চারে চার হয়েছে আগেই। এবার হলো তিনে তিন। চারে চার মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা চারটি ওয়ানডে সিরিজ জয়। আর তিনে তিন—এক ম্যাচ বাকি থাকতে সিরিজ জয় নিশ্চিত করে ফেলার পর শনিবার সিরিজের শেষ ওয়ানডেটাও জিতে নিয়ে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাইয়ের তিক্ত স্বাদে ডুবিয়ে দেওয়া।
টেস্ট এবং টি–টোয়েন্টি সিরিজ হারের জ্বালা জুড়াতে ওয়ানডে সিরিজের দাপুটে জয় কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। এখন তো আর অন্তত একেবারে খালি হাতে দেশে ফিরতে হচ্ছে না। প্রথম দুই ওয়ানডে জয়ের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাসুম আহমেদের পর শেষ ওয়ানডেটাও বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জিতেছে একজন স্পিনারের হাত ধরেই।
ডাগআউটে বসে থাকতে থাকতে খেলার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলেন তাইজুল ইসলাম। সেটিই হয়তো ক্যারিয়ারের দশম ওয়ানডেতে এসে তাঁকে উপহার দিয়েছে প্রথম ৫ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসও সে কারণেই যেতে পারেনি বেশি দূর। নিকোলাস পুরানের দল অবশ্য এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারে যে হারলেও শেষ ম্যাচে এসে তো সিরিজে নিজেদের সর্বোচ্চ রানটা অন্তত করা গেল। সেটিও অবশ্য সম্ভব হয়েছে পুরানের ১০৯ বলে ৭৩ রানের ইনিংসের সৌজন্যে। বাকিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৩ রান ক্যারিয়ারের চতুর্থ ওয়ানডে খেলা কিসি কার্টির।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে দলের সঙ্গে থাকলেও খেলার সুযোগ এ ম্যাচেই প্রথম পেয়েছেন অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল। সফরের শেষ ম্যাচে এসে পাওয়া সুযোগটা তিনি এতটাই দারুণভাবে কাজে লাগালেন যে, অধিনায়ক তামিম ইকবাল আর কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলতেই পারেন, তাদের বেঞ্চের শক্তি দেখার পরিকল্পনা বেশ কাজে লেগেছে। যদিও ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচটাও ডাগআউটে বসেই কেটেছে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের পারফরম্যান্স দিয়ে আট বছর পর জাতীয় দলে ফেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান এনামুল হকের।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অভিষেক ওয়ানডেতে ১১ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন তাইজুল। এতদিন এটাই ছিল ওয়ানডেতে তাঁর সেরা বোলিং। প্রভিডেন্সের উইকেটে তো স্পিনারদের জন্য সাহায্য ছিলই, ডাগআউটে বসে থেকে থেকে তাইজুলের মধ্যেও নিশ্চিত বেড়ে গিয়েছিল উইকেট পাওয়ার তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণা তিনি মেটাতে শুরু করেন ইনিংসের তৃতীয় ওভারে বোলিং করতে এসে নিজের প্রথম বল থেকেই। একটু ঝুলিয়ে দেওয়া প্রথম বলটা উইকেটে পড়েই মৃদু বাঁক খেয়ে আঘাত করে ওপেনার ব্রেন্ডন কিংয়ের অফ স্টাম্পে।
নতুন ব্যাটসম্যান শামার ব্রুকস ওই ওভারেই বাউন্ডারি মেরেছেন তাইজুলকে। তাতে কি! মাঝে মোস্তাফিজের ওভারটা যাওয়ার পর আবারো উইকেট পাওয়ার উল্লাসে মেতেছেন তিনি, শিকার এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেক ওপেনার শাই হোপ। কাভারের দিকে খেলতে গিয়ে একটু বেরিয়ে আসা হোপও পরাস্ত তাইজুলের বাঁকের কাছে। উইকেটকিপার নুরুল হাসান স্টাম্প ভেঙে দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গেই। পরের ওভারে ব্রুকসকে এলবিডব্লু করে স্বাগতিকদের ওপর চাপটা আরো বাড়িয়ে দেন বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান।
১৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে এ ম্যাচেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ের শুরুটা হয়েছে লেজেগোবরে দশা দিয়ে। পার্থক্য শুধু, এবার একটু লড়াইয়ের চেষ্টা করলেন অধিনায়ক পুরান। ১০৯ বলে ৭৩ রানের ইনিংসে চতুর্থ উইকেটে কার্টির সঙ্গে ৬৭ এবং পঞ্চম উইকেটে রোভম্যান পাওয়েলের সঙ্গে গড়েছেন ৩৪ রানের জুটি।
দলকে ১৫০ রানে রেখে অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে পুরানও শেষ পর্যন্ত ফিরেছেন তাইজুলের বাঁকে বিভ্রান্ত হয়ে। ক্যারিবীয় অধিনায়ককে বোল্ড করার পর শূন্য লাফিয়ে ওঠা তাইজুলের মুষ্ঠি ছুঁড়ে করা উল্লাসটা ছিল দেখার মতো। সুযোগ কাজে লাগানোর উল্লাস, নিজেকে আরেকবার চেনানোর উল্লাস, ওয়ানডেতে প্রথম ৫ উইকেট পাওয়ার উল্লাসও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস ততক্ষণে শেষের অপেক্ষায়। তাইজুলের সঙ্গে আরেক বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আর বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজ মিলে যে আগেই ভেঙে দিয়েছেন তাদের মিডল অর্ডার!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের সময়ই বোঝা যাচ্ছিল প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের স্পিন উইকেটে এই রান করতেও সাবধানী ব্যাটিং করতে হবে বাংলাদেশকে। দলের ২০ রানের সময় ফিরে যান ওপেনার নাজমুল হোসেন, দ্বিতীয় উইকেটে লিটন দাসের সঙ্গে ৫০ রানের জুটির পর দলকে ৭০ রানে রেখে তামিমও ফাইন লেগে ক্যাচ দেন বাঁহাতি স্পিনার গুড়াকেশ মোতিকে সুইপ খেলতে গিয়ে। ২৫তম ওভারে তো মোতির এক ওভারে ফিরে যান ৬৫ বলে ৫০ করা লিটন ও আফিফ হোসেন দুজনই।
৯৬ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে এরপর জয়ের পথ দেখাচ্ছিলেন অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু প্রথম ওয়ানডের মতো ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে আসতে পারেননি তিনি। ২৬ রান করে পুরানের বলে মাহমুদউল্লাহর স্টাস্পড হয়ে যাওয়ার পর উইকেটে থাকা নুরুল হাসানের সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজের সপ্তম উইকেট জুটিই ভরসা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের। এ দুজনের একজন আউট হয়ে গেলেই লেজের দেখা পেয়ে যেত ইনিংস। বাকি দূরত্বটুকু পাড়ি দেওয়াও তখন কঠিন হতে পারতো। কিন্তু নুরুল–মিরাজ সেই বিপদে পড়তে দেননি দলকে। ৩২ রানের জুটিতে অবিচ্ছিন্ন থেকে তারাই শেষ করে এসেছেন ম্যাচটা।
বাংলাদেশের বোলিংয়ের সময় থেকেই প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ভুভুজেলা বেজেছে। সেটা বাজিয়েছেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খেলা দেখতে আসা স্থানীয় দর্শকেরাই। তাইজুলের স্পিন–নৃত্যের সে আবহ সঙ্গীত ছিল পুরো ম্যাচ জুড়েই। আসলে এটাই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট। হার–জিত যাই হোক উৎসব থামবে না। আর ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে সেটি যেন উৎসর্গকৃত হয়ে থাকল বাংলাদেশের জন্য।
এক দিকে স্পিন সহায়ক উইকেট, অন্যদিকে গ্যালারির বাদ্য–বাজনা। প্রভিডেন্স নয়, বাংলাদেশ যেন খেলল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই!