প্রদর্শনীতে ছবি দেখতে দেখতে বিমূর্ত কোনো পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে যাওয়া কিংবা ধ্রুপদি কোনো চলচ্চিত্রের বিশেষ কোনো দৃশ্য বারবার টেনে টেনে দেখা, টেনিসে এমন অপার্থিব আনন্দ মানেই রজার ফেদেরার। পেইন্টিং, কবিতা কিংবা চলচ্চিত্রের রস আস্বাদনের মতোই আনন্দ-উপহার নিয়ে ২৪ বছর ধরে টেনিস কোর্টকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন ফেদেরার। ‘কিং রজার’ যেন টেনিস কোর্টের মহৎ কোনো কবিতা, কালজয়ী কোনো পেইন্টিং।
টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কিংবা ভ্যান গঘের ‘দ্য স্টারি নাইট’–এর মতো সৃষ্টিকর্মের সঙ্গেই কেবল তুলনা হতে পারে ফেদেরারের খেলার। তাঁর প্রতিটি শট যেন একেকটি তুলির আঁচড়। তবে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে চলা মহাকাব্যিক এ প্রদর্শনী আজ শেষ হতে যাচ্ছে। আসলেই কি শেষ হচ্ছে? এত বছর পরও ফিওদর দস্তয়েভস্কির অমর সৃষ্টি অপরাধ ও শাস্তি কিংবা তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তির কাছে আমরা বারবার ফিরে আসি, তেমনই টেনিসে সৃষ্টিশীলতার অপার আনন্দটুকু পেতে হলে আমাদের বারবার ফিরতে হবে ফেদেরারের কাছে। ভবিষ্যতে টেনিসে কেউ তারকা হওয়ার স্বপ্ন দেখলে তাঁকেও হাত পাততে হবে ফেদেরারের কাছেই।
লেভার কাপে আজ একটি ম্যাচ খেলেই বিদায় জানিয়ে দেবেন ফেদেরার। লন্ডনের ওটু অ্যারেনার হার্ড কোর্টে শেষবারের মতো দেখা যাবে তাঁকে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত ‘শঙ্খমালা’ কবিতার সেই লাইনের মতো এখন চাইলে বলাই যায়, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ হ্যাঁ আজকের পর আর পাওয়া যাবে না তাঁকে। তবে লেভার কাপে শেষবারের মতো যে মুহূর্তের জন্ম হতে যাচ্ছে, এমন কিছু সত্যিই আর দেখা যাবে না টেনিসে। দ্বৈতের ম্যাচে আজ ফেদেরার জুটি বাঁধবেন রাফায়েল নাদালের সঙ্গে।
আগামীকাল (আজ) পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলব। দ্বৈত ম্যাচটিতে রাফায়েল নাদালকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমি সম্মানিতরজার ফেদেরার
টেনিসের মঞ্চে ফেদেরার যদি হন ধ্রুপদের শেষ কথা, নাদাল সেখানে অনবদ্য রক অ্যান্ড রোল। ফেদেরার যদি হন রবিশংকরের সেতারের তার থেকে বেরিয়ে আসা আহির ভৈরব, নাদাল সেখানে ড্রিম থিয়েটারের জন পেট্রুসির উন্মাতাল গিটারের সুর। অসংখ্যবার মুখোমুখি লড়াইয়ে অনবদ্য সব মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন এই দুজন। ৯টি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালসহ ক্যারিয়ারে ৪০ বার মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। ফেদেরারের শেষ ম্যাচে হাতে হাত ধরেই এবার লড়বেন দুজন। আর ফেদেরার-নাদালের এই মেলবন্ধন টেনিসপ্রেমীদের জন্য অনবদ্য এক পাওয়া। এই আনন্দধারায় আপনি নিশ্চয় স্বাগত জানাতে পারেন নিজেকেও।
নাদালের সঙ্গে জুটি বেঁধে ক্যারিয়ারের ইতি টানতে যাওয়ার খবরটা ফেদেরার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল নিজেই দিয়েছেন, ‘আগামীকাল পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলব। দ্বৈত ম্যাচটিতে রাফায়েল নাদালকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমি সম্মানিত।’ ফেদেরারের পোস্টটাকে পরে রিটুইট করে স্প্যানিশ তারকা নাদাল লিখেছেন, এটা তাঁর জন্যও সম্মানের।
কখন বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় শুরু অ্যান্ডি মারে অ্যালেক্স দি মিনাউরের ‘বেস্ট অব থ্রি’ একক ম্যাচ শেষেই কোর্টে নামবেন ফেদেরার-নাদাল।
পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও নিজের শেষ ম্যাচ ও নাদালকে নিয়ে কথা বলেছেন ফেদেরার, ‘একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে, লম্বা সময় ধরে আমরা একসঙ্গে লড়েছি। ক্যারিয়ারে একে অপরের বিপক্ষে লড়েও আমাদের সম্পর্ক দারুণ। আমি মনে করি, এটা কেবল টেনিসের জন্যই নয়, অন্য খেলাগুলোর জন্যও একটি দারুণ বার্তা। এ জন্য আমি মনে করি, এটা দারুণ হবে। এটা অবশ্যই বিশেষ একটি মুহূর্ত হতে যাচ্ছে।’
এই ম্যাচে ইউরোপের ফেদেরার-নাদালের প্রতিপক্ষ অবশিষ্ট বিশ্বের দুই মার্কিন খেলোয়াড় জ্যাক সক ও ফ্রান্সিস টিয়াফো। টেনিসকে বিদায় বললেও এই খেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন না বলেও বিদায়বেলায় জানিয়েছেন ফেদেরার। বলেছেন, ‘আমি ভক্তদের বলতে চাই, আমি এখান থেকে হারিয়ে যাব না।’
বিদায়বেলায় ফেদেরার-নাদাল ম্যাচ নিয়ে উত্তাপের মধ্যেই ‘ফেড এক্সপ্রেস’কে নিয়ে কথা বলেছেন আরেক মহাতারকা জোকোভিচ। বলেছেন, ‘যেকোনো খেলা বিবেচনায় ফেদেরার অন্যতম সেরা তারকাদের একজন।’
বলা হয়, তিন নাকি শক্তিমান এক সংখ্যা। অন্তত টেনিসের জন্য তো বটেই। সেই তিনের শক্তিতেই টেনিসকে একসঙ্গে শাসন করেছেন ফেদেরার-নাদাল-জোকোভিচ। সেই তিনের প্রথমজন আজ বিদায় নিচ্ছেন। যে বিদায় আর্দ্র করবে টেনিস–দেবতার চোখও।