যমজ সন্তান দুই ধরনের হতে পারে। অভিন্ন যমজ ও সাধারণ যমজ। প্রথম ধরনের যমজ সন্তান দুজন হুবহু এক। আর সাধারণ যমজ দুজনের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকে। যারা হুবহু এক তাদের আঙুলের ছাপও কি এক? এটা এক বিরাট প্রশ্ন। যদি এক হয়, তাহলে তো মহাবিপদ, তাই না? তখন তো একই আঙুলের ছাপ দুজন ব্যবহার করতে পারবে, একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র আরেকজন ব্যবহার করতে পারবে। এ রকম আরও সমস্যা দেখা দেবে। তাই জানা দরকার, আসল ব্যাপার কী।
এ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এমন দুজন মানুষ পাওয়া যায়নি, যাদের আঙুলের ছাপ হুবহু এক রকম। মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ভবিষ্যতেও অভিন্ন আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না। আর এ জন্যই আঙুলের ছাপ মিলিয়ে কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়। জাতীয় পরিচয়পত্রের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেশের যেকোনো ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। তাই আঙুলের ছাপের গুরুত্বই আলাদা।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে অভিন্ন যমজের ক্ষেত্রে। কারণ, এরা প্রায় সব ক্ষেত্রে হুবহু এক। দেখতে তো হুবহু এক বটেই, উপরন্তু এদের জেন্ডারও এক, মানে এরা হয় দুই ভাই হবে, নাহয় দুই বোন। এদের একজন ছেলে, আরেকজন মেয়ে কখনো হবে না। এদের দুজনের কথা বলার ভঙ্গি, হাসি-কান্না, চলাফেরা সবই প্রায় এক রকম। সহজে পার্থক্য করা যায় না। কারণ, এরা মায়ের গর্ভে জন্মের সূচনালগ্নেই নিষিক্ত ডিম্বকোষটি (আদি ভ্রূণকোষ, জাইগোট) বিভক্ত হয়ে পৃথক দুই সত্তা হিসেবে বিকশিত হয়। ফলে এদের দুজনের থাকে একই ডিএনএ। এদের জিনগত বৈশিষ্ট্য একই। একই নিষিক্ত ডিম্বকোষ বা জাইগোট থেকে দুজনের জন্ম বলে এদের বলা হয় অভিন্ন যমজ বা আইডেনটিক্যাল টুইন। এদের জেনেটিক গঠন একই রকম বলে চলন–বলন ও দেখতে হুবহু এক।
তবে মনে রাখতে হবে, জেনেটিক অভিন্নতা থাকলেও জন্মের পর পরিবেশ বা পারিবারিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সূক্ষ্ম পার্থক্য হয়তো থাকে, তবে সেটা বাহ্যিক। অন্তর্নিহিত জিনগত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য নয়। বাহ্যিক সূক্ষ্ম পার্থক্য আমাদের সাধারণ বিচারে হয়তো ধরা পড়ে না। কিন্তু মা ঠিকই চেনেন তাদের কে আসলে কে।
যা-ই হোক, অভিন্ন যমজ যদি সব ব্যাপারে অভিন্ন হয়, যদি তাদের জেনেটিক গঠনও হুবহু এক হয়, তাহলে কি তাদের আঙুলের ছাপও অভিন্ন, অর্থাৎ হুবহু এক হওয়ার কথা নয়? এর উত্তর হলো, না, এক নয়। ডিএনএ অভিন্ন হলেও দুজনের আঙুলের ছাপ অভিন্ন নয়।
কেন নয়? আঙুলের ছাপ প্রত্যেক ব্যক্তির বেলায় কেন আলাদা হয়? এটা যে কখনো এক বা অভিন্ন হতে পারে না, তা আমরা কীভাবে বলতে পারি? এ বিষয়ে জানার জন্য আমাদের জানতে হবে ভ্রূণের বিকাশে বিভিন্ন পর্বে আঙুলের দাগের প্যাটার্ন কীভাবে গঠিত হয়। মায়ের গর্ভে ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন পর্বে হরমোনের মাত্রা ও অন্যান্য পরিস্থিতির প্রভাবের কারণে আঙুলের দাগগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন ভ্রূণ দুটির ওপর রক্তচাপের পার্থক্য, পুষ্টির গ্রহণমাত্রা, গর্ভে কার অবস্থান কোনখানে এবং আঙুলের বিকাশ কার কীভাবে হচ্ছে—এসব বিষয় আঙুলের ছাপের গঠনকে প্রভাবিত করে। এ জন্য অভিন্ন যমজদের জেনেটিক গঠন অভিন্ন হলেও আঙুলের ছাপ অভিন্ন নয়।
অভিন্ন যমজের বিষয়টি তো বুঝলাম। সাধারণ যমজের ব্যাপারটা কী? সাধারণ যমজেরা অভিন্ন যমজদের মতো একটি আদি ভ্রূণকোষ থেকে নয়, মায়ের গর্ভে দুটি আলাদা ডিম্বকোষ নিষিক্ত হয়ে বিকশিত হয়। সাধারণত মায়ের গর্ভে মাসে একবার একটি ডিম্বকোষই আসে এবং সেটি নিষিক্ত হয়। এরপর ভ্রূণকোষটি বিকশিত হয়ে একজন সন্তানই জন্ম নেয়। কিন্তু ব্যতিক্রম হিসেবে কখনো মায়ের গর্ভে যদি দুটি ডিম্বকোষ এসে যায়, তাহলে আলাদাভাবে দুটি ডিম্বকোষ নিষিক্ত হয়ে যমজ সন্তান জন্ম নেয়। যেহেতু পিতার দুটি পৃথক শুক্র কোষ (স্পার্ম) আলাদাভাবে দুটি ডিম্বকোষকে নিষিক্ত করে, তাই সৃষ্ট আলাদা ভ্রূণকোষ দুটির (জাইগোট) আলাদা ডিএনএ বা জেনেটিক গঠন থাকে। এ যমজদের চেহারা ও চালচলনে বেশ মিল। এ মিল অনেকটা আপন ভাইবোনের মতো বা এর চেয়ে একটু বেশি মিল থাকে। তবে এদের একজন বোন ও অপর জন ভাই হতে পারে। তারপরও বেশ মিল থাকে তাদের মধ্যে। কিন্তু এদের আঙুলের ছাপ কখনো হুবহু এক হয় না।
অভিন্ন ও সাধারণ যমজের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো অভিন্ন যমজ যেহেতু একই জাইগোট বিভক্ত হয়ে জন্ম নেয়, তাই এদের দুজনেরই ডিএনএর গঠন অভিন্ন, সেটা আগেই বলেছি। যমজ দুজনই হয় ছেলে (XY ক্রোমোজোম) অথবা মেয়ে (XX ক্রোমোজোম) হয়। কিন্তু সাধারণ যমজের ক্ষেত্রে এই ক্রোমোজোম সজ্জা বদলে যেতে পার। একজনের XY ক্রোমোজোম এবং অন্যজনের XX ক্রোমোজোম হলে যমজ দুজনের একজন ভাই ও অন্যজন বোন হবে।
আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক