২০২২ সালের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখেই এ লড়াইয়ের নিষ্পত্তি দেখে ফেলেছিল অনেকে। একদিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লিওনেল মেসি, অন্যদিকে কান্নাভেজা চোখে টানেল ধরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হেঁটে চলে যাওয়া। এ দুটি চিত্রই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইকে সিলগালা করে দিতে চেয়েছিল অনেকে। মেসির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মূলত শেষ ধরে নেওয়া হয়েছিল এ দ্বৈরথের। ‘মেসি’ ‘মেসি’ ধ্বনিতে রোনালদোর নামটা চাপাও পড়ে গিয়েছিল সে সময়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোনালদো ভক্তরাও খানিকটা চুপ মেরে যান।
বিশ্বকাপ জিতে মেসি যখন ‘সপ্তম স্বর্গ’ স্পর্শ করেছেন, রোনালদো তখন নিজের জন্য নতুন ঠিকানা খুঁজে যাচ্ছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে খবর আসে রোনালদো নতুন ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছে সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল নাসরকে। এর খবরে আরও দমে যান রোনালদো ভক্তরা। ‘সি আর সেভেন’ আর ইউরোপে নেই এ তো তাঁর শেষের বার্তাই দেয়। ৩৮ পেরোনো রোনালদোর ক্যারিয়ারের শেষটা যে আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রিয় খেলোয়াড়ের শেষটা ভক্তরা ইউরোপিয়ান কোনো ক্লাবেই দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু কে জানত, নিজ হাতে যে গল্পটা গত প্রায় দুই দশক ধরে রোনালদো লিখছিলেন তার শেষটা নিয়ে আলাদা ভাবনাই ছিল তাঁর।
রোনালদো যখন সৌদি আরবের পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে লড়ে যাচ্ছিলেন, তখন মেসিও যে ক্লাবের দিক থেকে স্বস্তিতে ছিলেন, তা নয়। পিএসজির সঙ্গে নতুন চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন তাঁকেও বিশ্বকাপ–পরবর্তী সময়টা ঠিকঠাক উপভোগ করতে দেয়নি। এর মধ্যে শোনা যায়, মেসি পিএসজি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সে সময় তাঁর সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে রোনালদোর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব আল নাসর, এমএলএসের ক্লাব ইন্টার মায়ামি এবং স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার নাম শোনা যায়। তখন পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে লড়াইটা আল হিলাল ও বার্সেলোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল আল হিলালে গিয়ে রোনালদোর সঙ্গে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করবেন মেসি। কিন্তু মেসির দলবদলে নতুন চমক আসে জুনের ৮ তারিখ। আর্জেন্টাইন মহাতারকা নিজেই ঘোষণা দিয়ে জানান, ‘আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি।’ তাঁর এই ঘোষণাতেই বদলে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল জগৎ। প্রায় দুই মাসে মার্কিন ফুটবলে যা ঘটেছে, তা রীতিমতো কোনো বিপ্লবের চেয়ে কম ছিল না। মেসির আগমন যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) ব্র্যান্ড মূল্যও মেসির মধ্য দিয়ে চূড়া স্পর্শ করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের বাইরে প্রায় সাড়ে সাত হাজার দূরত্বের আলাদা দুটি লিগে খেলে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়ছেন মেসি–রোনালদো? মূলত লিগ দুটি ইউরোপের বাইরে এবং কম জনপ্রিয় বলেই জমে উঠেছে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রোনালদো সৌদি লিগে আসার আগপর্যন্ত এ লিগের নামও খুব বেশি জানত না। এমনকি রোনালদোর ক্লাব আল নাসরকেও দেশটির বাইরে তেমন কেউ চিনত না। কিন্তু রোনালদোর আগমনের পর রাতারাতি বদলে গেছে এ চিত্র। রোনালদো আসার আগে আল নাসরের অনুসারী সংখ্যা ছিল আট লাখের মতো। কিন্তু রোনলদোর আসার খবরটির ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় কোটির ঘর। রোনালদোর আগমন শুধু সৌদি ফুটবলকেই নয়, তাৎক্ষণিকভাবে এশিয়ার ফুটবলে নতুন দিনের সূচনা করে। আল নাসরসহ অন্য ক্লাবগুলোও এর পর থেকে বৈশ্বিক গণমাধ্যমের খবর হতে শুরু করে।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসে গ্রীষ্মের দলবদল শুরুর পর। সৌদি ক্লাবগুলো একের পর এক তারকা ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে শুরু করে। এমন নয় যে শুধু বুড়ো খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়ে নতুন আরেকটি ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’ খুলেছে তারা। বরং তারুণ্য ও অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দারুণ সমন্বয় আনার চেষ্টা করছে ক্লাবগুলো। রোনালদোর পর মেসিকে না পেলেও শীর্ষ তারকাদের অনেকেই আগামী মৌসুমে মাতিয়ে তুলবেন সৌদি ফুটবলকে। এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যেসব নাম সৌদি আরবে এসেছে, তাঁদের মধ্যে করিম বেনজেমা, এনগালো কান্তে, জর্ডান হেন্ডারসন, কালিদু কোলিবালি, রবার্তো ফিরমিনো, ফাবিনিও এবং সাদিও মানে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের অনেকেই চাইলে আরও দুই–তিন মৌসুম শীর্ষ লিগে খেলতে পারতেন।
আরেকটি আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তালিকাটা এখানেই শেষ হচ্ছে না। এমনকি মেসিকে না পাওয়া আল হিলাল এমবাপ্পের জন্য পিএসজিকে চোখধাঁধানো ৩০ কোটি ইউরোর প্রস্তাবও দিয়েছিল। অবস্থা এখন এমন যে সৌদি লিগ এখনই ইউরোপিয়ান লিগগুলোকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে এই লিগ নিয়ে নিজেদের সতর্কতার কথা বলেছেন পেপ গার্দিওলা এবং ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো কোচ।
ইউরোপের পর সৌদি লিগের দলবদল শেষ হওয়া নিয়েও উদ্বেগের কথা বলেছেন তাঁরা। প্রশ্ন হচ্ছে, জানুয়ারির প্রথম দিন রোনালদো যদি সৌদি লিগে গিয়ে এ দ্বার না খুলতেন, তবে আজ এ পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হতো কি না! এর অনেক রকম উত্তর হতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি ফুটবলের উত্থান এবং ইউরোপের জন্য এর হুমকি হয়ে উঠার পেছনে এককভাবে যদি কোনো মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকে, তবে তিনি রোনালদো।
অন্য দিকে এমএলএসের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। মেসি আসার আগে এমএলএস একেবারেই অপরিচিত কোনো লিগ ছিল না। ডেভিড বেকহাম, ওয়েইন রুনি, কাকাদের কারণে এই লিগ পরিচিত ছিল। কিন্তু অইটুকুই। মানুষ হয়তো নামটুকুই জানত। পুরো চিত্র বদলেছে মেসির আগমনের পর। মুহূর্তের মধ্যে বাণিজ্যিক, ব্র্যান্ডিং এবং মাঠের খেলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে চতুর্থ স্থানে থাকা ফুটবলকে ঘিরে শুরু হয় ভিন্ন এক উন্মাদনা।
এমনকি ইন্টার মায়ামির মাঠে মেসির অটোগ্রাফ নিয়ে চাকরি হারানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। গত প্রায় দুই মাস ধরে টানা মেসি–জ্বরে কাবু হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল। শুধু মাঠের বাইরেই নয়, মাঠেও তিন ম্যাচে ৫ গোল করে মেসি বদলে দিয়েছেন দৃশ্যপট। দর্শকেরা গ্যালারিতে জায়গা পাচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে নতুন স্টেডিয়াম নিয়েও এখন ভাবতে হচ্ছে ইন্টার মায়ামি কর্তৃপক্ষকে। সব মিলিয়ে মেসি ঠিক সেই প্রভাবটাই এখন রাখছেন, যা রোনলদো রেখেছেন সৌদি লিগে গিয়ে।
এর মধ্যে সৌদি লিগকে এমএলএসের চেয়ে এগিয়ে থাকা লিগ বলে নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছেন রোনালদো। এর পক্ষে রোনালদোর যুক্তি কিন্তু ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। এমএলএসে এখন পর্যন্ত যে আলো, তা শুধুই ইন্টার মায়ামিকে ঘিরে। সৌদি আরবে কিন্তু তা নয়। এরই মধ্যে বড় তারকাদের দলে ভিড়িয়ে আল নাসরের পাশাপাশি অন্য ক্লাবগুলোও আলোচনায় চলে এসেছে।
আগামী মৌসুমে প্রো লিগের দ্বৈরথেও এর মধ্য দিয়ে জমে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমএলএসকে এই কাজ করতে হলে শুধু ইন্টার মায়ামির ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। অন্য ক্লাবগুলোকেও এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে শীর্ষ তারকাদের দলে ভিড়িয়ে আলোর ঝলকানিটা আরও বাড়িয়ে দিতে।
তবে লিগের লড়াইয়ে রোনালদোর লিগ এগিয়ে থাকলেও। মাঠের লড়াইয়ে কিন্তু আপাতত মেসিই এগিয়ে। প্রথম দফায় রোনালদো যেখানে মানিয়ে নিতে লড়েছেন, সেখানে মেসি শুরুই করেছেন গোলবন্যায়। এখন রোনালদোকেও এগিয়ে আসতে হবে এর জবাব নিয়ে। পারফরম্যান্সের জবাবটা পারফরম্যান্স দিয়েই দিতে হবে। কারণ, দ্বৈরথটা যেমন এমএলএস বনাম সৌদি লিগের তেমনি রোনালদো বনাম মেসিরও।