বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে টানা পাঁচ শিরোপা বসুন্ধরা কিংসের। পাঁচটি শিরোপারই নেপথ্য কারিগর স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন পাঁচ লিগ শিরোপাজয়ী কোচ হিসেবে নিজের অনুভূতির কথা, সাফল্যের পেছনের গল্প। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে বসুন্ধরা কিংসের কোচ হিসেবে গত ৬ মৌসুমে তাঁর পথচলাও...
টানা পাঁচবার লিগ চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের কোচ, অনুভূতিটা কেমন?
অস্কার ব্রুজোন: নিঃসন্দেহে দারুণ অনুভূতি। তবে আমি কৃতিত্বের বড় একটা অংশ বসুন্ধরা কিংসের নীতিনির্ধারকদের দেব। তাঁরা যেভাবে পেছন থেকে আমাদের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন, আমাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, টিম ম্যানেজমেন্ট ও খেলোয়াড়দের ওপর আস্থা রেখেছেন, আমাদের সব ধরনের চাহিদা পূরণ করেছেন, কোচ হিসেবে সেটি দারুণ তৃপ্তিদায়ক।
বসুন্ধরা কিংস নিঃসন্দেহে শক্তিতে বাংলাদেশের অন্য ক্লাবগুলোর তুলনায় এগিয়ে আছে। এমনকি প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় সেরা দলের সঙ্গেও কিংসের পয়েন্টের পার্থক্য অনেক। আপনার কি মনে হয়, কিংসের সঙ্গে তাদের লড়াইটা বেশ খানিকটা অসমই হয়ে উঠছে?
ব্রুজোন: বাংলাদেশের প্রতিটি বড় ক্লাবেরই উচিত প্রতি মৌসুমেই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। ভালো দল গড়ার চেষ্টা করা, আরও বেশি বিনিয়োগ করা। কিংস পাঁচ মৌসুম ধরে যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করা। যদিও আমরা এই পাঁচ মৌসুম ধরে যে জয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছি, যে সুনাম অর্জন করেছি, সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো যথেষ্ট কঠিন বলেই আমি মনে করি। আমাদের কৃতিত্ব হচ্ছে, আমরা প্রতি মৌসুমেই নিজেদের পারফরম্যান্সের মানদণ্ড ওপরে নিয়ে গেছি। আমরা একটা জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছি, এখন বাকিটা অন্য ক্লাবের বিষয়, তারা কী করবে।
বোঝাই যাচ্ছে, আপনারা কীভাবে সফল হচ্ছেন। কিন্তু নিশ্চয়ই সাফল্যের আরও কিছু গোপন রেসিপি আপনাদের আছে। সেটি কি বলা যায়?
ব্রুজোন: গোপন রেসিপি বলতে আসলে কিছু নেই। বসুন্ধরা কিংস একধরনের পেশাদারি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে ক্লাবের মধ্যে, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট একটা ফুটবলীয় দর্শন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা দলের খেলোয়াড়দের ঐক্যের ওপর জোর দেন, এর কোনো বিকল্প নেই। পুরো ব্যাপারটিই টিমওয়ার্ক। একই সঙ্গে ভালো ব্যবস্থাপনার বিষয়টি না হলে হবে না। কিংস একটা যুগোপযোগী অবকাঠামোও গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আর মাঠের কৌশলের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কোচিং স্টাফকে দেওয়া আছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে জেতার অদম্য আকাঙ্ক্ষাটাও কিংস নীতিনির্ধারকেরা তৈরি করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
আচ্ছা, ধরুন, আপনি বসুন্ধরা কিংসের এই দলের কোচ আর নেই। আপনাকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেরই অন্য একটি ক্লাবের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, আপনি কি আত্মবিশ্বাসী, সেই দলটিকেও সাফল্য দেওয়ার ব্যাপারে?
ব্রুজোন: আসলে প্রতিটি ক্লাবই আলাদা। খেলোয়াড়েরাও আলাদা। প্রতিটি ক্লাবেরই শক্তির জায়গা আলাদা। শুধু সেই নির্দিষ্ট ক্লাব ও তাদের খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করলেই বোঝা যাবে, কতটুকু সফল হব। আমাকে ওই ক্লাবের কোচ হিসেবে তাদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা বুঝতে হবে, জানতে হবে, সে অনুযায়ীই কাজ করতে হবে।
বসুন্ধরা কিংসের সাইড বেঞ্চ অনেক শক্তিশালী। অনেকেই বলেন, সাইড বেঞ্চের খেলোয়াড়দের দিয়েই নাকি লিগ জিততে পারেন আপনারা। আবার অভিযোগ আছে, আপনারা ভালো ভালো খেলোয়াড়দের সই করিয়ে নেন যেন অন্যরা ভালো দল গড়তে না পারে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
ব্রুজোন: অভিযোগটা মোটেও ঠিক নয়। আমরা একটা দল গঠন করি। প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়দের দিয়েই করি, আমরা তাদেরই সই করাই, যাদের আমরা প্রয়োজনীয় মনে করি। আমরা খেলোয়াড়দের একাদশের খেলোয়াড় ও সাইড বেঞ্চের খেলোয়াড়, এমন আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করি না। আমরা প্রতিটি খেলোয়াড়েরই যত্ন নিই, তাদের সবাইকে কঠিন অনুশীলন সেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, প্রতিটি খেলোয়াড়কেই তৈরি অবস্থায় রাখি।
আপনারা দেখেছেন, আমরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলোয়াড়দের একাদশে সুযোগ দিই। মাঠে তাদের সামর্থ্যের পরীক্ষা নিই। কিংসে যেসব খেলোয়াড় আছে, তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা পরিকল্পনা আছে। তাদের সে অনুযায়ী নিজেদের পারফরম্যান্সকে একটা পর্যায়ে নিতে হয়। কিংসের খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা সব সময়ই থাকে। সেই প্রতিযোগিতা হচ্ছে বেশি করে খেলার সুযোগ করে নেওয়ার।
পাঁচবার টানা লিগ শিরোপা জিতলেন, একপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছাড়াই। ২০১৮ সালে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ লিগে আবির্ভাবের পর থেকেই শিরোপার লড়াইটা রীতিমতো একপেশে। একঘেয়ে লাগে না মাঝেমধ্যে?
ব্রুজোন: ব্যাপারটা একঘেয়ে মনে হতে পারে তাদের জন্যই, যারা আমাদের সঙ্গে দিনের পর দিন পেরে উঠছে না। আমাদের একঘেয়ে লাগার কোনো কারণ নেই। আমাদের একটা খিদে সব সময়ই আছে, সেই খিদেটা জয়ের এবং সব সময়ই জেতার। জেতায় ও সাফল্য পাওয়া কখনোই একঘেয়ে হতে পারে না।
বাংলাদেশে আপনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে আরও আকর্ষণীয় করে সাজানো যেতে পারে?
ব্রুজোন: এ ব্যাপারে আমার কোনো মতামত নেই, বক্তব্যও নেই। এটা বাংলাদেশের ফুটবলের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা বলতে পারবেন।
আপনি বসুন্ধরা কিংসের কোচ হিসেবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দুর্দান্ত সফল। কিন্তু কিংস এশীয় পর্যায়ের ক্লাব ফুটবলে সাফল্য সেভাবে পাচ্ছে না। গত মৌসুমে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দারুণ সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। শেষ ম্যাচে ওডিশার বিপক্ষে যেখানে ড্র করলেই পরের রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে যেত, কিংস সেই ম্যাচ হেরে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাইছি...
ব্রুজোন: কিংস এএফসি কাপে চারবার গ্রুপ পর্বে রানার্সআপ হয়েছে। এর মধ্যে দুবার আমরা পরের রাউন্ডে যেতে পারিনি গোল-পার্থক্যে। আমরা এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাব টুর্নামেন্ট এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগের প্লে-অফ খেলেছি গত মৌসুমে শারজা এফসির মতো দলের সঙ্গে, সেটিও আমরা খুব বেশি খারাপ করেছি বলে মনে হয় না। এশিয়ার পশ্চিম জোনের মাত্র চারটি ক্লাব এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ পেয়েছে, তাদের মধ্যে কিংস একটা। আমি মনে করি, এটা আমাদের একটা বড় সাফল্য। কিংস প্রমাণ করেছে, তারা এশিয়ার সর্বোচ্চ ক্লাব প্রতিযোগিতায় খেলার মতো একটা দল।
আমরা নিয়মিত ভারতীয় ক্লাবগুলোকে হারাচ্ছি এবং এশীয় পর্যায়ে আরও ভালো করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছি। তবে হ্যাঁ, গত মৌসুমে এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে মালদ্বীপের ক্লাবটির বিপক্ষে হারটা ছিল অপ্রত্যাশিত। সেটিরই মূল্য চুকিয়েছি আমরা শেষ পর্যন্ত। তবে গত মৌসুমে রেফারিং নিয়ে আমাদের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে ওডিশা এফসির বিপক্ষে যে ম্যাচটির কথা বললেন, সেটিতে আমরা খুবই বাজে রেফারিংয়ের শিকার হই।
আপনি কি মনে করেন বসুন্ধরা কিংসের একটা যুব প্রকল্প প্রয়োজন, যার মাধ্যমে আরও ভালো ভালো ফুটবলার তৈরি করা যেতে পারে?
ব্রুজোন: বসুন্ধরা কিংসের এ ব্যাপারে পরিকল্পনা আছে, যত দূর জানি। তবে এ ব্যাপারে আপনার উচিত আমাদের নীতিনির্ধারক ও ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করা। তাঁরা যুব প্রকল্পের ব্যাপারে আরও ভালো তথ্য দিতে পারবেন। আমার দায়িত্ব শুধু সিনিয়র দলকে নিয়ে কাজ করা।
বাংলাদেশের অন্য দুই প্রধান ক্লাব আবাহনী ও মোহামেডানকে নিয়ে আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি?
ব্রুজোন: আমি বসুন্ধরা কিংসের কোচ। আমি আমার দল নিয়েই আছি। অন্যদের নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ জানানো কিংবা মন্তব্য করা আমার উচিত নয়, সেটি অনধিকার চর্চাই।
আপনি হয়তো জানেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লেস্টার সিটির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আপনি কি মনে করেন হামজা এলে বাংলাদেশের ফুটবল উপকৃত হবে?
ব্রুজোন: দেখুন, পেশাদার যেকোনো ফুটবলার, কোচ বা অন্য কেউ এলে যদি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ কিংবা বাংলাদেশের ফুটবল উপকৃত হয়, তাহলে তাদের অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশে আছেন অনেক দিন। এ দেশের কোন জিনিসগুলো আপনাকে এই দেশে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিচ্ছে?
ব্রুজোন: অবশ্যই আমার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। আমি যে এলাকায় থাকি, সেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পরিবেশ। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি আপ্লুত করে, এই দেশে আমি সবার কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়ে আসছি। বসুন্ধরা কিংসে আমার সহকর্মীরা, আমার খেলোয়াড়েরা, আমার ঊর্ধ্বতন কর্তারা অসাধারণ। দারুণ কর্মপরিবেশ এখানে। ঢাকায় আমার স্প্যানিশ বন্ধুদের কথাও বলতে হয়, আমরা সবাই সপ্তাহে একদিন একত্র হই। তুমুল আড্ডা হয় আমাদের। ঢাকায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় মহাদেশীয় ও এশীয় খাবার আমার ভালো লাগার আরও একটা বিষয়।