ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবকে শীর্ষ স্তরে তুলতে বড় অবদান রেখেছেন রাফায়েল টুডু
ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবকে শীর্ষ স্তরে তুলতে বড় অবদান রেখেছেন রাফায়েল টুডু

গোলকিপার থেকে স্ট্রাইকার হয়ে রাফায়েলের গোল–উৎসব

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গ্রাম আমতলী। বেশির ভাগ মানুষেরই পেশা কৃষিকাজ। তবে নিজেদের জমিতে নয়, ভূস্বামীদের জমিতে বর্গা খেটেই পেট চলে তাঁদের। এমন একটা সমাজের কোনো কিশোর ফুটবল খেলবে, ব্যাপারটা একটু বিলাসিতাই।

কিন্তু মানিক টুডু নিজে ফুটবল খেলতেন, ছেলে রাফায়েল টুডুকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন খেলাটির সঙ্গে। অসুখে ভুগে মানিক টুডু অনন্তলোকে চলে গেছেন রাফায়েলকে সেই ছোট্টটি রেখেই। কিন্তু তিনি কি জানতেন, তাঁর ছেলেই একদিন ঢাকায় এসে গোলের ঝড় তুলবেন?

দেশের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (বিসিএল) শিরোপার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে মঙ্গলবার রাতেই। চ্যাম্পিয়ন হয়ে দীর্ঘদিন পর ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে ফিরছে ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাব। তাদের শিরোপা জয়ে দারুণ অবদান রাফায়েল টুডুর। লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই। ৯ ম্যাচে ১২ গোল তাঁর। রাফায়েল পেয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়েরও পুরস্কার।

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার হাতে গর্বের হাসি রাফায়েলের

প্রথমবার বিসিএলে খেলতে নেমেই রাফায়েল নিজেকে চিনিয়েছেন দারুণভাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রথম ইয়াংমেন্স ক্লাবে সুযোগ মেলা রাফায়েলকে লিগের প্রথম পাঁচ ম্যাচে খেলানোই হয়নি। পঞ্চম ম্যাচে উত্তরা এফসির বিপক্ষে কোচ ইমতিয়াজ খান লাবু কী মনে করে যেন তাঁকে মাঠে নামালেন, আর নেমেই বাজিমাত। হ্যাটট্রিকসহ করে ফেললেন ৪ গোল।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাফায়েলকে। দলের সাফল্যে বড় অবদান রেখে নিজের আবির্ভাবটা স্মরণীয় করে রাখলেন। সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে রাফায়েলের সঙ্গে লড়াই হয়েছে ক্লাব সতীর্থ ডালিম বর্মণের। তাঁর গোল ৯টি। পরশু পিডব্লুডির বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতে লিগ শিরোপা জয়ের ম্যাচে রাফায়েল অবশ্য গোল করতে পারেননি। তবে গোল করেছেন ডালিম।

মতিঝিলের ইয়াংমেন্স ক্লাব প্যাভিলিয়নে বসে রাফায়েল নিজের সম্পর্কে চমকে দেওয়ার মতো একটা তথ্য দিলেন। নিজ গ্রামে ফুটবল খেলতে খেলতে রাজশাহী শহরে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কিশোর ফুটবল একাডেমিতে। সেখানকার কোচ মামুনুল ইসলাম দোহারা গড়নের জন্য তাঁকে গোলকিপার হিসেবেই পছন্দ করেছিলেন।

একসময় গোলকিপার হিসেবে খেলা রাফায়েল এখন পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার (বাঁয়ে)

কিন্তু রাফায়েলের গোলকিপার হিসেবে খেলতে একেবারেই ভালো লাগত না। ঢাকায় মামুনুলই তাঁকে খেলতে পাঠিয়েছিলেন প্রথম বিভাগের (তৃতীয় স্তর) ক্লাব বাড্ডা জাগরণীতে, সেটাও গোলকিপার হিসেবেই। ২০২০-২১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিসিএলে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের স্কোয়াডে ছিলেন গোলকিপার পরিচয়ে। একটা ম্যাচও খেলার সুযোগ মেলেনি।

অভিমান করে রাজশাহী ফিরে যাওয়া সেই ‘গোলকিপার’ রাফায়েলই পজিশন পাল্টে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা শুরু করেন এরপর। এবার ক্লাবের সিনিয়র সতীর্থ নিজ গ্রামের শিবুলাল টুডুর মাধ্যমে ইয়াংমেন্সে স্ট্রাইকার হিসেবেই নাম লিখিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস।

রাফায়েল বলেছেন, ‘গোলকিপার হিসেবে খেলতে ভালো লাগত না। তবু গোলকিপার হিসেবেই প্রথম বিভাগে বাড্ডা জাগরণীতে খেলেছি, এরপর বিসিএলে ভিক্টোরিয়ার স্কোয়াডেও ছিলাম গোলকিপার হিসেবে। রাগ করে রাজশাহী ফিরে যাই। সেখানকার স্থানীয় ফুটবলে অনেকটা জেদ করেই স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা শুরু করি। ক্লাবের বড় ভাই শিবুলাল আমার গ্রামের, তিনিই আমাকে ইয়াংমেন্সে নিয়ে আসেন। তবে আমি কৃতজ্ঞ কোচ লাবু ভাই (ইমতিয়াজ খান) ও ম্যানেজার এম এইচ পিপুল সাহেবের প্রতি। তাঁরা আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন।’

রাফায়েলের মধ্যে দারুণ এক গোল স্কোরার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছে তাঁর ক্লাব ইয়াংমেন্স

ইয়াংমেন্সের ম্যানেজার এম এইচ পিপুল দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। ১৮ বছর বয়সী রাফায়েল তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ইয়াংমেন্স, মোহামেডান, ব্রাদার্স, মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার মিজানুর রহমানের কথা, ‘আমি রাফায়েলের মধ্যে মিজানের ছায়া দেখতে পেয়েছি। একই ধরনের দোহারা গড়ন। ও যদি পরিশ্রম করে যায়, তাহলে দেশ দারুণ এক গোল স্কোরারকে পেতে পারে। সে এবারের বিসিএলে নিজেকে প্রমাণ করেছে।’

আমতলী গ্রামে রাফায়েল রেখে এসেছেন মা মাখলু হেমব্রমকে। পরশু রাতেই মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর, ‘মা চান, আমি বড় ফুটবলার হই। অনেক কষ্ট করে তিনি আমাকে বড় করেছেন। রাত-দিন পরিশ্রম করেন। তিনি খালি কাঁদছিলেন।’

রাফায়েল জানেন, এটা আনন্দের কান্না। মা কেঁদে কেঁদে ছেলেকে বলছিলেন, ‘তোর বাপ যদি দেখতে পেত তুই লিগে এতগুলো গোল করেছিস, খুব খুশি হতো।’

রাফায়েলের অবশ্য বিশ্বাস, বাবা নিশ্চয়ই তাঁকে দেখছেন!