উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ
উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ

সাক্ষাৎকারে নিয়াজ মোরশেদ

‘আমরা আলতু–ফালতু জিনিস নিয়ে আছি’

বিশ্বনাথন আনন্দ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নিয়াজ মোরশেদ আমার চেয়ে অনেক মেধাবী ছিল। সে বিরতি না দিলে অনেক দূর যেতে পারত।’ এ নিয়ে আক্ষেপ আছে নিয়াজেরও। জিএম হয়ে তিনি পড়াশোনার জন্য বিদেশে চলে যান। খেলায় বিরতি পড়ে। অনিয়মিত হয়ে পড়ায় সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা মেনে নিয়ে দেশের দাবার বর্তমান অবস্থার জন্য নিজেরও কিছুটা দায় দেখছেন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার।

প্রশ্ন

১৯৮৭ সালে আপনি উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন। অথচ ভারতে এখন গ্র্যান্ডমাস্টার ৭৮ জন। বাংলাদেশ পড়ে আছে ৫ জনেই। কেন?

নিয়াজ মোরশেদ: আমি নিজেও এর কিছুটা দায় নেব। বিশ্বনাথন আনন্দ গুরুত্ব দিয়ে দাবা খেলে আদর্শ হতে পেরেছেন। বিশ্বসেরা হয়েছেন। আমি সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। আমি পারলে হয়তো আমাদের দাবার পরবর্তী ধাপে অনেক কিছু সহজ হতে পারত।

প্রশ্ন

আপনার পর বাংলাদেশে চারজন জিএম হয়েছেন। কিন্তু ১৪ বছর ধরে কেন কোনো জিএম এল না?

নিয়াজ: গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রক্রিয়া। একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমাদের দেশে এটা নেই।

প্রশ্ন

কেন নেই?

নিয়াজ: বড় কারণ, অতীতে বাংলাদেশের দাবায় অনেক রাজনীতি ছিল। জেনারেল মাহবুবুর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রধান থাকার সময় আমাকে একদিন বললেন, বাংলাদেশের দাবায় অনেক রাজনীতি। আমি বললাম, রাজনীতি কোথায় নেই! তিনি বললেন, দাবা এ ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন।

নানা রকম গোষ্ঠীর ‘ইন্টারেস্ট’ ছিল খেলাটাতে। একটা সময় সংগঠকদের ব্যক্তিস্বার্থ ছিল প্রবল। কেউ টাকাপয়সার জন্য আসত। কেউ নামের জন্য। নব্বইয়ের দশক থেকে এটা টানা প্রায় ২০ বছর অব্যাহত ছিল। গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরিতে তখন পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি। 

বয়স্ক খেলোয়াড়দের রাজনৈতিক কারণে পৃষ্ঠেপোষণা করা হয়েছে। ফেডারেশনে টাকা এলে তাদেরকে মিষ্টির মতো বিতরণ করে দেওয়া হয়েছে। এই জিনিসগুলো অনেক দিন চলেছে। ফলে আসল কাজটা হয়নি
নিয়াজ মোরশেদ
প্রশ্ন

এখন কী অবস্থা দেখছেন?

নিয়াজ: এখন দাবায় একটু টাকাপয়সা আসছে। সাবেক আইজিপি ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর দাবা চাঙা হয়েছে। কিন্তু এত দিনের শূন্যতা তো একদিনে পূরণ হয়ে যাবে না। অতীতে স্থবিরতা অনেক বেশি ছিল। নতুন দাবাড়ু তুলে আনতে স্কুল পর্যায়ে খেলাটা নেওয়া দরকার ছিল। সারা দেশে প্রতিভা অন্বেষণের পরিকল্পনা দরকার ছিল। এসব হয়নি।

তা ছাড়া বয়স্ক খেলোয়াড়দের রাজনৈতিক কারণে পৃষ্ঠেপোষণা করা হয়েছে। ফেডারেশনে টাকা এলে তাদেরকে মিষ্টির মতো বিতরণ করে দেওয়া হয়েছে। এই জিনিসগুলো অনেক দিন চলেছে। ফলে আসল কাজটা হয়নি। আমার মনে হয়, আমাদের ক্ষতিটা ওই সময়েই হয়ে গেছে। আর ঠিক ওই সময় থেকেই ভারত উন্নতি শুরু করেছে।

প্রশ্ন

ভারতের উন্নতিটা কীভাবে হলো?

নিয়াজ: ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ভারত দাবায় শক্তিশালী ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তারা ফল পেতে শুরু করে। নতুন নতুন খেলোয়াড় আসতে থাকে। ১৯৯৬ সালে জোনাল টুর্নামেন্টের সময় দিব্যন্দুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, ‘তুই ওদের সাথে পারিস না (নতুনদের সঙ্গে)।’

তখন ও শশী কিরণদের প্রসঙ্গ টেনে বলল, ‘এখন নতুনেরা এসে গেছে। ওদের সাথে পারা খুব মুশকিল হয়ে যায়।’ আমার মনে হয়, ওটাই ভারতের টার্নিং পয়েন্ট। ওরা আমাদের ছাড়িয়ে চলে যায়। আমরা নিজেদের রাজনীতি আর আলতু–ফালতু জিনিস নিয়ে আছি। ফলে আমাদের উন্নতি নেই।