>
৩০ বছরের কম বয়সী ৩০ সম্ভাবনাময় উদ্ভাবকের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস সাময়িকী। সেই তালিকায় আছে বাংলাদেশের জি এম মাহমুদ আরিফের নাম। যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস রিসার্চ নামে একটি গবেষণা সংস্থায় কাজ করছেন তিনি। ই–মেইলের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মো. সাইফুল্লাহ
‘আপনার গবেষণার বিষয় মূলত কী?’ প্রশ্ন করে একটা খটমটে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বিজ্ঞানীরা যখন তাঁদের কাজ নিয়ে কথা বলেন, অধিকাংশ সময়ই সেটা দুর্বোধ্য লাগে। কিন্তু জি এম মাহমুদ আরিফ রীতিমতো চমকে দিলেন। তিনি এত সহজ ভাষায় বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেন, মনে হলো গল্প বলছেন।
‘আমার কাজ হলো শরীরের আয়ন চ্যানেল নিয়ে মৌলিক গবেষণা করা। আয়ন চ্যানেল এক ধরনের ছোট নল আকৃতির প্রোটিন, যা সাধারণত বন্ধ থাকে, কিন্তু কোনো উদ্দীপনা পেলে খুলে যায়। ভোরের পাখির ডাক, মৃদু বাতাসের পরশ বা রাতের তারার ঝিকিমিকি দেখে যে অনুভূতি হয়, এসব কিছুর মূলেই আছে শরীরের সংবেদনশীল আয়ন চ্যানেল। যখন আমাদের চোখে আলো এসে পড়ে বা যখন আমরা শব্দ শুনি, যখন কেউ হাতে হাত রাখে, তখন আয়ন চ্যানেল তা শনাক্ত করে।’
ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, ৩০ বছরের কম বয়সী এমন ৩০ জন তরুণের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস সাময়িকী। এই তালিকাটির শিরোনাম তারা দিয়েছে ‘থার্টি আন্ডার থার্টি ইন সায়েন্স ২০১৯ ’। সেখানে স্থান পেয়েছে জি এম মাহমুদ আরিফের নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ ছাত্র এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস রিসার্চ নামে একটি গবেষণা সংস্থায় পোস্টডক্টোরাল সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
কেন সম্ভাবনাময়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক শেষ করেন আরিফ। পিএইচডি শেষ করেন ২০১৬-তে, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট জোনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডির দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মূলত আয়ন চ্যানেল নিয়ে তাঁর কাজের শুরু। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ইয়ং ইয়ু নামে আয়ন চ্যানেল বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন অধ্যাপক যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন আরিফ। নিজের কাজ সম্পর্কে আরিফ বলেন, ‘হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, বোধ, চেতনা, স্মৃতি বা উপলব্ধি—এসবের মূলে আয়ন চ্যানেলগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এরা ঠিকমতো কাজ না করলে শরীরে নানা রকম অসুখ বাসা বাঁধে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। আমার কাজ হলো এ ধরনের রোগ–সংশ্লিষ্ট আয়ন চ্যানেলগুলোকে আরও ভালোভাবে জানা।’
মানুষের শরীরে ‘ট্রিপ’ নামে একটি বিশেষ ধরনের আয়ন চ্যানেল আছে। যেটি পরিবর্তিত হয়ে গেলে শরীরের বৃক্কে এক ধরনের রোগ হয়। যার নাম ‘অটোসমাল পলিস্টিক কিডনি ডিজিজ’। বছরে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। ড. ইয়ংয়ের নির্দেশনায় আরিফ ‘ট্রিপ’ নামের এই রহস্যময় আয়ন চ্যানেলটি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কীভাবে কিডনি রোগের উপসর্গ দূর করা যায় বা চিকিৎসাকে ত্বরান্বিত করা যায়, সেই পথও উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
পিএইচডি শেষ করে উচ্চতর গবেষণার জন্য আরিফ যোগ দেন স্ক্রিপস রিসার্চে, মার্কিন গবেষক ড. স্কট হেনসেনের সঙ্গে। মানুষের শরীরে সুখদুঃখের অনুভূতি যেমন আয়ন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, তেমনি দুঃখ-ব্যথা-বেদনা মস্তিষ্কে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও এই আয়ন চ্যানেলের। আরিফ আবারও গল্পের মতো করেই বুঝিয়ে বলেন, ‘মৃদু চিমটি বা পড়ে গিয়ে আছাড়ের ব্যথা টের পাইয়ে দেয় এই আয়ন চ্যানেলই। এ কারণে চিকিৎসকেরা সার্জারির সময় বিভিন্ন ওষুধ (অ্যানেসথেটিক) দিয়ে আয়ন চ্যানেলগুলোর কার্যকারিতা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেন। চেতনানাশক ওষুধগুলোর ব্যবহার অনেক নিরাপদ, তবে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ড. হেনসেনের তত্ত্বাবধানে আমার সাম্প্রতিক গবেষণা ছিল, কীভাবে চেতনানাশক ওষুধগুলো আণবিক পর্যায়ে আয়ন চ্যানেলগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে শরীরের কোষগুলোকে অসাড় করে দেয় তা জানা। এর ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চেতনানাশক তৈরি করা সহজ হবে। চেতনানাশক ওষুধ কীভাবে আয়ন চ্যানেলকে অকার্যকর করে, শেষ পর্যন্ত আমরা সেটা বের করতে সক্ষম হয়েছি।’
আয়নজুড়ে আনন্দ
তিন ভাইবোনের মধ্যে আরিফ সবার বড়। বাবা বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আরিফ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন বিএএফ শাহীন কলেজে (প্রথমে চট্টগ্রাম, পরে ঢাকায়)। দারুণ একটা শৈশব কেটেছে তাঁর। আরিফ বলেন, ‘বাসার কাছেই স্কুল হওয়াতে আমি আর ছোট দুই বোন মিলে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম স্কুলে। অসাধারণ একটা স্কুল। পড়াশোনার পাশাপাশি শারীরিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো। মনে আছে, বছরের একটা মাস কোনো পড়াশোনা থাকত না। শুধুই খেলাধুলা আর দৌড়ঝাঁপ। শিক্ষকেরা অনেক স্নেহ করতেন আর উৎসাহ দিতেন। না হেসে বাড়ি ফিরেছি এমন একটা দিনও কাটেনি। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে খেলতাম, পড়তাম, বকা-মার সব একসঙ্গেই খেতাম।’ বোঝা গেল, ছেলেবেলায় আরিফের আয়ন চ্যানেল তাঁর মস্তিষ্কে পৌঁছে দিয়েছে অজস্র হাসি, আনন্দ, সুখের অনুভূতি।
মা-বাবা কখনোই তাঁকে পড়ালেখার জন্য চাপ দেননি। ছেলে এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে উঠলেই তাঁরা খুশি! আরিফ অবশ্য এই সুযোগের অপব্যবহার করেননি। ছেলেবেলা থেকে তিনি মেধাবী ছিলেন। বাবা গাজী আমির হোসেন ও মা কামরুন নাহার থাকেন ঢাকায়। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো মুঠোফোনে। আমির হোসেন বললেন, ‘কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ ছিল বলে ছোটবেলায় ওকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলাম। স্কুলে পড়ার সময়ই ও একটা সফটওয়্যার তৈরি করেছিল। এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেলেও এইচএসসির সময় ওর একটু শরীর খারাপ ছিল, এ প্লাস পায়নি।’
আরিফ উচ্চমাধ্যমিকে নটর ডেম কলেজে পড়েছেন। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোতে তাঁর শক্ত ভিত স্থাপিত হয়েছিল নটর ডেমেই। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র, তখন একেক ব্যাচে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে ছোটখাটো একটা পরিবারের মতো। আরিফ বলেন, ‘শিক্ষকেরা প্রত্যেকের দিকেই আলাদা করে খেয়াল রাখতেন। ইম্যুনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজির মতো কঠিন বিষয়গুলো অনেক সহজ করে বোঝাতেন। উদ্দেশ্য ছিল জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো কাজে লাগিয়ে কীভাবে নতুন নতুন জীবপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করা যায় তার ধারণা দেওয়া।’ চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই সেন্ট জোন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
আরিফ বলেন, ‘জীবনের ৯৯ ভাগ বা তার বেশিই আমাদের অজানা। এর মধ্যে আমাদের ইন্দ্রিয় বা অনুভূতি কীভাবে কাজ করে, আমরা কীভাবে মনে রাখছি, ভাবছি, বুদ্ধি খাটাচ্ছি, আঁচ করছি, উপলব্ধি করছি, এর কোনো কিছুই আমরা জানি না।’
এত এত অজানা বলেই আরিফ কেবল রোগের চিকিৎসার উপায় বের করাতেই ক্ষান্ত থাকছেন না। তাঁর আশা, আয়ন চ্যানেল নিয়ে গবেষণা জীবনের এসব দুর্বোধ্য মৌলিক বিষয়গুলো বুঝতে সাহায্য করবে। এই স্বপ্ন পূরণ হলে আমাদের জীবনও কত-না সহজ হয়ে যাবে! তখন নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় আমরা বলব, “কত অজানারে জানাইলে তুমি...”!’