গত বছরের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিন বাফুফের দুর্নীতি রিয়ে ফিফার একটি চিঠি বাংলাদেশের ফুটবলকে ছাপিয়ে কাঁপিয়ে তুলেছিল পুরো ক্রীড়াঙ্গন
গত বছরের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিন বাফুফের দুর্নীতি রিয়ে ফিফার একটি চিঠি বাংলাদেশের ফুটবলকে ছাপিয়ে কাঁপিয়ে তুলেছিল পুরো ক্রীড়াঙ্গন

স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির ‘মহাসাগর’

আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ক্রীড়াঙ্গনে চলেছে দেদার দলীয়করণ। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের রূপরেখা পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার আগে বিগত দিনে ক্রীড়াঙ্গনের হালচাল নিয়ে এই ধারাবাহিকের আজ তৃতীয় পর্ব। 

গত বছর ১৪ এপ্রিল দেশবাসী যখন বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত, ঠিক সেদিন একটা খবর বাংলাদেশের ফুটবল ছাপিয়ে গোটা ক্রীড়াঙ্গনকে কাঁপিয়ে তোলে। খবরটি আসে ফিফা থেকে। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈমকে দুই বছর নিষিদ্ধ করার কথা জানায় বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অতীতে এমন ঘটনা ঘটেনি। বাফুফের কেনাকাটা ও আরও কিছু বিষয়ে ওই অনিয়ম হয়েছে বলে ৫২ পাতার বিশাল এক বিবরণ দেয় ফিফা। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে পরে ফিফা বাফুফের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ১৩ লাখ টাকা জরিমানাও করে।

শুধু বাফুফে নয়, গোটা ক্রীড়াঙ্গনই পরিণত হয়েছে দুর্নীতির আখড়ায়। দেশের সবচেয়ে ধনী ফেডারেশন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অ্যাথলেটিকস, শুটিং, উশুসহ বিভিন্ন ফেডারেশনে একাধিকবার। অ্যাথলেটিকসে গত বছর সাত কোটি টাকা সারা দেশের প্রতিভা অন্বেষণের নামে লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি সরকার বদলের পর শুটিং ও উশু ফেডারেশনের সাবেক খেলোয়াড়–কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। উশুর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শিফু দিলদার হাসানের অভিযোগ, বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা বাবদ ২১ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছে বর্তমান নেতৃত্ব, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। উশুর আন্তর্জাতিক কোচ ও সিলেট উশুর সংগঠক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করেছেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন। আন্তর্জাতিক কোচেস ও রেফারিজ প্রশিক্ষণে ম্যাকাও সফরের খরচ বাবদ তাঁর পাওনা ৩০০ ডলার সাধারণ সম্পাদক তাঁকে দেননি।

দুলাল হোসেন এসব অভিযোগ উড়িয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এটা তো ২০১৭ সালের কথা। তখন আমি উশুর সাধারণ সম্পাদক ছিলাম না।’ ২১ লাখ টাকার ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘চীনে খেলে আসা সাতজন খেলোয়াড় ও দুজন অফিশিয়ালকে আমরা সংবর্ধনা দিই মাস তিনেক আগে। ৯ জনের টিমের যাওয়া–আসা, সংবর্ধনাসহ ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়। চীনে যাওয়ার আগে অনুশীলন করানো হয়। সব মিলিয়ে ২১ লাখ টাকা খরচ হয়। এখানে দুর্নীতির কিছু নেই।’

শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্তেখাবুল হামিদ

খুঁটির জোর যখন ‘ভাই’

শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্তেখাবুল হামিদ স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। গুলশান শুটিং রেঞ্জের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১৭ সালে সরকার সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। শুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুলের প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দরপত্রে অংশ নিয়ে ১০টি ইলেকট্রনিক টার্গেট মেশিন আনে, প্রতিটি ২৬ লাখ টাকায়। ফেডারেশন পরে একই মেশিন আনে সাড়ে ছয় লাখে। ফলে ইলেকট্রনিক টার্গেট মেশিন আনা বাবদ শুটিং ফেডারশনের দুই কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এ নিয়ে তৎকালীন শুটিং ফেডারেশনের সভাপতি নাজিমউদ্দিন চৌধুরী মন্তব্য করেছিলেন, ‘লাভের তো একটা সীমা থাকে!’

ইন্তেখাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জালিয়াতি ধরা পড়ার ভয়ে বড় ভাই সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের প্রভাব খাটিয়ে ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দেওয়ার মতো কাজও নাকি করেছিলেন তিনি। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজের মেয়ে আমিরা হামিদকে নিয়ে গেছেন আর্জেন্টিনায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। শুটারদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে বিক্রি করা, শুটিং ফেডারেশনের মিলনায়তনের ভাড়া আত্মসাৎ করা, এমনকি শুটারদের নিজের বাড়ি পাহারায় রাখার মতো কাজ করার অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। স্বেচ্চ্ছাচারিতা, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির ছত্রচ্ছায়ায় শুটিংকে বন্দি করে রেখেছিলেন তিনি। অথচ এই ইন্তেখাবুল হামিদকেই প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলের শেফ দ্য মিশন করা হয়। এসব বিষয়ে জানতে ইন্তেখাবুলকে একাধিকবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে জানা গেছে কিছু সূত্রে।

উপদেষ্টার দপ্তরে চিঠি

রোইং ফেডারেশনের অর্থ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করে গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ রোইং ফেডারেশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় রুপাজয়ী খেলোয়াড় মাকসুদ আলম। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ক্যাসিনো হোতা ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কারের পরও অ্যাডভোকেট মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওছার দীর্ঘ এক যুগ রোইং ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে ছিলেন। তাঁর হাত ধরে রোইং ফেডারেশনে কার্যনির্বাহী কমিটিতে জায়গা পান গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদার ও তাঁর ভাগনে হাসান মোল্লাসহ অনেকে। ১৬ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হেলমেট পরা অবস্থায় পিস্তল হাতে গুলি চালাতে দেখা যায় রোইং ফেডারেশনের সদস্য হোসেন মোল্লাকে। পিস্তল হাতে গুলি করার এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ৫ আগস্টের পর থেকে হোসেন মোল্লা পলাতক।’

মাকসুদ আলমের চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, ‘রোইং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন কেরানীগঞ্জের ৯৩ বছর বয়সী হাজি খোরশেদ আলম। নিজের পদ ধরে রাখার জন্য ইচ্ছামতো ক্লাব নিবন্ধন করিয়েছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। ৫৮টি ক্লাবের মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি ছাড়া বাকিগুলোর অস্তিত্ব নেই।’ এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মোল্লা কাওসারের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হাজি খোরশেদ আলমের ফোনও বন্ধ। তবে রোইং ফেডারেশের সহসভাপতি মোহাম্মদ মনিরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাকসুদের এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। ফেডারেশন থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারেনি বলে সে এ ধরনের অভিযোগ করেছে।’

সরকার কত টাকা দেয়

গত অর্থবছরে (১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩১ জুন ২০২৪) বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা ও ঢাকার ৫৫টি বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন–অ্যাসোসিয়েশনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার মোট ৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। এর মধ্যে ক্রীড়া ফেডারেশন–অ্যাসোসিয়েশনগুলো পেয়েছে প্রায় এর অর্ধেক। জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো পেয়েছে ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলো ৫ থেকে ৭ লাখ। উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো সমান ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে।

বর্তমান অর্থ বছরে সব ফেডারেশন–অ্যাসোসিয়েশন ও ক্রীড়া সংস্থাগুলোর জন্য মোট বরাদ্দ ১০ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এনএসসির অনুদানের খাত দুটি। একটি অফিস পরিচালন, অন্যটি প্রশিক্ষণ ও খেলাধুলা আয়োজন। প্রশিক্ষণ ও খেলাধুলা আয়োজনের জন্য বর্তমান অর্থবছরে একমাত্র আর্চারির জন্যই বরাদ্দ কোটি টাকার ওপরে (১ কোটি ২ লাখ টাকা)। বিস্ময়করভাবে আর্চারির পর দ্বিতীয় স্থানে আছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশন। প্রশিক্ষণে ৫৭ লাখ আর খেলা আয়োজনে ৩৮ লাখ মিলিয়ে ৯৫ লাখ টাকা। কাবাডিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮৬ লাখ টাকা। অ্যাথলেটিকস ও সাঁতারে বরাদ্দ ৭৪ লাখ ও ৭২ লাখ টাকা। অথচ দেশে ক্রিকেট ও ফুটবলের পর প্রধান খেলা হকি, শুটিং, দাবা, সাঁতার ও অ্যাথলেটিকসের মতো ফেডারেশনগুলোর জন্য এই খাতে বরাদ্দ ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। প্রশিক্ষণের জন্য হকি পেয়েছে মাত্র ১১ লাখ! অথচ অপ্রচলিত খেলা ব্রিজের প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। 

ফেডারেশনগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। পরের বছরের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করার শর্ত হিসেবে এনএসসিকে অর্থের হিসাব দেওয়ার নিয়ম ফেডারেশনগুলোর। তবে অন্য খাত থেকে হওয়া আয়–ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হতো না। এনএসসি তা চায়ওনি। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকার এনএসসি ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন, বোর্ড ও সংস্থাগুলোকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং নীরিক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।  

‘দুর্নীতির মহাসাগর’

১২ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামনে এনেছেন আরেক দুর্নীতির প্রসঙ্গ। সেটি হলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কীভাবে বছরের পর বছর দোকান ভাড়া বাবদ কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এনএসসির অধীনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দোকান পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ২০ থেকে ২২ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসাবে এনএসসির কাছে ভাড়া গেলেও সরেজমিনে জানতে পারলাম দোকানগুলো ১৭০ থেকে ২২০ টাকা প্রতি বর্গফুট ভাড়া দিচ্ছে। আমাদের সরকারি খাতায় এসব দোকানের ভাড়া প্রতি বর্গফুট ২৬ টাকা। অতিরিক্ত ভাড়াটা কোথায় যায়, এটা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে আমাকে দুর্নীতির মহাসাগরে ছেড়ে দিয়েছে।’