প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে জাতীয় তথ্যভান্ডার বা জাতীয় ডেটা সেন্টার। এটিকে ‘হার্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সেন্টারের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী জুন মাস নাগাদ পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হবে এর। তখন চাইলে বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করা যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ডেটা সেন্টারের ভবন নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। কয়েকটি তলায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করা হয়েছে। কিছু সার্ভার বসেছে। কয়েকটি তলায় র্যাক বসানো হয়েছে। সেগুলোয় সার্ভার বসানো হবে।
কী কাজে লাগবে এই ডেটা সেন্টার?
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের এক প্রকৌশলী জানান, অত্যন্ত টেকনিক্যাল ধরনের এ ডেটা সেন্টারকে টেকনিক্যাল ভাষায় বলা হয় ‘হার্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’। কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে নতুন করে যুক্ত হওয়া ৯৭ একর জায়গা থেকে নেওয়া ৭ একরের ওপর এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্লাউড কম্পিউটিং ও জি-ক্লাউড প্রযুক্তিতে ডেটা সেন্টারগুলোর মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্থাপনা এটি, যার ডাউন টাইম শূন্যের কোঠায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আপটাইম ইনস্টিটিউট থেকে টায়ার সার্টিফিকেশন অব অপারেশনাল সাসটেইনেবিলিটির সনদ পাবে এটি। এতে টিয়ার ফোর (Tier-IV) গোল্ড ফল্ট টলারেন্ট ডেটা সেন্টার হিসেবে এ প্রকল্প শেষ হবে। এটি কার্যক্রম শুরুর পর থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে।
ন্যাশনাল ডেটা সেন্টারের রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী (নেটওয়ার্ক) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ডেটা সেন্টারগুলোর মধ্যে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ডেটা সেন্টার হচ্ছে বাংলাদেশে। সরকারের অঙ্গীকার ‘রূপকল্প-২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অংশ হিসেবে দেশের তথ্য–উপাত্ত নিরাপদে সংরক্ষণ ও নিরবচ্ছিন্ন গুণগত মানসম্পন্ন ই-সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এখন সরকারি-বেসরকারি খাতে তথ্য সংরক্ষণের জন্য বড় পরিসরে ডেটা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি অন্য সব প্রকল্পের বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, অর্থ বিভাগের IBAS++, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, নির্বাচন কমিশন, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, এটুআই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত এ ডেটা সেন্টারে স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর পাশাপাশি ডেটাগুলোর নিরাপত্তা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, যা ভবিষ্যতে আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। তাই তথ্যের সুরক্ষার জন্য এটি স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে একটি সমন্বিত ও উন্নত তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্বমানের ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে, যার ডাউন টাইম শূন্যের কোঠায়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ডিজিটাল কনটেন্ট সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং ডিজিটাল কনটেন্টগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
জাতীয় ডেটা সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরে দ্রুতই বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। গত বুধবার গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে জাতীয় ডেটা সেন্টার পরিদর্শনে এসে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, চীনের সহযোগিতায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ডেটা সেন্টারের ৯৯ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এই তথ্যভান্ডারের জন্য নির্মিত দুই লাখ বর্গফুট আয়তনের ভবনে ইতিমধ্যে আমদানি করা যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন সেখানে চলছে পরীক্ষামূলক কাজ।
সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি খাতের তথ্য সংরক্ষণের জন্য বড় পরিসরে ডেটা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ‘ফোর টিয়ার ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার’ স্থাপনের এই প্রকল্প হাতে নেয়। জনপ্রশাসনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো, তথ্য সংরক্ষণ ও জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে গাজীপুরে তৈরি এ ডেটা সেন্টার তৈরির কথা জানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ।
ডেটা সেন্টার থেকে বেসরকারি পর্যায়েও ক্লাউড সেবা, তথ্য সংরক্ষণের মতো সেবা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডেটা সেন্টারের হোস্টিং ক্যাপাসিটি বাড়াতে, জাতীয় ই-সেবা সিস্টেমের মাধ্যমে নাগরিকসেবা দ্রুত ও নিশ্চিত করা যাবে। এতে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল ডেটা সংরক্ষণ করা যাবে। এতে ব্যাংক, গবেষণাকেন্দ্র, সরকার ও অন্যান্য বাণিজ্য সংস্থার গোপনীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তবে এখানে শুধু দেশের তথ্য সংরক্ষণই নয়, বিদেশি বাণিজ্য সংস্থা ও অন্য দেশগুলোকেও তথ্য সংরক্ষণের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ্বমানের ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে ডিজিটাল কনটেন্টগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যমে জনসেবা উন্নত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি কার্যালয়ের আইসিটি কার্যক্রম সরাসরি যুক্ত থাকবে। দেশে আধুনিক ডিজিটাল কার্যক্রম, সেবা প্রদান ও ই–বিজনেসের মূল ভিত্তি হবে এই ডেটা সেন্টার ।
কবে থেকে কার্যক্রম
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের আওতায় প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নের সময় ছিল ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন করা হয়। চীনের এক্সিম ব্যাংকের ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং বাংলাদেশ সরকারের ৪ কোটি ডলার অর্থায়নে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সাত একর জমির ওপর ডেটা সেন্টার প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিং যৌথভাবে ডেটা সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ডেটা সেন্টারের ভেন্ডর বা নির্মাণকারী হিসেবে কাজ করছে চীনের জেডটিই করপোরেশন। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আপটাইম ইনস্টিটিউট ডেটা সেন্টারের মান পর্যবেক্ষণ করে সনদ দিয়েছে।
প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, বিশালাকার এই ডেটা সেন্টারে থাকছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৬০৪টি র্যাক, ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য নিজস্ব ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন, জেনারেটর, উচ্চগতিসম্পন্ন ডেটা কানেকটিভিটি, ইন্টারনেট সংযোগ, অত্যাধুনিক রাউটার, সুইচ, ফায়ারওয়াল, স্টোরেজ সার্ভার, ভার্চ্যুয়াল মেশিনসম প্রিসিশন এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমস, অনলাইন ৮ মেগাওয়াট ইউপিএস সিস্টেম, ইন্টেলিজেন্ট বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা, ক্লাউডের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক ও সিকিউরিটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মতো নানা প্রযুক্তি। ডেটা সেন্টারের এসব বিশেষায়িত যন্ত্র অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে।
কামরুজ্জামান বলেন, এ প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত তথ্যপ্রযুক্তি অন্য সব প্রকল্পের বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে দেশে একটি সমন্বিত ও উন্নত তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্বমানের ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে টেরাবাইট ক্ষমতাসম্পন্ন বিশালাকার স্টোরেজ সিস্টেমের যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কনফিগারেশনের মতো উচ্চ প্রকৃতির টেকনিক্যালকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া দেশের সরকারি–বেসরকারি সব নেটওয়ার্কের সঙ্গে এর যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করতে এবং নির্বিঘ্নে ডেটা পাঠানোর (BDR: Backup Disaster Recover for Tier III NDC) জন্য উচ্চগতিসম্পন্ন চার স্তরবিশিষ্ট রিডান্ডেন্ট ব্যাকবোনের (প্রাথমিক ক্যাপাসিটি হবে ১০০ গিগাবাইট) কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দেশ-বিদেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগের জন্য ৪০ জিবিপিএস রিডান্ডেন্ট ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে ডেটা সেন্টারটির জন্য টায়ার সার্টিফিকেশন অব কনস্ট্রাকটেড ফ্যাসিলিটি ও টায়ার সার্টিফিকেশন অব অপারেশনাল সাসটেইনেবিলিটির সনদ অর্জনের কার্যক্রম চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ নাগাদ এসব সনদ পাওয়া যাবে।
সনদপ্রাপ্তি ও প্রকল্প মেয়াদ শেষে ডেটা সেন্টারটি সফল পরিচালনার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হতে পারে। প্রকল্পটির আওতায় স্থাপিত মূল্যবান যন্ত্রপাতি ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখা এবং ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য এ এগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন ডেটা সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা।
কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমির ওপর ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি’ দেশের হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের প্রথম প্রকল্প। হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে সেখানে ‘অফসাইট’ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নয়টি কোম্পানিকে ২০ দশমিক ৫০ একর এবং পরে আরও ৯টি কোম্পানিকে ২৮ একর জমির প্লট বরাদ্দ করেছে। এখানে গড়ে উঠেছে ‘হার্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’।