নতুন বছরে প্রত্যাশা

জামাল চান আরেক ধাপ ওপরে যেতে, সাফ শিরোপা ধরে রাখার আশা সাবিনার

ফুটবল, হকি, আর্চারি, গলফ, দাবা, ভারোত্তোলনের মতো খেলাগুলোর সেরা জামাল ভূঁইয়া, সাবিনা খাতুন, মোহাম্মদ আশরাফুল, রোমান সানা, সিদ্দিকুর রহমান, ফাহাদ রহমান, মাবিয়া আক্তাররা নিজেদের ছাপিয়ে যেতে চান ২০২৪ সালে।

ক্রিকেট এক পাশে রাখলে অন্য খেলাগুলোর বড় এক পৃথিবীই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। সেই পৃথিবী খেলার আলোয় ভরে উঠুক নতুন বছরে। জন্ম হোক নতুন তারকার। এ প্রত্যাশার কথা জানিয়ে ফুটবল, হকি, আর্চারি, গলফ, দাবা, ভারোত্তোলনের মতো খেলাগুলোর সেরা খেলোয়াড়েরা নিজেদের ছাপিয়ে যেতে চান ২০২৪ সালে। দলগতভাবে আরেকটু ভালো করার প্রত্যয় সবারই। তবে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই নিজের সেরাটা মাঠে দিতে পারলেই খুশি।

বিদায়ী বছরটা দেশের ফুটবলে কিছুটা সুবাতাস ছড়িয়েছে। ১৪ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে খেলেছে জাতীয় দল। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম রাউন্ডে মালদ্বীপকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছেন জামাল ভূঁইয়ারা। আফগানিস্তান ও লেবাননের সঙ্গে ড্র করেছে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে ছয় ম্যাচের তিনটি গত বছর খেলেছেন জামাল ভূঁইয়ারা। বাকি তিনটি খেলবেন নতুন বছরের মার্চ আর জুনে। গত বছরের ভালো খেলার ধারাবাহিকতা ধরে রাখাই নতুন বছরে জাতীয় দলের ফুটবলারদের বড় চাওয়া।

বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া
এ বছর আমরা আরেক ধাপ ওপরে যেতে চাই। উন্নতি করতে চাই নিজেদের অবস্থানের।
জামাল ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক

জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া দেশের বাইরে। আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিভাগের দলে আপাতত তাঁর খেলাও নেই। ফুরফুরে মেজাজে আছেন। ইউরোপ থেকে প্রথম আলোর মাধ্যমে সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর কণ্ঠে তৃপ্তি ঝরেছে ২০২৩ নিয়ে, ‘২০২৩ আমরা উপভোগ করেছি। আমি মনে করি, বিদায়ী বছরে আমরা ভালো খেলেছি। শক্তিশালী দলের সঙ্গে লড়াই করেছি। কিছু হতাশা থাকলেও অনেক ইতিবাচক দিক আছে।’

২০২৪ সালে নিজেদের কাছে কী চাওয়া? চাওয়াটা আসলে ফিফার তালিকায় ১৮৩ থেকে একটু এগোনো। সে পথে ২০২৪  আরও ভালো কাটবে আশাবাদ জানিয়ে নতুন লক্ষ্যও দাঁড় করিয়েছেন জামাল, ‘এ বছর আমরা আরেক ধাপ ওপরে যেতে চাই। উন্নতি করতে চাই নিজেদের অবস্থানের।’

তবে ঘরোয়া ফুটবলে ঢাকার বাইরে নিয়মিত খেলা নেই। ঢাকার নিচের দিকের লিগগুলোও অনিয়মিত। বয়সভিত্তিক ফুটবল নেই। অথচ কে না জানে, বয়সভিত্তিক ফুটবলে জোর দেওয়াই দেশের রুগ্‌ণ ফুটবলের মুক্তির পথ। বাংলাদেশের শীর্ষ ক্লাবগুলো বছরে একটা লিগ খেলেই দায় সারে। তাদের কোনো লক্ষ্য নেই। ফলে দেশীয় ফুটবল কাঠামোয় উন্নতি না এলে লক্ষ্য পূরণ কঠিনই। নড়বড়ে ঘরোয়া কাঠামোয় খেলে জাতীয় দল উন্নতি করতে পারে না, তা ভালোই জানেন জামাল।

জানেন সাবিনা খাতুনও। মেয়েদের ফুটবলে ২০২৩ সালটা মিশ্র কেটেছে। আগের বছর যেখানে নেপালকে তাদেরই মাঠে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ জেতে বাংলাদেশ, সেখানে ২০২৩ সালে নেপালের সঙ্গে তিন ম্যাচই ড্র। সেটা মাথায় রেখেও বিদায়ী বছর নিয়ে অখুশি নন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা। বছরের শেষটা ভালো কাটার তৃপ্তি নিয়ে বলেছেন, ‘বছরের শেষ দিকে আমরা সিঙ্গাপুরকে দুই ম্যাচে ভালোভভাবে হারিয়েছি। বছরটা ভালোভাবে শেষ হয়েছে।’

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন
নতুন বছরের অক্টোবরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, সাফ মাথায় রেখেই এগোতে হবে। সাফের শিরোপা ধরে রাখতে চাইব নতুন বছরে। আর চাইব, এ বছর যেন আরও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারি। সাফের ভালো প্রস্তুতির জন্য প্রীতি ম্যাচের বিকল্প নেই। আরেকটা চাওয়াও আছে—মেয়েদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট যেন বাড়ে।
সাবিনা খাতুন, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক

নতুন বছরে সাবিনার প্রত্যাশা, ‘নতুন বছরের অক্টোবরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, সাফ মাথায় রেখেই এগোতে হবে। সাফের শিরোপা ধরে রাখতে চাইব নতুন বছরে। আর চাইব, এ বছর যেন আরও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারি। সাফের ভালো প্রস্তুতির জন্য প্রীতি ম্যাচের বিকল্প নেই। আরেকটা চাওয়াও আছে—মেয়েদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট যেন বাড়ে।’

মেয়েদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বলতে শুধু লিগ। কিন্তু সেটাও অনিয়মিত। বিদায়ী বছরে মেয়েদের লিগ হয়নি। নতুন বছরের ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা। কিন্তু সময়মতো হবে কি না, সংশয় আছে। মেয়েদের লিগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস এবার খেলছে না। ফলে লিগ আকর্ষণ হারাতে চলেছে। মেয়েদের জন্য ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আবরের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচের কথাবার্তা এগিয়েছিল, কিন্তু সৌদি আরব আপাতত খেলবে না ‘শক্তিশালী’ বাংলাদেশের সঙ্গে। বিকল্প হিসেবে কোন দলের সঙ্গে কবে ম্যাচ খেলবে, বাফুফে এখনো তা ঠিক করে উঠতে পারেনি।

সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন নতুন বছরে কী করতে চায়, তা নিয়ে তাদের নেই কোনো পরিকল্পনা। তবে কোনো হকি খেলোয়াড়ের কাছে নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে জানতে চাইলে প্রথমেই তিনি বলবেন খেলাটা যেন মাঠে থাকে। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এটাই তাঁদের মূল চাওয়া নতুন বছরে। ২০২৪ সালও এর ব্যতিক্রম নয়।

জাতীয় দলের ডিফেন্ডার মোহাম্মদ আশরাফুল যেমন বললেন, ‘গত বছর আমরা শুধু এশিয়ান গেমস খেলেছি। এর বাইরে ঘরোয়া কোনো খেলা হয়নি। নতুন বছরে সবকিছুর আগে চাইব, ঘরোয়া হকি যেন মাঠে গড়ায়। খেলাটা মাঠে থাকলেই আমরা খুশি।’

গলফার সিদ্দিকুর রহমান
২০২৩ ভালো কাটেনি আমার। টুর্নামেন্ট খেলে অর্থ পাওয়ার দিকটা আগের বছরের মতো থাকলেও র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে গেছি। নতুন বছরে চাইব, র‍্যাঙ্কিংয় যেন আবার ওপরের দিকে উঠে আসতে পারি।
সিদ্দিকুর রহমান, গলফার

ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন খেলার শীর্ষ খেলোয়াড়েরা নতুনভাবে শুরু করতে চান বছরটা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাধিক সোনা জেতা আর্চার রোমান সানার জন্য বিদায়ী বছরটা ভালো কাটেনি। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ কয়েক মাস নিষিদ্ধ থাকতে হয়েছে। তির-ধনুক হাতেও নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। নতুন বছরে জ্বলে উঠতে চান আবার, ‘২০২৩ সালে যে টুর্নামেন্টগুলো খেলতে পারিনি, নতুন বছরে সেসব খেলতে চাই। বিদায়ী বছরে যে ভুলগুলো করেছিলাম, সেসব শুধরে বছরটাকে স্মরণীয় করার স্বপ্ন দেখি। নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে অন্য এক রোমান সানা হিসেবে আমাকে তুলে ধরতে চাই। ২০২৪ সালে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে চাই।’

ট্যুর কার্ড মিস করায় নতুন বছরে এশিয়ান ট্যুরের সব টুর্নামেন্ট খেলতে পারবেন না গলফার সিদ্দিকুর রহমান। র‍্যাঙ্কিংয়ে ৬০–এর মধ্যে নেই তিনি, ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে অবস্থান ৮৩-তে আছেন। সেটা মনে রেখেই বলছেন, ‘২০২৩ ভালো কাটেনি আমার। টুর্নামেন্ট খেলে অর্থ পাওয়ার দিকটা আগের বছরের মতো থাকলেও র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে গেছি। নতুন বছরে চাইব, র‍্যাঙ্কিংয় যেন আবার ওপরের দিকে উঠে আসতে পারি।’

ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারেরও ২০২৩ সালটা ভালো যায়নি। চোটের সমস্যার সঙ্গে অসুস্থতাও তাঁকে ভুগিয়েছে। নতুন বছরটা চান পুরো ফিট থেকে খেলে যেতে, ‘২৩ সালে ভালো পারফরম্যান্স হয়নি। ২০২৪ সাল যেন ভালো কাটে, নিজের কাছে নিজের চাওয়া এটাই। ২০২৪ সালে অলিম্পিক গেমস আছে প্যারিসে। আমরা যেন কোয়ালিফাই করে অলিম্পিকে যেতে পারি, ওয়াইল্ড কার্ড যেন না লাগে। একটা মানসম্মত জায়গায় যেন আমরা আসতে পারি, সে প্রত্যাশাই থাকবে।’

দেশের ঘুণে ধরা ক্রীড়াকাঠামোয় বদলের আকাঙ্ক্ষা রাখছেন এসএ গেমসে দুটি সোনাজয়ী মাবিয়া। খেলা নিয়ে গঠনমূলক পরিকল্পনা চান। প্রশিক্ষণকে যেন সারা বছর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যে খেলাগুলোয় ভালো ফল আসে, সেগুলোকে যেন পরিকল্পনা করে অনুশীলনে রাখা হয় বছরজুড়ে। এটুকুই মাবিয়ার চাওয়া নতুন বছরে।

দাবাড়ু ফাহাদ রহমান
সামগ্রিকভাবে চাওয়া হলো, যেন বিদেশে খেলতে পারি। একটা স্পনসর হলে ভালো। চাই দাবায় যেন আরও বেশি টুর্নামেন্ট হয়। গত দুই বছর টুর্নামেন্ট সেভাবে হয়নি। আশা করি, নতুন কমিটি এসে দাবাকে জাগিয়ে তুলবে। টুর্নামেন্ট হচ্ছে না বলে সবাই অনুশীলনের বাইরে। অলিম্পিয়াড হবে নতুন বছরে, অলিম্পিয়াডের আগে যেন বিদেশি কোচ পাই।
ফাহাদ রহমান, দাবাড়ু

২০২৩ সালে চার-পাঁচবার গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মের কাছাকাছি গিয়েও পারেননি ফাহাদ রহমান। স্বাভাবিকভাবেই নতুন বছরে নর্ম করার লক্ষ্য থাকবে তাঁর। সম্ভব হলে এ বছরই গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবটা পেতে চান এই আন্তর্জাতিক মাস্টার। এটিকেই মূল লক্ষ্য বানিয়ে ২০ বছরের তরুণ তাকিয়ে আছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের দিকেও, যেখানে তিনি ৫ বার খেলে ২ বার রানারআপ হয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি।

সেই অধরা শিরোপাও জিততে চান নতুন বছরে, ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হতে চাইব এ বছর।’ সঙ্গে আরও কিছু চাওয়াও যোগ করেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে চাওয়া হলো, যেন বিদেশে খেলতে পারি। একটা স্পনসর হলে ভালো। চাই দাবায় যেন আরও বেশি টুর্নামেন্ট হয়। গত দুই বছর টুর্নামেন্ট সেভাবে হয়নি। আশা করি, নতুন কমিটি এসে দাবাকে জাগিয়ে তুলবে। টুর্নামেন্ট হচ্ছে না বলে সবাই অনুশীলনের বাইরে। অলিম্পিয়াড হবে নতুন বছরে, অলিম্পিয়াডের আগে যেন বিদেশি কোচ পাই।’

বছর শেষে মেলানো যাবে খেলোয়াড়দের চাওয়া কতটা পূরণ হয়েছে। তার আগে নতুন বছরে নতুন আশাতেই থাকবে গোটা ক্রীড়াঙ্গন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি বলছে, গতানুগতিক ধারার বাইরে ক্রীড়াঙ্গনে বিরাট কিছু বদল হবে, সে আশা না করাই ভালো নতুন বছরে।