বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এখন ইন্টারনেটের আওতায় চলে এসেছে। বলা হচ্ছে, ইন্টারনেট জগতে শুরু হচ্ছে নতুন বিপ্লব। এই পরিবর্তনের তোড়ে বদলে যেতে পারে বর্তমান সমাজের কর্মপ্রক্রিয়া। একই সঙ্গে সৃষ্টি হবে ব্যবসায়ের নতুন ধাঁধা। প্রশ্ন হলো, সেই গোলকধাঁধায় ঘুরে কি গুপ্তধন মিলবে?
বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হারে বাড়ছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। এই হার এতই বেশি যে, শুধু গত তিন বছরে ৭২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছে। চীনে এখনো ইন্টারনেট বিস্তৃত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী পাওয়া যাচ্ছে ভারত ও আফ্রিকা অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চলগুলো অপেক্ষাকৃত দরিদ্র। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে এসব অঞ্চলের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। কারও কারও মতে, এই পরিবর্তন অনেকাংশে নেতিবাচক। অথচ ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার যেসব উপকারিতার কথা বলা হয় (যেমন: কৃষি, শিক্ষা ও চিকিৎসায়) সেগুলোর প্রভাব কম দেখা যাচ্ছে। কারণ ইন্টারনেট যতটা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘অকাজে’।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, নতুন ব্যবহারকারীদের কাছে ইন্টারনেটের মূল আকর্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে বিনোদন ও সামাজিকভাবে যুক্ত থাকার বিষয়গুলো। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর রমরমা চলছে। অনেকে শুধু গেম খেলার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। মেসেজিং অ্যাপ জনপ্রিয় হচ্ছে, কারণ মানুষ এখন ভার্চুয়াল জগতে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে আগ্রহী বেশি। ইউটিউবে ভিডিও দেখতে বা টিকটকে নিজের বানানো ভিডিও ছড়িয়ে দিতে মানুষের আনন্দ বেশি। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ফাঁকফোকরে পাওয়া যাচ্ছে পাইরেটেড ছবি। আছে পর্নোগ্রাফির সম্ভার। ইন্টারনেটের নতুন ব্যবহারকারীরা এসবেই মন দিচ্ছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আত্মোন্নয়নের পথে তারা হাঁটছেন কম।
তবে এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ব্যবসা চলছে তরতরিয়ে। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়ে যাওয়ায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কামাই ভালো হচ্ছে। ফেসবুকের ১৫০ কোটি গ্রাহক আছে শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। ইউটিউবে এখন পশ্চিমা ব্যবহারকারীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন। ব্যবসা এতটাই বেড়েছে যে চীন বাদে উদীয়মান বিশ্বের দেশগুলোতে শীর্ষস্থানীয় এসব প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য ছুঁয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ক।
জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের (আইটিইউ) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ইন্টারনেটের বৈশ্বিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এই বাড়তি ব্যবহারকারীদের মাতৃভাষা ইংরেজি বা মান্দারিন নয়। অর্থাৎ শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলো ও চীন থেকে এই বিপুল ব্যবহারকারী আসছেন না। এই ব্যবহারকারীরা মূলত মোবাইল ডিভাইসে ভর করে ডিজিটাল হচ্ছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি পুরোপুরি স্মার্টফোন-নির্ভর হয়ে পড়ছে। তাই এন্ট্রি-লেভেল স্মার্টফোনে বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি উৎসাহী হচ্ছে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
রটারডামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পায়েল অরোরা বলছেন, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ইন্টারনেট এখন ‘অবকাশের অর্থনীতি’তে পরিণত হয়েছে। সাধারণত দরিদ্র বিশ্বে ইন্টারনেটের প্রসারকে উন্নয়নের সমার্থক হিসেবে ভাবা হয়। বলা হয়ে থাকে, ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে দরিদ্র কৃষক আবহাওয়ার আগাম বার্তা পাবেন, জানতে পারবেন কৃষিপণ্যের প্রকৃত দাম। আবার শিক্ষা ও যোগাযোগের প্রসারে ইন্টারনেটের অবদানকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আদতে সেভাবে ভাবছে না। যখন অনলাইনে আসার বিষয়টি সামনে আসছে, তখন তারা শ্রমের চেয়ে অবকাশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত ও আশপাশের অঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য বেশি দেখা যাচ্ছে। শুধু এই দেশগুলোতেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত অঞ্চলের দেশগুলোতেও একই অবস্থা। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকে ভর্তুকি দিয়ে অসংখ্য সাইবার ক্যাফে চালু করেছিল ব্রাজিল। এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা। এই সাইবার ক্যাফেগুলো কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছিল সিনেমা ও গেমের কারণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ক্যারিশমা। বর্তমানে ফেসবুকের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী আছে ব্রাজিলে। ল্যাটিনোব্যারোমেটরো নামের একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, লাতিন আমেরিকার অধিবাসীরা গড়ে দিনে একবার খাবার খেলেও, প্রতি তিনজনের একজনের হাতের মুঠোয় আছে স্মার্টফোন!
আফ্রিকাতেও একই অবস্থা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যারাবু ডিজিটাল ২০১৫ সালে এ নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, আফ্রিকা অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বিনোদনকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের আরেক জরিপে দেখা গেছে, সাব-সাহারা এলাকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার জন্য অনলাইনে থাকে। আর জরিপে অংশ নেওয়া ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাত্র ১৭ শতাংশ শিক্ষার প্রয়োজনে ইন্টারনেটকে কাজে লাগায়।
ফেসবুকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী আছেন ভারতে। মোবাইল ডেটা ব্যবহারের দিক থেকেও ভারত বিশ্বে অন্যতম। বর্তমানে শুধু ভারতেই সবচেয়ে কম দামে ১ গিগাবাইট মোবাইল ডেটা মেলে। ভারতজুড়ে দ্রুতগতির মোবাইল ডেটা সেবা দিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স জিও প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রিলায়েন্স জিও-এর প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার সুফল হলো, মাত্র ২৬ সেন্টে পাওয়া যায় ১ জিবি মোবাইল ডেটা! আর সেই ডেটা দিয়ে চলে ইন্টারনেটে সময় কাটানো।
‘ইকোনমিস্ট’ বলছে, সময় কাটানো এখন ইন্টারনেটের মূল সুধা। গুগল ও অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরের সবচেয়ে বেশি আয় করা ২৫টি অ্যাপই হলো গেমের। চীনের টেনসেন্ট শুধু গেমের কারণেই টেক জায়ান্টে পরিণত হয়েছে। অবকাশ যাপনের প্রক্রিয়াটিকে মূল সূত্র মেনেই যাত্রা শুরু করেছিল ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এসবে আকৃষ্ট হলেও অর্থ উপার্জনের জন্য গুগল-ফেসবুকের কাছে তারা উপযুক্ত ভোক্তা নয়। বিজ্ঞাপন থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করেন মার্ক জাকারবার্গ-সুন্দর পিচাইরা। এই আয় আরও বাড়ে, যখন ভোক্তারা সেই সব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে পণ্য কেনেন। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে সেই স্রোতে গা ভাসানো সম্ভব হয় না। তাই উত্তর আমেরিকার একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছ থেকে যেখানে বছরে ১১২ ডলারের বিজ্ঞাপন রাজস্ব পাওয়া যায়, সেখানে এশিয়ার একজন ব্যবহারকারী দেন মোটে ১১ ডলার! একইভাবে গুগলের আয়ের ৪৬ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, এশিয়ার ভাগ মাত্র ১৫ শতাংশ। অথচ গুগল-ফেসবুকের ব্যবহারকারী বাড়ছে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের দেশগুলোতেই।
এই নতুন ব্যবহারকারীদের কথা চিন্তা করে এখন নতুনভাবে ব্যবসা সাজাচ্ছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই নীতিতে ভিডিও দেখা, সামাজিক সংযুক্তি, মেসেজিং প্রভৃতি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন অ্যাপে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করার ভাবনাও গুরুত্ব পাচ্ছে।
এত কিছুর ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটকে অবলম্বন করে দেখা উন্নয়নের স্বপ্ন। ইন্টারনেটে সময় কাটানোর মঞ্চে এক কাতারে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বের ধনী-গরিব। তাতে ভুবনগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।