উইম্বলডনের এই ট্রফিটায় এ পর্যন্ত সাতবার চুমু খেয়েছেন নোভাক জোকোভিচ
উইম্বলডনের এই ট্রফিটায় এ পর্যন্ত সাতবার চুমু খেয়েছেন নোভাক জোকোভিচ

উইম্বলডন

আত্মধ্বংসী কিরিওসকে হারিয়ে ফেদেরারকে ছাড়িয়ে গেলেন জোকোভিচ

রজার ফেদেরারকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই ২১তম গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপাটা আসতে পারত গত জানুয়ারিতেই। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে নয়বারের চ্যাম্পিয়ন নোভাক জোকোভিচ সেই স্বপ্ন নিয়েই এসেছিলেন মেলবোর্নে। তারপর কী হয়েছে, তা মনে হয় সবারই জানা। কোভিড নাইনটিনের টিকা না নেওয়ায় ভিসা পাননি। আদালতে গড়ানো সেই বিতর্ক ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল নয়বারের চ্যাম্পিয়নকে।

সার্বিয়ায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে দেখেছেন, রাফায়েল নাদাল অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ছাড়িয়ে গেছেন রজার ফেদেরারকে। বছরের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লাম ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছেন নাদালের কাছে। পরে ক্লে কোর্টের রাজাকে দেখেছেন ২২তম গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জিততে।

অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ হলো জোকোভিচের। উইম্বলডনে এলো বহু প্রার্থিত সেই ২১তম শিরোপা। সেমিফাইনালে ক্যামেরন নরির কাছে প্রথম সেটে হারার পরও জিতেছিলেন চার সেটে। ফাইনালেও একই গল্প। অস্ট্রেলিয়ার নিক কিরিওসের বিপক্ষে প্রথম সেটটা হেরেছিলেন ৪–৬ গেমে। পরের দুই সেট জিতলেন ৬–৩, ৬–৪ গেমে। টাইব্রেকারে গড়ানো চতুর্থ সেটে ৭–৬ (৭/৩) গেমে জিতে উইম্বলডনে টানা চতুর্থ শিরোপায় ছাড়িয়ে গেলেন ফেদেরারকে।

জয়ের আনন্দে...

ফাইনালে উঠেই ভেঙেছেন ফেদেরারের একটি রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলার রেকর্ড। জোকোভিচের ৩২তম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল, কিরিওসের প্রথম। অভিজ্ঞতার এই বিশাল পার্থক্যের কারণে ফাইনালে অবধারিত ফেবারিট ছিলেন জোকোভিচ। সঙ্গে যোগ হয়েছিল উইম্বলডনে অসাধারণ রেকর্ডও। ফাইনালের আগে অল ইংল্যান্ড ক্লাবে টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত এই সার্বিয়ান, সর্বশেষ তিনবারের চ্যাম্পিয়নও।

কিরিওসের পক্ষে কিছু থেকে থাকলে তা জোকোভিচের বিপক্ষে আগের দুই ম্যাচ। গ্র্যান্ড স্লামে এর আগে কখনো দেখা হয়নি দুজনের। এর বাইরে যে দুটি ম্যাচ খেলেছেন, দুটিই ২০১৭ সালে। হার্ড কোর্টে তিন সেটের ম্যাচ দুটিতেই সরাসরি জিতেছিলেন কিরিওস। ওই দুই ম্যাচে একবারও কিরিওসের সার্ভিস ব্রেক করতে পারেননি জোকোভিচ। সঙ্গে কিরিওসের প্রশ্নাতীত প্রতিভা এবং অবিশ্বাস্য সব শট খেলার ক্ষমতা মিলিয়ে ফাইনালটা নিয়ে যথেষ্টই রোমাঞ্চ ছিল।

সেই রোমাঞ্চের আশা একেবারেই যে মেটেনি, তা বলা যাচ্ছে না। কিরিওস যথারীতি কিরিওসের মতোই খেলেছেন। চাবুকের মতো ফোরহ্যান্ড, এর সঙ্গে ছিল কিরিওস স্পেশালও। নেটের দিকে পেছন ফিরে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে শট...যা বেশির ভাগ সময়ই নেট পেরোল। একবার তো হতচকিত হয়ে সহজ ভলিও মিস করলেন জোকোভিচ। প্রথম সেটের দ্বিতীয় গেমেই আন্ডারআর্ম সার্ভিস করেও জোকোভিচকে চমকে দিতে চাইলেন। যদিও চমকটা ভালোই সামলেছেন জোকোভিচ।

এখন তাঁরা বন্ধু: ফাইনাল শেষে নিক কিরিওসের সঙ্গে নোভাক জোকোভিচ

এসব যদি কিরিওসের ব্যতিক্রমী টেনিস প্রতিভার প্রমাণ হয়, তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দেখা দিতেও বেশি সময় লাগল না। নিজের মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কোনোকালেই ছিল না। তাঁর প্রতিভাকে পারফরম্যান্সে রূপান্তর না করতে পারার বড় কারণও হয়তো এটিই। এই উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালেই স্তেফানোস সিৎসিপাসের বিপক্ষে ম্যাচটি তো উইম্বলডন ইতিহাসেই কুখ্যাত হয়ে গেছে কিরিওসের বিরামহীন চিৎকার–চেঁচামেচির কারণে। ফাইনালটিও কিরিওসের সেই আত্মধ্বংসী প্রবণতার সাক্ষী। নানা কিছু নিয়ে আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ করেছেন। গ্যালারিতে নিজের বক্সের দিকে তাকিয়ে একের পর এক অনুযোগও।

অন্য পাশে জোকোভিচ ছিলেন একেবারেই নিরাবেগ। এক–দুবারের বেশি নিজের আনন্দ–হতাশা প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি তাঁকে। আনন্দ যা প্রকাশ করলেন, তা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর। প্রথমে রিস্ট ব্যান্ড দুটি খুলে ছুড়ে দিলেন গ্যালারিতে। পরে কোর্টে শুয়ে দুই পাশে মেলে ধরলেন দুই হাত। দর্শকের অভিবাদনের জবাব দেওয়ার পর চেয়ারে বসে বেশ কিছুক্ষণ তোয়ালেতে ঢেকে রাখলেন মুখ। আনন্দাশ্রু গোপন করতেই কি? হয়তো বা তা–ই। বক্সে বসে থাকা বাবা–মা, স্ত্রীর দিকে ছুটে গেলেন এরপর।

দুই ফাইনালিস্টের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না অতীতে। কাদা–ছোড়াছুড়িও কম হয়নি। ফাইনালের আগেই তা মিটিয়ে নিয়েছিলেন দুজন। ট্রফি হাতে নিয়ে জোকোভিচ তাই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেন কিরিওসকে। তা করতে করতে দুষ্টুমির হাসি মুখে এটাও বললেন, দুজনের যে সম্পর্ক ছিল, তাতে কিরিওস সম্পর্কে এত ভালো ভালো কথা বলবেন, তা কখনো কল্পনাও করেননি।

অবশেষে...

উইম্বলডনে জয়রথ নিয়ে বলতে গিয়ে ফিরে গেলেন শৈশবে। সেই স্মৃতিচারণাটা মন ছুঁয়ে গেল সবার। সার্বিয়ার ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রামে জোকোভিচের বাবার একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। জোকোভিচ যখন সাড়ে চার–পাঁচ বছরের বালক, তখন ১৯৯২ সালে টিভিতে পিট সাম্প্রাসকে উইম্বলডনে প্রথম শিরোপা জিততে দেখার পরই টেনিসের রং লেগেছিল তাঁর মনে। বাবা–মা প্রথম র‍্যাকেট কিনে দিয়েছিলেন তাঁকে। সেদিন থেকেই জোকোভিচের দুচোখে উইম্বলডনের স্বপ্ন।

এই দিনে গল্পটা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে গেল আরেকটা কারণে। উইম্বলডনে সপ্তম শিরোপা জিতে পিট সাম্প্রাসকে যে ছুঁয়ে ফেললেন জোকোভিচ। এই দুজনের অবশ্য সঙ্গী আছেন আরেকজন। উনিশ শতকের শেষ দিকে উইলিয়াম রেন শ–ও সাতবার জিতেছিলেন ঘাসের কোর্টের বিখ্যাত এই টুর্নামেন্ট। সাম্প্রাসের কথা তো নিজেই বললেন, রেন শর কথাও ফাইনালের আগে হয়তো কেউ বলে থাকবেন জোকোভিচকে। না বলে থাকলেও এতক্ষণে নিশ্চয়ই তা জেনে গেছেন জোকোভিচ।