ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের ফুটবলাররা আনন্দে মাতোয়ারা। সেলফি উৎসবে মেতেছেন তাঁরা। কর্মকর্তারাও একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কমলাপুর স্টেডিয়ামে আজ সন্ধ্যায় দেখা গেল এই অভূতপূর্ব দৃশ্য। শেষ কবে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ফুটবল মাঠে এমন আনন্দ করেছে, মনে করা কঠিন। ক্লাবটির খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের এই আনন্দ প্রায় ২০ বছর পর দেশের শীর্ষ ফুটবলে ফিরে আসার।
পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের শেষ দিনে আজ কমলাপুর স্টেডিয়ামে বাফুফের এলিট একাডেমির বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল ওয়ান্ডারার্স। ম্যাচটা ড্র করলেই ১৪ ম্যাচে ২৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ারে উঠবে, এমনকি ২ গোলের ব্যবধানে হারলেও প্রথমবারের মতো পেশাদার লিগে খেলার সুযোগ পাবে—আজ এমন সমীকরণ নিয়েই খেলতে নামে দলটি। শেষ পর্যন্ত কমলাপুর স্টেডিয়ামের ঢিলেঢালা ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়েছে। আর তাতেই পূরণ হয়েছে ওয়ান্ডারার্সের স্বপ্ন।
চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ১৪ ম্যাচে ২৭ পয়েন্ট নিয়ে ফকিরেরপুল ইয়াংমেন্স ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে গতকালই। পেশাদার লিগে উঠে গেছে তারা। ২০১৬ সালেও চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পেশাদার লিগে উঠেছিল ক্লাবটি, কিন্তু আর্থিক সমস্যাকে কারণে দেখিয়ে খেলেনি। তবে এবার খেলবে বলে জানিয়েছেন ক্লাবের কর্মকর্তারা। আগামী পেশাদার লিগে উত্তরণ হচ্ছে নতুন দুটি ক্লাবের—ফকিরেরপুল ইয়াংমেন্স ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স।
১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ান্ডারার্স পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলে ছিল পরাশক্তি। সে সময় ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান ম্যাচ মানেই ছিল বাড়তি আকর্ষণ। ১৯৫৩ ও ’৫৪ সালে ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স। ১৯৫৫ সালের লিগেও দলটি এগিয়ে ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে সেবার লিগ শেষ হয়নি। পরের বছর ওয়ান্ডারার্সই চ্যাম্পিয়ন হয়। বন্যার কারণে ওই লিগ পরিত্যক্ত না হলে হয়তো টানা চার লিগ জেতা হতো ওয়ান্ডারার্সের।
স্বাধীনতার পর ক্লাবটি তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। দিনে দিনে চলে গেছে আড়ালে। দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কারণে সুযোগসন্ধানী সংগঠকেরা ক্লাবের নাম ভাঙিয়ে ফায়দা লুটেছেন। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো–কাণ্ডে জড়িত ছিল যে ছয়টি ক্লাব, তার মধ্যে ওয়ান্ডারার্স ও ফকিরেরপুল অন্যতম। দীর্ঘদিন দুটি ক্লাবই ছিল তালাবদ্ধ। সেই কলঙ্ক এক পাশে রেখে ক্লাব দুটি ফিরে এসেছে শীর্ষ ফুটবলে। ক্লাব দুটির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ ট্রফি।
ওয়ান্ডারার্সকে শীর্ষ ফুটবলে ফেরাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন কোচ আবু ইউসুফ। জাতীয় দলের সাবেক এই ডিফেন্ডার তাতে বেশ আবেগাপ্লুত। এ পর্যন্ত আসতে বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে কতটা লড়াই করতে হয়েছে, সেটাই বললেন প্রথমে, ‘ফুটবলে যে পরিবেশ, মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, পর্দার আড়ালের দলের সঙ্গেও লড়তে হয়। ফুটবলে প্রধান বাধা হলো এই পর্দার আড়ালের টিম। সেই টিমের পছন্দের খেলোয়াড় আছে, পছন্দের সিস্টেম আছে, কোচের এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগই থাকে না। এটা দুঃখজনক। ফুটবলের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো কিছুর সঙ্গে আমাকে আপস করানো যাবে না। আমি আপস করিনি। তাই এত দূর আসতে পেরেছি।’
একজন কোচের জীবনে এমন সুযোগ খুবই কম আসে। ওয়ান্ডারার্সের সঙ্গে থেকেই তাই লিগটা শেষ করেছেন বলে জানালেন ইউসুফ, ‘আমি শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে ছিলাম। পর্দার আড়ালে যা হয়, আমি এর প্রতিবাদ করি। যার জন্য দেখুন আমি আজ কোথায়? আমার তো এখানে থাকার কথা নয়!’
ওয়ান্ডারার্সের ফুটবল দলে একসময় খেলেছেন বঙ্গবন্ধুও। শেখ কামাল খেলেছেন ওয়ান্ডারার্সের বাস্কেটবল দলে। এমন একটি ক্লাব পথ হারিয়ে তাঁর হাত ধরে অন্তত শীর্ষ ফুটবলে ফিরতে পেরেছে। সেই অনুভূতি জানিয়ে আবু ইউসুফ বলেছেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে এই দলের কান্ডারি হিসেবে নিজেকে রাখতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু এই দলে খেলেছেন। সেটাকে কাজে লাগানো উচিত ক্লাবের।’
পেশাদার লিগে আগামী মৌসুমে ভালো দল গড়ার চেষ্টা করবেন, কমলাপুর স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে এমনটাই জানিয়েছেন ওয়ান্ডারার্সের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, ‘আমাদের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। মনে আছে, সর্বশেষ ২০০৩ সালে আমরা তৎকালীন ঢাকা প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ারে উঠে আসি। তারপর আবার ২০০৬ সালে নেমে যাই (২০০৫ সালে)। এখন আবার ফিরতে পেরে দারুণ লাগছে। আমাদের সভাপতি কাজী শহিদল্লাহ লিটনের ইচ্ছা ছিল দলটাকে পেশাদার লিগে আনতে। আমরা তাতে সফল হয়েছি।’