টাইলস উঠে ক্ষতবিক্ষত বরিশাল জেলা সুইমিংপুল। ২০০০ সালে উদ্বোধনের পর একবারের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি এটি
টাইলস উঠে ক্ষতবিক্ষত বরিশাল জেলা সুইমিংপুল। ২০০০ সালে উদ্বোধনের পর একবারের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি এটি

পুল আছে, সাঁতার নেই

জন্ম থেকেই ‘পরিত্যক্ত’ দুই পুল

রাজবাড়ী, ফেনী, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও চাঁদপুরের সুইমিংপুলের মতোই করুণ অবস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্মিত সারা দেশের বেশির ভাগ সুইমিংপুলের। ছবির পুলগুলোর মতোই কোথাও সাঁতার কাটার পানি নেই, কোথাও জমে আছে বৃষ্টির পানি। কোথাওবা পানিতে ভাসছে শেওলা। সারা দেশের সুইমিংপুলগুলোর দুরবস্থা নিয়েই আমাদের এই বিশেষ আয়োজন।

২০০০ সালের ১১ এপ্রিল উদ্বোধন এবং বলা যায় সেদিন থেকেই ‘পরিত্যক্ত’ বরিশাল জেলা সুইমিংপুল। পুলের চারপাশে আগাছার স্তূপ আর আবর্জনার ভাগাড়। আস্তানা গেড়েছে মাদকসেবীরা। পুলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশও চুরি হয়ে গেছে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। পানিবিহীন পুলের মেঝের টাইলস ফেটে চৌচির। পানির দুটি পাম্পই নষ্ট।

প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধি জসীম উদ্দিন জানিয়েছেন, বরিশাল স্টেডিয়ামের উত্তর পাশে চাঁদমারী এলাকায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই পুল নির্মাণেই ছিল বড় সমস্যা। স্টিলের পাতের বাক্স দিয়ে সুইমিংপুলের কূপ (বেসিন) ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি দেওয়া হয় কাঠের বাক্স দিয়ে।

বরিশাল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে বরিশাল বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ আলমগীর আলোও এমন পুল নিয়ে হতাশ, ‘এটা দুঃখজনক যে পুলটি তৈরির পর একদিনের জন্যও চালু হয়নি। ডিপ টিউবওয়েল নষ্ট। একসময় আমি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। চেষ্টা করেছি পুলটা চালু করতে। ফায়ার সার্ভিস থেকে পানি এনে দিয়েছি। কিন্তু পানি থাকে না। পুলটা এখন বিরাট বোঝা আমাদের জন্য।’

ফেনী জেলা সুইমিং পুল ২২ বছরে মাত্র একবার চালু হয়েছিল

বরিশাল সুইমিং পুলের ‘যমজ ভাই’ বলা যায় ফেনী জেলা সুইমিং পুলকে। এই পুল ২২ বছরে মাত্র একবার চালু হয়েছিল। নির্মাণত্রুটি, অযত্ন-অবহেলায় এখন পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথম আলোর ফেনী প্রতিনিধি আবু তাহের জানান, ফেনীর পুলের দেয়ালে ধরেছে ফাটল, ধসে পড়ছে পলেস্তারা। সেটাও এখন মাদকের আড্ডাস্থল। ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ফেনী শহরের দাউদপুর এলাকায় ২০০০ সালে তিন একর জায়গাজুড়ে নির্মিত পুলটি আট লেনের। ২০১৪ সালে স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক মাহবুবুল হকের (পেয়ারা) নামে এটির নামকরণ হয়।

ফেনী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, ‘জন্মের পর থেকে পুলটি ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র একবার। সম্ভবত ২০১২ সালে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু তখন পুলের পানি ঘোলা ছিল, ঘোলা পানিতে বাচ্চারা সাঁতার কাটলে সমস্যায় পড়বে, এমন অভিযোগ করেন অভিভাবকেরা। পাম্পটি ঠিক করার পর দেখা গেল, পুলে পানি থাকে না। তা ছাড়া বিদ্যুৎ বিলও আসে বেশি। যার কারণে পুল বন্ধ।’

পুল নেই আমলা ও নিকলীতেই

অযত্ন–অবহেলায় বেহাল চাঁদুপুর জেলা সংস্থার সুইমিং পুল

বাংলাদেশে সাঁতারু উঠে আসার বড় দুটি জায়গা কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা গ্রাম ও কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা। অথচ এ দুই জায়গাতেই নেই সুইমিংপুল। না থাকার একটা যুক্তি হতে পারে, পুল নির্মাণ করলে সেটা জেলা শহরের আট কিলোমিটারের মধ্যে করার একটা বাধ্যবাধকতা রয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের।

আমলা বা নিকলীর দূরত্ব জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটারের বেশি। তবু বিশেষ বিবেচনায় দেশের সাঁতারের দুটি তীর্থস্থানে সুইমিংপুল করা যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নিকলীর ছেলে কারার মিজান ১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসে সোনা জিতেছেন। পরে কারার ছামেদুল জিতেছেন রুপা। গত এসএ গেমসে রুপাজয়ী আরিফুল ইসলামও ওই এলাকার। আমলার পুকুরে সাঁতার কেটেই ২০০৪ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে সাঁতারে সোনা জেতেন রুবেল রানা। সেখানকার সাঁতারু মমতাজ শিরিন, সবুরা খাতুনরা শীর্ষ স্তরে দৃষ্টি কাড়েন। বর্তমানে আসিফ রেজা, জুয়েল আহমেদসহ জাতীয় পর্যায়ে সোনাজয়ী একঝাঁক সাঁতারুই আমলার।

নিকলী থেকে যেহেতু জাতীয় স্তরে পদকজয়ী অনেক সাঁতারু আসছে, তাই অবিলম্বে সেখানে একটি পুল চাই। এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেও আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি
এম বি সাইফ, বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক

৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে কুষ্টিয়ায় পুল চালু হলেও শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূর থেকে গিয়ে সেখানে অনুশীলন করতে পারেন না আমলার সাঁতারুরা। আমলার কোচ ও বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক আমিরুল ইসলামের হতাশ, ‘কুষ্টিয়ায় পুল হয়েছে ভালো কথা, কিন্তু আমলার ছেলেমেয়েদের কোনো কাজে আসেনি এই পুল। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা এত দূরে ভাড়া দিয়ে আসতে পারে না। তিন–চার মাস পরপর হয়তো গাড়ি ভাড়া করে সবাইকে একদিন নিয়ে যাই। পুল এমনভাবে করা উচিত, যাতে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।’ কুষ্টিয়া শহরে তবু একটা পুল হয়েছে, কিশোরগঞ্জে তো কোনো পুলই নেই! অথচ নিকলীর সাঁতারুদের একটা পুল খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এম বি সাইফের দাবি, ‘আমরা চাই, এমন জায়গায় সুইমিংপুল হবে, যেন সেটা সাঁতারুদের কাজে লাগে। নিকলী থেকে যেহেতু জাতীয় স্তরে পদকজয়ী অনেক সাঁতারু আসছে, তাই অবিলম্বে সেখানে একটি পুল চাই। এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেও আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।’