জাকারবার্গের এই লেখা বিভিন্ন ভাষায় এক যোগে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলায় লেখাটি প্রকাশের জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে বেছে নিয়েছে কেবল প্রথম আলোকেই।
আগামী মাসে ১৫ বছরে পা রাখবে ফেসবুক। যখন আমি ফেসবুক শুরু করি, তখন কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা আমার ছিল না। ওই সময় আমি উপলব্ধি করেছিলাম, সংগীত, বই, তথ্যসহ ইন্টারনেটে প্রায় সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যায়, শুধু পাওয়া যায় না সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি—মানুষ। তাই আমি এমন একটি সেবা নিয়ে এলাম, যার মাধ্যমে মানুষ যোগাযোগের পাশাপাশি একে-অপরের সম্পর্কে জানতে পারবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শত কোটি মানুষ এই সেবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে, এবং আমরা সময়োপযোগী বিভিন্ন সেবা নিয়ে হাজির হয়েছি, যা বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ পছন্দ করেছে। তারা প্রতিদিন এ সেবাগুলো ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি আমাদের ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠছে। ওই প্রশ্নগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার মূলনীতিগুলো আমি ব্যাখ্যা করতে চাই।
আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেকের বাক্স্বাধীনতা ও যোগাযোগের সুযোগ থাকা উচিত। আমরা যদি প্রত্যেককে সেবা দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, তাহলে আমাদের এমন একটি সেবা প্রয়োজন, যা ব্যবহারের সামর্থ্য সবার আছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া, যা দিতে পারি বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ থাকলে।
অনেকে প্রায়ই আমাদের বলেন, যদি বিজ্ঞাপন দেখতেই হয়, তাহলে যেন বিজ্ঞাপনগুলো তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়। অর্থাৎ, আমাদের আগে বুঝতে হবে, কোন বিষয়গুলোতে তারা আগ্রহী। তাই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ক্লিক করা বিষয়বস্তু, ‘লাইক’ দেওয়া পেজ ও অন্যান্য আরও কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে আমরা ‘ক্যাটাগরি’ তৈরি করি। যেমন, স্পেনে বসবাস করেন এবং বাগান-সংক্রান্ত পেজে ‘লাইক’ দেওয়া ব্যবহারকারীদের সে-সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনই দেখানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয়। নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা ইন্টারনেট যুগের আগেও ছিল। এখন অনলাইন-ব্যবস্থায় আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ও প্রাসঙ্গিকভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
টেলিভিশন, রেডিও অথবা সংবাদপত্রে আপনারা যে বিজ্ঞাপন দেখেন, তার তুলনায় ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন আমাদের আরও বেশি স্বচ্ছতা অবলম্বন ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিয়েছে। আমাদের সেবায়, বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আমরা যে তথ্য ব্যবহার করি, তার ওপর আপনাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং আপনারা চাইলেই যেকোনো বিজ্ঞাপনদাতাকে ব্লক করতে পারেন। একটি বিজ্ঞাপন কেন আপনাকে দেখানো হচ্ছে, তার কারণ আপনারা জানতে পারেন এবং যে ধরনের বিজ্ঞাপন আপনি দেখতে চান, তা ঠিকও করে নিতে পারেন। আপনারা আমাদের ট্রান্সপারেন্সি উপকরণ ব্যবহার করে একজন বিজ্ঞাপনদাতা অন্য কী কী বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছেন, তা-ও আপনি জানতে পারবেন।
এরপরও কিছু মানুষ আমাদের এই ব্যবসায়িক মডেলের জটিলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সাধারণ লেনদেনব্যবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানকে আপনারা কোনো পণ্য বা সেবা দেওয়ার জন্য মূল্য পরিশোধ করে থাকেন। এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের সেবাগুলো আপনি পাচ্ছেন বিনা মূল্যে। আপনাদের প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপনগুলো দেখাতে আমরা আলাদাভাবে বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে কাজ করি। মডেলটি কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, এবং আমরা সবাই সহজাতভাবেই যে ব্যবস্থা বুঝতে পারি না, তার ব্যাপারে সন্দিহান হই।
অনেক সময় আমরা এমন কিছু করছি বলে মানুষ ধারণা করে, যা আমরা আদৌ করি না। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করি না, যদিও মাঝেমধ্যেই খবর প্রকাশিত হয় যে আমরা তথ্য বিক্রি করি। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করাটা আমাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী। কারণ, এর ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে আমাদের সেবার মূল্য কমে যেতে পারে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য যাতে অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সতর্ক।
অনেকে আশঙ্কা করেন, বিজ্ঞাপন ফেসবুক ব্যবহারকারী ও আমাদের মধ্যে একধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয় যে সামগ্রিকভাবে মানুষের স্বার্থ জড়িত না থাকা সত্ত্বেও শুধু বিজ্ঞাপনের স্বার্থে আমরা ব্যবহারকারীর ফেসবুক ব্যবহার বাড়াতে চেষ্টা করছি কি না।
আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা ব্যবহারকারীর শেয়ারিং ও যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর অত্যন্ত মনোযোগী, কারণ আমাদের সেবার উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে পরিবার, বন্ধু ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে সাহায্য করা। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষ ফেসবুকে ভালো সময় কাটাতে পারছে কি না। এটা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে তারা আমাদের সেবা ব্যবহার করবে না। চমকপ্রদ (ক্লিকবেইট) ও অন্যান্য নিকৃষ্ট উপাদান (জাঙ্ক) সাময়িকভাবে ফেসবুকের ব্যবহার বাড়াতে পারে, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো প্রদর্শন করা আমাদের জন্য বোকামি হবে। কারণ, ব্যবহারকারীরা এগুলো দেখতে চায় না।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, ব্যবহার বাড়ানোর জন্য আমরা ক্ষতিকর ও বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয়বস্তু ফেসবুকে রাখছি কি না। এর উত্তর হলো—না। মানুষ প্রতিনিয়ত আমাদের জানায় কোন বিষয়গুলো তারা দেখতে চায় না। বিজ্ঞাপনদাতারাও তাদের ব্র্যান্ডকে এই ধরনের বিষয়ের পাশে দেখতে চায় না। এরপরও ক্ষতিকর কিছু বিষয় থেকে যাওয়ার একমাত্র কারণ হলো, এগুলো পর্যালোচনার জন্য আমরা যে জনবল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছি, তা এখনো ক্রমোন্নতির পর্যায়ে রয়েছে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
অবশেষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই বিজ্ঞাপন মডেলটি না থাকলে যে পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহৃত হতো, তার চেয়ে বেশি তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে এটি আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করছে কি না।
এ ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই যে বিজ্ঞাপনের জন্য আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করি, কিন্তু এসব তথ্য নিরাপত্তা ও সেবা পরিচালনার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের ওপর অনেক সময় কোড যুক্ত করে, যাতে কোনো ব্যক্তি একটি পণ্য দেখলে পরবর্তী সময়ে তাকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটি কেনার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়। তবে এই ধরনের ব্যবস্থা প্রতারণা কিংবা ভুয়া অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বিজ্ঞাপনের জন্য এই তথ্য আমরা ব্যবহার করব কি না, সে ব্যাপারে আমরা ব্যবহারকারীকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিই। তবে নিরাপত্তা ও সেবা পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা এই তথ্য কীভাবে ব্যবহার করি, তা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আমরা মানুষকে দিই না। যখন আমরা জিডিপিআর কমপ্লায়েন্সের অংশ হিসেবে বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য এই তথ্য ব্যবহারের ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের অনুমতি চেয়েছিলাম, তখন সিংহভাগ ব্যবহারকারীই বলেছে, তারা এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে, কারণ তারা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন দেখতে চায়।
আমি চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করি, তথ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো স্বচ্ছতা, নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রণ। আমরা কীভাবে তথ্য ব্যবহার করছি, সে ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট হতে হবে এবং ব্যবহারকারীকেও স্পষ্ট অভিমত দিতে হবে, তাদের তথ্য কীভাবে ব্যবহার করা উচিত বলে তারা মনে করে। আমরা বিশ্বাস করি, সমগ্র ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই নীতিগুলো বিধিবদ্ধ করা হলে সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
বিষয়টি সঠিকভাবে করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই ব্যবসায়িক মডেলের স্পষ্ট সুফল রয়েছে। প্রিয়জনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে এবং নিজের মত প্রকাশে শত কোটি মানুষ বিনা মূল্যে একটি সেবা পাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো বেড়ে ওঠার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে।
ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মে ৯ কোটিরও বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসা সক্রিয় রয়েছে এবং সম্মিলিতভাবে এগুলোই আমাদের ব্যবসার বৃহত্তম অংশ। অনেক উদ্যোক্তাই টেলিভিশন কিংবা বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের ব্যয় বহন করতে পারত না, কিন্তু এখন তারা এমন কিছু ‘উপকরণ’ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, আগে যা কেবল বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই করতে পারত।
এর ফলে বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমেই বিশ্বের বেশির ভাগ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, ফেসবুকে সক্রিয় অর্ধেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলেছে, ফেসবুকে যোগ দেওয়ার পর তারা কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে। এর অর্থ হলো, তারা আমাদের সেবা ব্যবহার করে কোটি কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। এ প্রসঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে গত বছর ২৬ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
আমাদের কাছে প্রযুক্তির অর্থ হলো, সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। আপনি যদি এমন একটি বিশ্বে বিশ্বাস করেন, যেখানে প্রত্যেকের বাক্স্বাধীনতা ও বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, এবং সবাই নিজের প্রচেষ্টায় ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করতে পারবে, তাহলে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন, যা প্রত্যেকের জন্য উপযোগী হবে। আমরা এমন বিশ্বই গড়ে চলেছি প্রতিদিন, এবং আমাদের ব্যবসায়িক মডেলের কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে।
*মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু হয় ফেসবুকের। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় দিকনির্দেশনা ও পণ্যবিষয়ক কৌশল নির্ধারণ করেন। ফেসবুকের মূল প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর সেবা ও উন্নয়নের কৌশল তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ালেখা করার সময় সেখানেই ফেসবুক চালু করেন। পরে ফেসবুকের সদর দপ্তর নিয়ে যান ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলটোতে।
মার্ক জাকারবার্গ: প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ফেসবুক
আরও পড়ুন:
ভুয়া খবর ছড়ালেই ব্যবস্থা নেবে ফেসবুক