ই-মেইলই যখন ঠিকানা

>

ই–মেইল ঠিকানা এখন ব্যবহারকারীর পরিচায়কে পরিণত হয়েছে
ই–মেইল ঠিকানা এখন ব্যবহারকারীর পরিচায়কে পরিণত হয়েছে

যেকোনো সময় বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠানোর সুবিধা দিয়েছে ই-মেইল। লেখার পাশাপাশি ছবি বা ভিডিও পাঠানোর সুযোগ করে দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থায় রীতিমতো বিপ্লব তৈরি করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যবহারকারীকে নতুন এক ধরনের ঠিকানা দিচ্ছে ই-মেইল। অনেক ক্ষেত্রে এই ঠিকানাই ব্যক্তির পরিচয় হয়ে উঠছে। ই–মেইল ব্যবহারের আদ্যোপান্ত নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

কাগজ-কলম জোগাড় করে বেশ আয়োজন করে লিখতে হয় না বলেই কিনা কে জানে, অনেকেই ই-মেইল ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। আর হাতে লেখা চিঠির গুরুত্ব কি কেবল তাতে প্রেমপত্র লেখা হয় বলে? এ যুগেও বেশ যত্ন করে সংরক্ষণ করার চল দেখা যায়। চিঠিতে আবেগ আছে সত্য, কিন্তু ই-মেইলে কাজ হচ্ছে দ্রুত।

হাতে লেখা চিঠির সঙ্গে ই-মেইলের পার্থক্য কেবল লেখা এবং পাঠানোর জন্য এখানে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর কাগজে প্রেমপত্র লেখা গেলে ই–মেইলেও তা সম্ভব। ইচ্ছা‍টা থাকলেই হলো! কীভাবে লেখা হচ্ছে তা গুরুত্ব না দিয়ে কী লেখা হলো তাতে গুরুত্ব দিলে এত দিনে অনেকেই প্রেম জমিয়ে ফেলতে পারতেন! 

ই–মেইল কী?

ই–মেইল হলো একটি যোগাযোগের মাধ্যম—চিঠি লেখার ডিজিটাল পদ্ধতি বলতে পারেন। ১৯৬০ সালে রে টমলিনসন ই–মেইল উদ্ভাবন করেন এবং ১৯৭০-এর দিকে এটি এমন একটি পর্যায়ে আসে যেটি বর্তমান সময়ের ই–মেইলের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা চলে। যদিও ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কোনো লেখা বা ডকুমেন্ট পাঠানোর ব্যাপারটিকে ই–মেইল বলা হতো। সেই সময় ফ্যাক্স ব্যবস্থাটিও অনেকে ই–মেইল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই ই–মেইলের বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী এই শব্দ নির্দিষ্ট কবে থেকে ব্যবহার শুরু হয়েছে তা জানা যায় না। কারিগরি দিক থেকে এই ব্যবস্থার নাম মেইল এবং প্রতিবার পাঠানো বার্তাগুলোকে বলা হয় মেসেজ। 

প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগে ই–মেইল

প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই–মেইল অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। গবেষণায় দেখা গেছে যে কর্মীরা দিনের ২৫ ভাগের বেশি সময় ই–মেইল পাঠানো বা পড়ার জন্য ব্যয় করে থাকেন। ব্যবসায়িক যোগাযোগের একটি বড় অংশ নির্ভর করে ই–মেইলের ওপর। আর প্রত্যেকেই অন্তত এমন একজন সহকর্মী পেয়েছেন যিনি তাঁর সব আলোচনা শুরু করেন ‘ই–মেইলে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল...’ দিয়ে। মানে ই–মেইল দিয়েই অনেকে কাজ এড়িয়ে যেতে চান সত্য, তবে এটি মানতেই হবে যে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই–মেইল অনন্য অবদান রেখে চলছে।

ই–মেইলের আদবকেতা

বিনা মূল্যে এবং মুহূর্তের মধ্যেই প্রাপকের কাছে পৌঁছে যায় বলে এটিকে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা ভুল। যোগাযোগের বেলায় দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি, পাঠিয়ে দেওয়ার আগে অন্তত একবার হলেও সবটা পড়ে দেখা উচিত। সঙ্গে কিছু নিয়ম মেনে চলতে পারলে তা উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী হয়।

ই–মেইলে সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করা: ই–মেইলে অবশ্যই সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট বিষয় থাকতে হবে। বিষয় উল্লেখ না করা যেমন দায়িত্বহীনতা, তেমনি দৈনিক যে পরিমাণ ই–মেইল আমরা পেয়ে থাকি সেখান থেকে কাজের ই–মেইল খুঁজে পেতেও এটি জরুরি।

ই–মেইলের স্বাক্ষর ব্যবহার: প্রতিটি ই–মেইলের শেষে স্বাক্ষর ব্যবহার করা উচিত। নাম, পদবি, মোবাইল নম্বর, ই–মেইল ঠিকানাসহ যোগাযোগের অন্যান্য তথ্য উল্লেখ থাকলে পরিচয় বুঝতে সহজ হয়। কাজটি করার সহজ পদ্ধতি হলো, সেটিংস থেকে প্রতিটি ই–মেইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করার অপশন সক্রিয় করা।

সঠিক সম্বোধন: প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগে সম্বোধন আর বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের সম্বোধন এক হলে চলবে না। নাম ব্যবহার করা যেতে পারে।

কৌতুক থেকে বিরত থাকা: ই–মেইলে কৌতুক ও ব্যঙ্গাত্মক কিছু লিখে পাঠানো থেকে বিরত থাকা উচিত। কৌতুক উপস্থাপনার বিষয়, শুধু লেখা পড়েই এটি বোঝা যায় না বরং অপর প্রান্তের ব্যক্তি কথাগুলো বিদ্রূপ হিসেবে নিতে পারেন, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের বেলায়।

বানান পরীক্ষা করা: যত কম সময়ে তাড়াহুড়ো করে পাঠানোর প্রয়োজনই হোক না কেন, ‘সেন্ড’ বোতাম চাপার আগে অবশ্যই বানান পরীক্ষা করে নিতে হবে। ভুল খুঁজে পেলে বিরক্তি আসতে পারে এবং তাতে পরের অংশ না-ও পড়তে পারে অনেকে।

শুধু অনলাইনেই নয়, ই–মেইল এখন ব্যবহারকারীর সর্বজনীন ঠিকানায় পরিণত হয়েছে

প্রাপক সব তথ্য না-ও জানতে পারেন: ই–মেইল পাঠানোর সময় প্রাপক আগের সব আলোচনার সব তথ্য জানেন এমন ভাবা ঠিক না। এক বাক্যের ই–মেইল না লিখে, প্রতিটি ই–মেইলেই আলাদা নোট হিসেবে উপস্থাপন করা কার্যকর, কারণ আগের একাধিক ই–মেইল থেকে খুঁজে পূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করতে করতে এই ই–মেইলটি পড়ার আগ্রহ চলে যেতে পারে।

সব ই–মেইলের জবাব দেওয়া: আপনার কাছে পাঠানো সব ই–মেইলের জবাব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ই–মেইলে কোনো বিষয়ের বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন হতে পারে, অথবা কোনো তথ্য সংগ্রহের পর পাঠাতে হবে এমন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ফিরতি ই–মেইলে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে আপনি ই–মেইলটি পেয়েছেন এবং পূর্ণ জবাব দিতে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন।

রেগে গিয়ে জবাব না দেওয়া: যেকোনো ই–মেইল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে তার জবাব দেওয়া উচিত না। খুব শক্ত পাল্টা জবাব দেওয়ার আগে তার কোনো ভিত্তি ও প্রমাণ আছে কি না, তা যাচাই করে নেওয়া উচিত।

ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা: প্রকাশ হলে ক্ষতির আশঙ্কা আছে এমন তথ্য ই–মেইলের মাধ্যমে পাঠানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তথ্যগুলো অপর কারও হলে পাঠানোর আগে তার অনুমতি নেওয়া জরুরি।

সংক্ষিপ্ত ই–মেইল পাঠানো: ই–মেইল অযথা দীর্ঘ করা উচিত না। ই–মেইলের লেখা ও স্বাক্ষরসহ এটির ধৈর্য্য যেন এতটা না হয় যে আপনি নিজেই তা পুনরায় পড়তে বিরক্ত হন।

চাকচিক্য নয়: বিভিন্ন ধরনের ফন্ট ও নানা রঙের মিশ্রণে ই–মেইল লেখা উচিত না। 

স্প্যাম ই–মেইল কী?

অনাকাঙ্ক্ষিত ই–মেইলগুলো স্প্যাম বা জাঙ্ক ই–মেইল নামে পরিচিত। পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রতারণ, প্ররোচনামূলক ই–মেইলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও ভুল পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়ে থাকে এই ধরনের ই–মেইলগুলো। গুগল, মাইক্রোসফটসহ ই–মেইল সেবাদানকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত এই ধরনের ই–মেইলগুলো আলাদা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনিরাপদ ও হালনাগাদ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না এমন ই–মেইল সার্ভারগুলো এই সমস্যা থেকে ব্যবহারকারীদের নিরাপদ রাখতে কম সক্ষম।

ই–মেইল ক্লায়েন্ট

কম্পিউটারে ই–মেইল ক্লায়েন্টের মাধ্যমে যদি ই–মেইল ব্যবহার করে থাকেন তবে অবশ্যই সফটওয়্যারটির হালনাগাদ সংস্করণ ব্যবহার করুন। চুরি করা পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করলে নিজের ক্ষতি তো হতেই পারে, পাশাপাশি আপনার মাধ্যমে অ্যাড্রেসবুকে থাকা সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

আসল লাইসেন্স কেনা সম্ভব না হলে জি–মেইল, আউটলুকের মতো অনলাইন সেবা অথবা মুক্ত সোর্স সফটওয়্যার মজিলা থান্ডারবার্ড বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।

দুই ধাপে লগইন ব্যবস্থা

অ্যাকাউন্টে ই–মেইল ঠিকানা ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লগইন করার সুযোগ থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থে সব সময় দুই ধাপে লগইন করা উচিত। এই পদ্ধতিতে ই–মেইল পাসওয়ার্ড সঠিক হলে অ্যাকাউন্টের জন্য নির্ধারিত মোবাইলে একটি কোড পাঠানো হয় এবং সেটি সঠিকভাবে লিখতে পারলেই কেবল লগইন সম্পন্ন হবে। বলা যেতে পারে আলস্য করেই অনেকে এই সেবাটি ব্যবহার করেন না। তবে একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যায়।

ই–মেইল এনক্রিপশন

জি–মেইল, ইয়াহু, আউটলুক বা অন্যান্য যে পদ্ধতিতেই পাঠানো হোক, তারা ইচ্ছা করলেই আপনি কাকে কখন কী কথা লিখে পাঠাচ্ছেন তা পড়তে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি নিয়ে আমরা তেমন ভাবছি না এবং গুরুত্বও দিচ্ছি না। আপনার পাঠানো কোনো ই–মেইল শুধু ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আর কাউকে পড়তে না দিতে চাইলে লেখাগুলো এনক্রিপ্ট করে পাঠাতে পারেন। OpenPGP হলো এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফিক গোপনীয়তা এবং যাচাই করার পদ্ধতি মেনে চলা হয়।

একে অপরকে ই–মেইল পাঠানোর ক্ষেত্রে এনক্রিপশনের ব্যবহার করতে চাইলে মেইলভেলপ (www.mailvelope.com) ব্রাউজার অ্যাডঅন অথবা ডেস্কটপ ই–মেইল ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রে এনিগমা (enigmail.net) প্লাগ-ইন ব্যবহার করা যেতে পারে।

সব সময় ই–মেইল নয়

দৈনন্দিন যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের জীবনকে বহুগুণ সহজ করেছে ই–মেইল। তবে ই–মেইল সব কিছুর বিকল্প নয় এবং এটি দিয়ে সবকিছু করার চেষ্টা করাও ভুল। যে বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন সেটি ফোনে, সরাসরি দেখা করে বা অন্য মাধ্যমে আলোচনা করতে হবে, এরপর একটি ই–মেইল লেখা যেতে পারে এটি উল্লেখ করার জন্য যে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ই–মেইলে যোগাযোগে কম সময় লাগে, এর ফলে যে অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাচ্ছে সেই সময়ে আরও একটি ই–মেইল না লিখে সরাসরি সাক্ষাতে সেই সময় ব্যয় করা যেতে পারে।

কাজের মধ্যে মনোযোগ অন্য বিষয়ে সরে গেলে পুনরায় সেই কাজে ফিরতে গড়পড়তা ২০ মিনিট সময় লাগে। ই–মেইল ব্যবহার জরুরি, কিন্তু তা মুহূর্তে মুহূর্তে নয়। বরং একটি  নির্দিষ্ট সময় পরে পরে দেখা যেতে পারে। এবং যিনি ই–মেইল পাঠাবেন তারও একইভাবে চিন্তা করা উচিত। অত্যধিক জরুরি বিষয় ই–মেইলে না জানিয়ে সরাসরি ফোনে বলা যেতে পারে।

লেখক: সফটওয়্যার প্রকৌশলী

ই–মেইলের সতর্কতা

বিভিন্ন আকর্ষণীয় তথ্য দিয়ে আকৃষ্ট করে অপরের তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ই–মেইল একটি বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। অপরিচিত ঠিকানা থেকে পাঠানো ই–মেইল বিশেষত ই–মেইলে থাকা কোনো লিংক খোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। ই–মেইলে পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের সতর্কতা, অ্যাকাউন্ট পুনরুদ্ধার ইত্যাদি উল্লেখ থাকা ই–মেইলগুলো খুলে কোথাও পাসওয়ার্ড দেওয়ার আগে ভাবতে হবে সত্যি আপনি অ্যাকাউন্ট রিকভারির অনুরোধ করেছিলেন কি না। সামান্য অসতর্কতার জন্য ফেসবুক, টুইটারসহ অন্যান্য অ্যাকাউন্ট অপরের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।