও বিগ ডেটা বিশ্লেষক, ডটনেট ডেভেলপার, সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স, টেকনিক্যাল কনটেন্ট রাইটারের মতো বিভিন্ন পদের কর্মী নিয়োগ দেবে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের মতো দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা রয়েছে। এখনকার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এআই, ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে তাই গুরুত্ব দিতে হবে।
পেশাজীবীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়েবসাইট লিংকডইন ‘দ্য মোস্ট ডিমান্ড হার্ড অ্যান্ড সফট স্কিলস অব ২০১৯’ শীর্ষক তালিকা অনুযায়ী, এ বছর বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ক্লাউড কম্পিউটিং–বিষয়ক দক্ষ ব্যক্তিদের। এ ছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, ইউএক্স ডিজাইন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, সায়েন্টিফিক ডেভেলপমেন্ট, গেম ডেভেলপমেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়্যার টেস্টিং, ডেটা সায়েন্স, কম্পিউটার গ্রাফিকস ও অ্যানিমেশন বিষয়ে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা রয়েছে। এসব খাতে প্রশিক্ষণের জন্য চাহিদাও বাড়ছে।
এর আগে মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করা বিটিআই এক্সিকিউটিভ সার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে চাহিদাসম্পন্ন চাকরি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চলতি বছর তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রধান সাইবার নিরাপত্তা কর্মকর্তা বা চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসার (সিআইএসও) পদটিতে চাহিদা বেশি। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৩০ লাখ সাইবার নিরাপত্তা খাতের পেশাদার ব্যক্তির ঘাটতি রয়েছে। এর অধিকাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এ অঞ্চলে ২০ লাখ সাইবার নিরাপত্তা পেশাদার ব্যক্তির ঘাটতি আছে।
অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম কোরসেরা তাদের বৈশ্বিক স্কিল বেঞ্চমার্কিং বা দক্ষতা নির্ণায়ক প্রতিবেদন বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স ২০১৯’ (জিএসআই) প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের ৬০টি দেশ ও ডেটা সায়েন্স, প্রযুক্তি ও ব্যবসা শিল্পের ১০টি খাতের বিশ্লেষণ ওই প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনে প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গণিত, পরিসংখ্যান, মেশিন লার্নিংয়ের বিষয়গুলোতেও দক্ষতা ঊর্ধ্বমুখী। ব্যবসাক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টিং ও ফিন্যান্সে কিছুটা ভালো করলেও কমিউনিকেশন, ম্যানেজমেন্ট ও সেলসের ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রযুক্তি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও রয়েছে দক্ষতার অভাব এবং প্রযুক্তি–বিষয়ক পড়ালেখায় কিছুটা ভীতি। এসব কারণে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগেও দেশের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির যথার্থ সুবিধা ভোগ করার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি বিষয়ে আরও আগ্রহী ও দক্ষ করে তুলতে প্রয়োজন দক্ষতাবিষয়ক প্রশিক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়া।
চাহিদাসম্পন্ন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণগুলো—
কম্পিউটার গ্রাফিকস, বিগ ডেটা/ডেটা সায়েন্স, সফটওয়্যার টেস্টিং, অ্যানিমেশন, ডিজিটাল মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, সাইবার সিকিউরিটি, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট।