জার্মান জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়ো এন টেক নিউইয়র্কের ওষুধ উৎপাদনকারী ফাইজার ইনকরপোরেশনের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠান দুটি এ বছরের শেষ নাগাদ প্রতীক্ষিত ভ্যাকসিন বিস্তৃত আকারে সরবরাহের জন্য নিয়ন্ত্রকদের অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে এমনটাই বলেছেন বায়ো এন টেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউগুর শাহিন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও এখন বলছে, এ বছরের মধ্যেই ভ্যাকসিন বাজারে আনার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, তা অর্জনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।
বায়ো এন টেক বলেছে, তাদের ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ধাপ বা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা এ মাসের শেষেই শুরু হচ্ছে। এ পরীক্ষায় ৩০ হাজার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এ পরীক্ষার ফল চলতি বছরের মধ্যেই জানা যাবে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিনটির অনুমোদন চাওয়া হবে।
এদিকে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাইজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অ্যালবার্ট বোরলাও একই কথা বলেছেন। বোরলা বলেছেন, তাঁরা আশা করছেন, আগামী অক্টোবর নাগাদ তাঁদের ভ্যাকসিনের জন্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছ থেকে অনুমোদন পেয়ে যাবে। সেপ্টেম্বরে তাঁরা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ফল জেনে যাবেন।
১ জুলাই ফাইজারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফল ইতিবাচক। এটি স্বাস্থ্যবান মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। তবে বেশি মাত্রায় দেওয়া হলে জ্বরসহ অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফাইজারের তৈরি ভ্যাকসিনের প্রথম ক্লিনিক্যাল তথ্য ‘মেডআরএক্সআইভি’ সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়। ইতিবাচক ফল প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বার্ষিক ভ্যাকসিন ডোজ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১০ কোটি করেছে।
বোরলা বলেন, ‘চূড়ান্ত গবেষণার ফল পাওয়ার পরে আমরা আরও জোর দিয়ে সাফল্য দাবি করতে পারব। তবে এটি যে কার্যকর হবে, তার অনেক চিহ্ন আমি দেখেছি। ভ্যাকসিনটি কার্যকর হবে কি না, তা বলার জন্য যথেষ্ট তথ্য আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাদের হাতে চলে আসবে। এ তথ্য এফডিএর অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া হবে। আমাদের ভাগ্য ভালো হলে আগামী অক্টোবরে অনুমোদন পেয়ে যেতে পারি। এটা সম্ভব।’
বোরলা আরও বলেন, ‘ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মজার অংশ হচ্ছে আমরা যদি এর কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারি এবং এফডিএর অনুমোদন পাওয়া যায়, তবে তখন ভ্যাকসিন প্রস্তুত থাকবে। এটা আগে কখনো হয়নি। অনুমোদনের আগেই ভ্যাকসিন তৈরি করে রাখা হচ্ছে। শিগগিরই প্রকৃত ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন বোতলজাত করার আগে বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। এর জন্য ১০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে ফাইজার।’
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে গত সাত মাসে বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ২৩ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ৫ লাখের বেশি। এর অর্থ, ভ্যাকসিন–দৌড়ে যে কোম্পানি প্রথম হবে, তাদের সামনে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য অপেক্ষা করছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে মার্কিন ভ্যাকসিন কোম্পানি নোভাভ্যাক্স জানায়, তারা সরকারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা পাচ্ছে। তারা দ্রুত তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষার গতি বাড়াচ্ছে। এ বছরের শেষ নাগাদ তাদের ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কি না, তা জানা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলকেন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসের জন্য ১৯০টি ভ্যাকসিন ও ২৬৩ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি উন্নয়নে কাজ চলছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার জোট ভ্যাকসিন তৈরিতে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ফলাফল বা কার্যকারিতার বিষয়টি আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ জানা যাবে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রধান নির্বাহী প্যাসকল সারিওট বলেন, তাঁদের ভ্যাকসিন এক বছর পর্যন্ত কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে এর ফল জানা যাবে। ভ্যাকসিনের ফলের জন্য অপেক্ষার পাশাপাশি ভ্যাকসিন উৎপাদন চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অক্টোবরেই ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু করা যাবে।
এনবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষ অ্যান্টনি ফাউসি ফেসবুকের এক লাইভ অনুষ্ঠানে বলেছেন, এ বছরের মধ্যেই ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্য অর্জনে জুলাই মাসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন যেভাবে সবকিছু চলছে, এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো একটি ভ্যাকসিন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে চলে যাবে।
ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ক্যানসিনো (চীন), মডার্না (যুক্তরাষ্ট্র), উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস (চীন), বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস (চীন), সিনোভ্যাক্স (চীন), নোভাভ্যাক্স (যুক্তরাষ্ট্র), ইনোভিও (যুক্তরাষ্ট্র)। এসব প্রতিষ্ঠান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাদের ভ্যাকসিনের ফল জানাতে পারে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা এফডিএ বলেছে, কোনো ভ্যাকসিনের অনুমোদন পেতে হলে তাকে অবশ্যই সাধারণ ওষুধের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি কার্যকর বলে প্রমাণ করতে হবে। এফডিএর সেন্টার ফর বায়োলজিকস ইভোলিউশন অ্যান্ড রিসার্চের পরিচালক পিটার মার্কস বলেন, তাঁর মতে, কোভিড-১৯ রোগ থেকে মুক্তি পেতে একটি ভ্যাকসিনকে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ কার্যকর হতে হবে। ফিয়ার্সফার্মার তথ্য অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন যদি ৭০ শতাংশ জনগণকে দেওয়া যায়, তবেই এ রোগ নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে।