মহামারির দিনগুলোতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি খাতই বিপদে পড়েছে। একমাত্র রমরমা অবস্থা ইন্টারনেটের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এক বছরের টার্গেট পূরণ হচ্ছে কয়েক দিনে! কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। এত চাপ কি সামলাতে পারবে বর্তমান ইন্টারনেট ব্যবস্থা?
আগে জেনে নেওয়া যাক, কেন এমন প্রশ্ন উঠছে। নতুন করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশে দেশে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপ সরকারিভাবে নেওয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ হয়ে পড়েছে ঘরবন্দী। আবার অনেক কোম্পানিই কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে ভার্চুয়াল অফিসের কাজ ও অন্যদিকে নিছক বিনোদনের জন্য হলেও ইন্টারনেটের ওপর চাপ বেড়েছে। কেনাকাটার অনেকাংশ এখন অনলাইনে হচ্ছে। আবার ফেসবুক, টুইটারে মানুষের সংযুক্ত থাকার হার বেড়েই চলেছে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো ভিডিও কনটেন্টের ওয়েবসাইটে বাড়ছে ক্লিকও।
ব্রিটিশ সাময়িকী দা ইকোনমিস্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এর বেশির ভাগটাই আবার মোবাইল নেটওয়ার্ক। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে মোবাইল ইন্টারনেটের হার সবচেয়ে বেশি। ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এখন জাতীয় পর্যায়ে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়া চলমান। ফলে এসব দেশের মোবাইল ফোনগুলো এখন বিনোদন, যোগাযোগ ও অফিসের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে।
চাপ কতটুকু
সম্প্রতি ফেসবুক জানিয়েছে, যেসব দেশে করোনাভাইরাসের হানা বেশি হয়েছে, সেসব দেশে তাদের মেসেজিং কার্যক্রম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। চাপ বেড়ে গেছে আমাজনের ই-কমার্স ব্যবসায়। প্রতিষ্ঠানটি আরও ১ লাখ নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে চাইছে।
এনডারস অ্যানালাইসিস নামের একটি ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ইউরোপের দেশগুলোয় ডেটা ট্রাফিক ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। স্পেনের কোম্পানি টেলিফোনিকা স্পেন বলছে, ডেটা ট্রাফিক বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ওদিকে নেটওয়ার্ক-অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান ওপেনসিগনাল জানাচ্ছে, ইতালিতে ডেটা ট্রাফিক বেড়েছে ১০ শতাংশ এবং কমে গেছে ডাউনলোডের গতি। জার্মানিতেও একই হাল। ব্রডব্যান্ডের গতি মাপে ওকলা। এই সংস্থা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সান হোসে ও নিউইয়র্কে ডাউনলোডের গতি কমেছে যথাক্রমে ৩৮ ও ২৪ শতাংশ।
নকিয়া বলছে, কিছু কিছু দেশের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় ইন্টারনেটের ব্যবহার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার নজির পেয়েছে তারা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের কিছু কিছু এলাকায় ইন্টারনেটের ব্যবহার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির নিশ্চিত খবর পাওয়া গেছে। ৬৫টির বেশি দেশে কার্যক্রম চালানো কোম্পানি ভোডাফোন এটি নিশ্চিত করেছে।
প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য রেজিস্ট্রার বলছে, এরই মধ্যে গ্রাহকদের অব্যাহত চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে মাইক্রোসফট ও ভিডিও কনফারেন্স প্ল্যাটফর্ম জুম। অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) জানিয়েছে, ‘সাধারণ ছুটির মধ্যে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়লেও, কথা বলা কমে গেছে।’
এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে রান্নার অনুষ্ঠান দেখা, মানসিক স্বাস্থ্যের ও যোগাসনের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের হার বেড়ে গেছে। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে এই ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। চাপ পড়ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, টেলিকনফারেন্সিং ও ভিডিওস্ট্রিমিংয়ের ওয়েবসাইটগুলোতে। কারণ, পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন গৃহবন্দী।
তবে হ্যাঁ, ব্যবসা ভালো হচ্ছে। কমকাস্ট, ভোডাফোন, ভেরাইজন ও টেলিফোনিকার মতো ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) কোম্পানিগুলোর বরাতে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এর আগে কখনোই ইন্টারনেটে খুব কম সময়ের ব্যবধানে গ্রাহকদের এত চাপ দেখা যায়নি। স্পেনের টেলিযোগাযোগ কোম্পানি টেলিফোনিকার প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা এনরিক ব্লাংকো বলছেন, ২০২০ সালের পুরো বছরে কোম্পানি যে ট্রাফিক অর্জনের লক্ষ্য স্থির করেছিল, তা মাত্র দুই দিনে পূরণ হয়ে গেছে।
ইন্টারনেট টিকবে তো
এক কথায়, ইন্টারনেটে চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে গত কিছুদিনে। এখন শঙ্কা উঠেছে, করোনাভাইরাসের কারণে পরে আবার ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে না তো! সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, পুরো বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা এত বেশি বেশি চাহিদা পূরণের মতো করেই তৈরি করা। বিশেষ করে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থা। তবে হ্যাঁ, মোবাইল ইন্টারনেটে সমস্যা কিছুটা হচ্ছে। কারণ, একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কে একসঙ্গে অনেক ব্যবহারকারী ঢোকার চেষ্টা করছেন, ফলে ট্রাফিক বাড়ছে ও গতি কমছে। আর সামগ্রিক ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ধীর গতি চলে এসেছে, কারণও ওই একই। ব্যবহারকারী প্রচুর। কিন্তু পুরো ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই।
এবিসি নিউজের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানের ব্রডব্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা দারুণ। প্রচুর ট্রাফিক থাকা সত্ত্বেও ভালো সেবা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কত দিন ধরে চলবে, তা যেহেতু নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, সেহেতু ঠিক কত দিন এতটা চাপ সহ্য করা যাবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে। আর ধনী ও উন্নত দেশগুলো যত সহজে বর্তমান পরিস্থিতি সামলাচ্ছে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা কিছুটা কঠিন। কারণ, সেসব দেশের অবকাঠামো ততটা উন্নত নয়।
এদিকে ইউরোপীয় কমিশন ইন্টারনেট ব্যবস্থায় চাপ কমাতে কিছু অনুরোধ জানিয়েছে। ইউরোপের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সংস্থাটি আরজি জানিয়েছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, টেলিকম অপারেটর ও গ্রাহকদের প্রতি। নেটফ্লিক্সসহ বিভিন্ন স্ট্রিমিং কোম্পানিকে তাদের ভিডিওর মান কমাতে বলা হয়েছে। নেটফ্লিক্স এরই মধ্যে ইউরোপে প্রচারিত তাদের কনটেন্টের ভিডিও কোয়ালিটি ২৫ শতাংশ কমিয়েছে। ইউটিউব কর্তৃপক্ষও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার ও টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা নিয়মিত ভিত্তিতে সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে। সুতরাং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই। অবশ্য কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা আরও দীর্ঘদিন চললে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ চালানো কঠিন হতে পারে। কর্মী ও প্রকৌশলীরা অসুস্থ হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সমস্যা প্রকট রূপে দেখা দিতে পারে।