নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা বিশ্ব একযোগে কাজ করছে। এর ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা দিন-রাত খেটে চলেছেন। এ সম্পর্কিত গবেষণার গতিকে ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন প্রশাসনিক বাধা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোও সহায়তা করছে। মানুষের ওপর সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে নানা পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। এত কিছুর পরও একটি সফল ভ্যাকসিন হাতে পেতে বিশ্বকে এখনো অনেক ধৈর্য ধরতে হবে।
নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পথে এগোচ্ছে। এর মধ্যে বিগত করোনাভাইরাস (সার্স) মহামারির সময়ে অর্জিত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এক দল গবেষণা করছে। আরেক দল রয়েছে, যারা ইবোলার মতো অন্য মহামারিগুলো থেকে নেওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি সেবা প্রকল্পের পরিচালক ড. মাইক রায়ান গতকাল রোববার বিবিসি টেলিভিশনকে বলেন, নিরাপত্তা মানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরিতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।
কথা হলো এই যে এক বছর সময়, এই সময়ে বিশ্ববাসী সুসংবাদের জন্য কাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে? কারা এখন পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন তৈরির পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে?
এ বিষয়ে জেরুসালেম পোস্টের প্রতিবেদনে একটি তালিকা করা হয়। সেখানে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মডার্না, ক্যানসিনো বায়োলজিকস, এমআইজিএএল (মিগাল), ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস, কিউরভ্যাক ও বায়োএনটেকের নাম।
মডার্না: যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি মডার্নার সংক্রামক রোগ সম্পর্কিত এক দল গবেষক ও মার্কিন জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) তৈরি করা এমআরএনএ-১২৭৩ নামের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজ গত ১৬ মার্চ এক স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে। সার্স ও মার্সের ওপর পরিচালিত গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি করা এই ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এটি কতটা সক্রিয় করতে পারে—সে বিষয়টিই এখন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে এটি ৪৫ জন স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কের শরীরে পরীক্ষা করা হবে।
মডার্না জানিয়েছে, তারা এখনো শুরুর ধাপেই রয়েছে। মডার্নার এই পদক্ষেপকে ‘এক ধাপ অগ্রগতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এনআইএইচের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ও করোনাবাইরাস সম্পর্কিত হোয়াইট হাউসের টাস্ক ফোর্স সদস্য ড. অ্যান্থনি ফসি।
ক্যানসিনো বায়োলজিকস: চীনের তিয়ানজিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও দেশটির অ্যাকাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেসের গবেষকদের তৈরি একটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন গত সপ্তাহে দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ।
গবেষকেরা বলছেন, অ্যাড৫-এনকোভ নামের এই ভ্যাকসিন এরই মধ্যে প্রাণী শরীরে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেখানে এটি নিরাপদ ও এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করার ক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে। মানুষের শরীরে এর পরীক্ষা করার প্রাথমিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। উহানের টংজি হাসপাতালে ১০৮ জন স্বাস্থ্যবান স্বেচ্ছাসেবীর ওপর শিগগিরই এ পরীক্ষা চালানো হবে।
ক্যানসিনোর চেয়ারম্যান ও সিইও জুয়েফেং উ দ্রুতই সম্পূর্ণ নিরাপদ ও উচ্চমানের একটি ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে আশাবাদী।
মিগাল: মিগাল গ্যালিলি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ইসরায়েলভিত্তিক এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুরগির সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে।
অ্যাভিয়ান করোনাভাইরাস ও নভেল করোনাভাইরাসের মধ্যে বিদ্যমান জেনেটিক সাদৃশ্যকে ভিত্তি ধরে গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তারা এ ভ্যাকসিন তৈরির পথে বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে দাবি করে। আগামী আট থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে এ ওরাল (মুখে খাওয়ার উপযোগী) ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা প্রয়োজন হবে। এতে সফল হলে ৯০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পাওয়া যাবে।
মিগালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ডেভিড জিগডন জানান, ভ্যাকসিন তৈরিতে বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। পুরো প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও সহযোগিতা করছে।
ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস: যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনোভিও গত ১২ মার্চ ঘোষণা দেয় যে, কোভিড-১৯ এর জন্য তাদের তৈরি করা ডিএনএ ভ্যাকসিনের গবেষণার গতি বাড়াতে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন নতুন করে তাদের ৫০ লাখ ডলারের তহবিল দিয়েছে। তাদের তৈরি ভ্যাকসিনটির নাম আইএনও-৪৮০০। গবেষণাটি বর্তমানে প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মাসেই এই ভ্যাকসিনের ইউএস ফেজ ওয়ান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিতে পারবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কিউরভ্যাক: জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তাদের এমআরএনএভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের কাজকে গতিশীল করার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে ৮০ মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় কমিশন। আগামী জুনেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর বিষয়ে আশাবাদী। এই পরীক্ষা সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা কাজে লাগিয়েই অল্প খরচে লাখো ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে বলে তারা জানিয়েছে।
বায়োএনটেক: জার্মান ইমিউনোথেরাপি কোম্পানি বায়োএনটেক ও আমেরিকান বড় ওষুধ কোম্পানি পিফিজার গত সপ্তাহে যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তারা নতুন করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় এমআরএনএভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরিতে যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ২০১৮ সালে ফ্লুয়ের ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে প্রথম এ দুই প্রতিষ্ঠান এক জোট হয়, যা এখন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরির প্রকল্প বিএনটি১৬২-এর ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হলো। আগামী মাসের শেষ নাগাদ তাদের তৈরি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।