আপনার হাতের ৩জি ফোনের বয়স কি খুব বেশি? আবার এখন অনেকেরই হাতে ৪জির ফোন। আবার কথা হচ্ছে এ সময় নাকি ৫জির। তাহলে ৫জি প্রযুক্তি কি খুব শিগগিরই আসছে? এক প্রতিবেদনে সিএনএন বলছে, না, খুব শিগগির হয়তো ৫জি আসছে না। কিন্তু ৫জি আসতে সমস্যা কোথায়? আসলে, ৫জি প্রযুক্তিটি কেমন হবে সেটাই এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ৫জি দিয়ে কী করা যাবে ওয়্যারলেস শিল্পের সে ধারণাটা কিন্তু খুবই পরিষ্কার।
অনেকেই হয়তো ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ বা ‘সব যন্ত্রেই ইন্টারনেট’ বহুল আলোচিত এই বিষয়বস্তু সম্পর্কে শুনেছেন। ইন্টারনেট অব থিংস বিষয়টিকে সংযোগ সুবিধার যন্ত্র যেমন গাড়ি, পোশাক বা গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট আন্তসংযোগ হিসেবে বোঝানো হয়। প্রতিটি যন্ত্র যাতে তারবিহীন যোগাযোগ পদ্ধতিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারে সেই নেটওয়ার্কই ‘ইন্টারনেট অব থিংস’। এখন ওয়্যারলেস শিল্পকেই খুঁজে বের করতে হবে এই সংযোগ কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়টিই।
প্রযুক্তি-বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে সর্বাধুনিক ৪জিএলটিই প্রযুক্তিকে ছাপিয়ে যেতে হবে ৫জিকে।
তাঁরা বলছেন, ৫জির অর্থ যাই দাঁড়াক না কেনো ২০২০ সালের মধ্যেই ৫জি প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্পন্ন করে ফেলতে হবে।
৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত ওয়্যারলেস ইন্ডাস্ট্রি সম্মেলনে ভেরিজন ওয়্যারলেসের নেটওয়ার্ক সাপোর্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক হেবারম্যান বলেন, ‘আমাদের এখনকার কাজ হবে ৫জির জন্য কী কী প্রয়োজন তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। আমরা কোন সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছি সেই সমস্যাটিই আগে খুঁজে বের করা।’
তাহলে সমস্যাটি কী? প্রযুক্তি-বিশ্লেষকেরা বলছেন, আসল সমস্যা হচ্ছে আগামী বছরগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্কের সাহায্যে কোটি কোটি ব্যান্ডউইথ খেকো যন্ত্র ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হবে। সে ক্ষেত্রে ৫জি নেটওয়ার্কে কত ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ নির্ধারণ করতে হবে, ব্যান্ডউইথের মান কী দাঁড়াবে এবং কী ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে সেই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে।
ইনটেলের প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট আইচা ইভান্স বলেন, ‘৫জির মান নির্ধারণ করতে গেলে মূল বিষয় দাঁড়াবে শক্তির কার্যকারিতা ঠিক করা। এই মান ঠিক করা আমাদের সবার সামাজিক দায়িত্ব। আর তা না হলে এই বিশ্বকে আমরা উত্তপ্ত করে ফেলব।’
৫জির চালু করতে গেলে শক্তির বিশাল চাহিদা দাঁড়াবে। ট্রেড গ্রুপ ‘৪জি আমেরিকাসে’র প্রেসিডেন্ট ক্রিস পেয়ারসন বলেন, ‘২০২০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধাযুক্ত পণ্য দাঁড়াবে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি। ওই পণ্যগুলো মোবাইল নেটওয়ার্কের সাহাঘ্যে ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে।’
ক্রিস পেয়ারসন দাবি করেন, আমরা যে ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধার সমাজ ‘ইন্টারনেট সোসাইটির’ কথা বলছি তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মোবাইল ব্রডব্যান্ড।
ইতিমধ্যে আমরা ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধার নানা রকম পণ্য দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে সম্প্রতি গুগলের কিনে নেওয়া প্রতিষ্ঠান নেস্ট ল্যাবসের তৈরি ‘স্মার্ট হোম’ পণ্য এবং অ্যাপলের ‘কানেক্টেড কার’ প্রযুক্তি। অদূর ভবিষ্যতে মোবাইল অপারেটরগুলো ইন্টারনেট ট্রাফিক বেড়ে গেলে এখনকার এলটিই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই তা পরিচালনা করতে পারবে। ‘স্মল সেল’ এর মতো প্রযুক্তি এক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগবে। স্মল সেল হচ্ছে বাড়ি বা ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত ছোট আকারের নেটওয়ার্ক টাওয়ার।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে এরিকসনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা অরুণ বিকশেসভারান বলেন, ‘২০২০ সাল নাগাদ বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতির মধ্যেও মৌলিক পরিবর্তন আসবে।’
৩জি ও ৪জির ব্যবহারের সময় যেভাবে ডেটা ব্যবহার বেড়েছে ভবিষ্যতে কোন কোন ধরনের পণ্য বাজারে আসবে এবং তা ডেটা ব্যবহার বাড়াবে এখনকার ওয়্যারলেস শিল্পের কর্ণধারেরা সেই বিষয়গুলোই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র থেকে ইন্টারনেটের যে সংযোগ নেওয়া হবে তার ব্যবস্থাপনা করা, দ্রুত সংযোগ সুবিধার জন্য জরুরি সেবা যন্ত্রগুলো নির্ধারণ করা কিংবা ব্যান্ডউইথ খেকো কম প্রয়োজনীয় বিনোদন সেবাগুলোর জন্য নেটওয়ার্ক সরবরাহ করা।
এরিকসনের কর্মকর্তারা বলেন, ‘৫জির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ব্যবহার অভিজ্ঞতা পাব বলেই আমরা ধারণা করছি।’
৫জি নিয়ে কাজ করছে নকিয়া, হুয়াউয়ে
ফিনল্যান্ডের টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নকিয়া ও জাপানের এনটিটি ডকোমো যৌথভাবে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি (৫জি) নিয়ে গবেষণা করছে। এ বছরের মে মাসে এ তথ্য জানিয়েছে নকিয়া।
নকিয়ার নেটওয়ার্ক বিভাগ জানিয়েছে, নকিয়া ও এনটিটি ডকোমো মিলে যৌথভাবে ৫জি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ৫জি প্রুফ অফ কনসেপ্ট (পিওসি) নিয়ে কাজ করবে।
নকিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মোবাইল নেটওয়ার্কে চূড়ান্ত দক্ষতা ও পারফর্মেন্সের চাহিদা থাকায় ভবিষ্যতে ৫জি প্রযুক্তিকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে এবং মোবাইল অপারেটরদের কাছে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা হিসেবে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মেগাবিট গতিতে ‘কল-এজ’ রেটের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
নকিয়া জানিয়েছে, ভবিষ্যতের তারবিহীন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি শুধু মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নয়, যন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হবে।
ভবিষ্যতে তাই রেডিও অ্যাকসেস সিস্টেম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান দুটির প্রাথমিক লক্ষ্য হবে ৭০ গিগাহার্টজ স্পেকট্রাম ব্যান্ডে মিলিমিটার ওয়েভ টেকনোলজির সক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা।
এ বছরের জুলাই মাসে ৫জি নিয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে হুয়াউয়ে। ইউরোপের ৫জি অবকাঠামো বোর্ডেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
৫জির গবেষণা
২০১২ সালের যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা ৫জি নিয়ে গবেষণা করার কথা জানিয়েছিলেন। সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘৫জি’ নিয়ে কাজ করার জন্য মোবাইল অপারেটর, অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং যুক্তরাজ্যের গবেষণা উন্নয়ন তহবিল অর্থ বরাদ্দও করেছে।
গবেষকেরা বলেন, ৫জি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। মোবাইল যোগাযোগব্যবস্থা এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারের মধ্যে যে বাধা ছিল তা ইতিমধ্যে দূর হয়েছে। পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় চলার পথে ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হবে।আগামী দশকে পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় সাশ্রয়ী অবকাঠামো তৈরিতে কাজ করা হবে। ২০২০ সাল নাগাদ ৫জি প্রযুক্তি চলে আসবে।
পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট চালুর জন্য যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট ম্যাশেবল জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পরীক্ষামূলক পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট চালুর কথা রয়েছে। ৫জি প্রযুক্তি গবেষণায় চীনও পিছিয়ে নেই। এ গবেষণায় দেশটির শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুতগতির মোবাইল নেটওয়ার্কের চাহিদা বাড়তে থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই এ খাতে বিনিয়োগ ও গবেষণা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে চীন।
৫জির সাফল্য ও বাধা
পঞ্চম প্রজন্মের তারবিহীন যোগাযোগ পদ্ধতি বা ৫জি সমর্থনযোগ্য মোবাইল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দাবি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। ২০১৩ সালে স্যামসাং দাবি করেছিল, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ৫জি নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি উন্মুক্ত করা হবে।
স্যামসাং দাবি করেছে, বিশাল পরিমাণ ডেটা বা তথ্য দ্রুতগতিতে স্থানান্তরের জন্য নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন স্যামসাংয়ের গবেষকেরা। মুঠোফোন ব্যবহার করে দ্রুতগতিতে বিশাল ডেটা ফাইল স্থানান্তর করা যাবে মুহূর্তেই। এ ক্ষেত্রে কয়েক সেকেন্ডেই সুপার-হাই-ডেফিনেশন ভিডিও পাঠানো যাবে।
যুক্তরারে প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দ্রুতগতির ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ফোরজি বা লং টার্ম ইভোলিউশন বা এলটিই অনেক দেশেই বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। ফোরজির পরবর্তী ধাপ হতে পারে ৪.৫ জি। যদিও বিশ্বের অনেক দেশে এখনো থ্রিজি বাস্তবায়নের কাজই চলছে। তবে ২০২০ সালের মধ্যেই ৫ জির দেখা মিলবে। বর্তমানে পরবর্তী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির নেতৃত্ব দিতে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। পরবর্তী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে কিছুটা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সিএনএন, বিবিসি ও ম্যাশেবল।