বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামেই সুইজারল্যান্ডের কাছে ২–০ গোলে হেরে ইউরো থেকে ইতালির বিদায় নিতে হলো? আলাদা করে ভেন্যুর নাম কেন উচ্চারিত হচ্ছে? এই স্টেডিয়ামেই যে ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিল ইতালি।
কিন্তু এবারের ইউরোতে ইতালির যে দলটাকে দেখা গেল, সেটির সঙ্গে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী ইতালির যেকোনো ধরনের তুলনাই দলটির সমর্থকদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য। কিসের সঙ্গে কী!
শুধু ২০০৬ সালের ইতালি কেন, এবার ইউরোতে ইতালি যে ফুটবল খেলেছে, তাতে যে কেউই বলতে পারেন, এটি ইতালির সবচেয়ে বাজে দল। অন্তত গত তিন দশকের কথা উঠলে তো বটেই। অথচ এ দলটিকে নিয়েই ইতালি ইউরোর শিরোপা ধরে রাখতে এসেছিল এবার।
তিন বছর আগে ২০২১ সালে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের স্বপ্নকে চূর্ণ করে যে লিওনার্দো বোনুচ্চি, জর্জ কিয়েলিনি, চিরো ইম্মোবিলেদের যে দলটি ইউরো জিতেছিল, তার সঙ্গে এবারের দলটির আকাশ–পাতাল তফাত। গ্রুপ পর্বেই ব্যাপারটা বোঝা গিয়েছিল, কাল শেষ ষোলোর ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সেটি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে।
ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা গ্যারি লিনেকার তো সরাসরিই বিবিসি লাইভে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না, এ জীবনে আমি ইতালির এত বাজে দল কখনো দেখেছি।’
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে কাল ইতালি সামান্য লড়াইটুকুও করতে পারেনি। গ্রুপপর্বে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তা–ও যা একটু লড়াই করেছিল লুসিয়ানো স্পালেত্তির দল। কিন্তু শেষ ষোলোয় সেটি ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দলটিতে যে প্রতিভাবান খেলোয়াড় নেই, সেটি বলা যাবে না।
কিন্তু সবাই মিলে একটা দল হয়ে খেলতে পারেননি তারা। পারেনি সহজাত ফুটবলটা খেলতে। ২০২১ সালে ইউরোজয়ী দলের গোলকিপার জিয়ানলুইজি দোন্নারুমা যা একটু নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন (গ্রুপ পর্বে রেকর্ড ১১টি সেভ), জিওভান্নি ডি লরেঞ্জো, নিকোলো বারেলা, ফেদরিকো চেসিয়ারা এবার নিজেদের তুলে ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালান শিয়েরারের কথা, ‘তিন বছর আগে ইউরোতে ইতালি দলটা ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু আমি সত্যিই অবাক এবারের ইতালির দলটাকে দেখে। এত বাজে দল হয়ে গেছে তারা! কোনো পজিশনেই ভালো কিছু দেখলাম না। সুইজারল্যান্ড রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে তাদের নিয়ে।’
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ইতালির ম্যাচটা নিয়ে শিয়েরারের পর্যবেক্ষণ, ‘সুইজারল্যান্ড গোটা ম্যাচেই আধিপত্য নিয়ে খেলেছে। তারা ইতালিকে কোনো সুযোগই দেয়নি। ফরোয়ার্ড পজিশনে ইতালিকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। সুইজারল্যান্ডের জন্য তারা কোনো হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি, ম্যাচের কোনো মুহূর্তেই নয়।’
এই দলটার কোচ স্পলেত্তি নাপোলির হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের পর তাঁর অধীনেই ২০২৩ সালে নাপোলি সিরি ‘আ’ জিতেছিল। এরপর নাপোলির দায়িত্ব ছেড়ে তিনি নির্ভার সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু গত আগস্টে রবার্তো মানচিনি হঠাৎ করেই কোচের পদ ছাড়লে স্পালেত্তিকে ডেকে এনে ইতালি দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিয়েগো ম্যারাডোনা খেলোয়াড় হিসেবে যে নাপোলিকে শেষবার শিরোপার স্বাদ দিয়েছিলেন, সেই দলকে দীর্ঘ সময় পর আবার লিগ জেতানোয় স্পালেত্তিকে বেশ উঁচু আসনেই বসিয়েছেন নাপোলি সমর্থকেরা।
কাল বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বেশ কিছু ইতালি সমর্থক ম্যারাডোনার ছবি ছাপা জার্সি পরে খেলা দেখতে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মাঠে সিরি ‘আ’ জয়ী নাপোলির ধারকাছ দিয়েও যেতে পারেনি স্পালেত্তির ইতালি। অথচ সর্বশেষ মৌসুমে নাপোলি কী আকর্ষণীয় ফুটবলই না খেলেছিল!
২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর ইতালির সঙ্গে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টেরই যেন আড়ি হয়ে গেছে। ২০১০ ও ২০১৪—টানা দুবার প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার পর, ২০১৮ ও ২০২২ সালে ইতালি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বেই যেতে পারেনি। ২০২১ সালে ইউরোজয়ী মানচিনির ইতালি উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে হেরে ২০২২ বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে যেতে পারেনি। স্পালেত্তির প্রথম কাজই ছিল সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া।
ইউরোতে অবশ্য নিজেদের গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে কোয়ালিফাই করে ইতালি। প্রথম ম্যাচে আলবেনিয়ার বিপক্ষে প্রথম মিনিটেই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত ২–১ গোলে জিতেছিল ইতালি। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে যাচ্ছেতাই। স্পেনের বিপক্ষে হার আর শেষ ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের গোলে আসে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট। কিন্তু ওই পর্যন্তই। থামতে হলো কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই।
ইংল্যান্ডের আরেক সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্দিনান্দ ইতালির পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে, ‘ইতালির পারফরম্যান্স লজ্জাজনক। তাদের খেলাগুলো দেখে মনে হয়েছে, কোনো কিছুরই যেন কোনো সমাধান নেই তাদের কাছে। স্পালেত্তিকে এ নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, মনে হচ্ছে।’
স্পালেত্তি নিজেও জানেন তাঁকে পারফরম্যান্স নিয়ে জবাব দিতে হবে। ইউরো থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাঁর কথা, ‘দলের খেলোয়াড়েরা পারফরম্যান্সে দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। আমরা মোটেও ভালো ফুটবল খেলতে পারিনি। আমরা গোটা ম্যাচ একই গতিতে খেলে যেতে পারিনি। যখন আপনি প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়তা দেখাতে পারবেন না, তার মানে আপনি প্রতিপক্ষকে সুযোগ করে দিচ্ছেন। ইতালির খেলায় সেটিই হয়েছে।’