বাংলাদেশ দল ততক্ষণে দেশের পথে উড়ছে। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে রয়ে গেছেন কলম্বোতেই। অস্ট্রেলিয়া হয়ে ঢাকায় দলের সঙ্গে যোগ দেবেন নিউজিল্যান্ড সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে। কাল অবসরের সকালে সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলের লবিতে প্রথম আলোকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ দলের কোচ কথা বলেছেন এশিয়া কাপের পারফরম্যান্স, বিশ্বকাপের পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরও অনেক কিছু নিয়েই—
প্রশ্ন: মিশ্র একটি এশিয়া কাপই গেল বাংলাদেশের। বিশ্বকাপও খুব কাছে চলে এল। এ সময়ের মধ্যে আপনি কোন জায়গাগুলো ঠিক করতে চান?
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে: আমরা কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি, তবে বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখনো বাকি। খুবই ভালো লাগছে যে গত রাতের ম্যাচটিতে (ভারতের বিপক্ষে) কিছু প্রশ্নের উত্তর অন্তত পেয়েছি। পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়কে দেখার সুযোগ পেয়েছি এই ম্যাচে। আশা করি, এদের কেউ কেউ বড় মঞ্চেও নিজেদের মেলে ধরতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাচটি আমরা দলীয় পারফরম্যান্স দিয়ে জিততে পেরেছি। খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশ সাধারণত এক–দুজনের ব্যক্তিগত ঝলকেই জেতে। সেদিক থেকে এই ম্যাচটি ব্যতিক্রম ছিল। চোখের দেখার জন্য শান্তির ছিল। তবে টপ অর্ডার নিয়ে আমার এখনো প্রশ্ন আছে। এক-দুটো ম্যাচ বাদ দিলে এই এশিয়া কাপে আমরা তেমন ভালো শুরু পাইনি। তাতে অবশ্য আমি আতঙ্কিত নই।
এখানে কন্ডিশনেরও ব্যাপার ছিল। একটি ম্যাচ খেললাম ক্যান্ডিতে, দুটো লাহোরে। এরপর খেত্তারামায়। স্বাগতিকদের বিপক্ষে ওদের মাঠেই খেলতে হয়েছে আমাদের। তা ছাড়া আমরা দুজন তরুণ ওপেনারকে নিয়ে খেলেছি। মেকশিফট ওপেনার দিয়েও চেষ্টা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে ছিল দুজনের চোট এবং একজনের অসুস্থতা, যা আমাদের কিছুটা এলোমেলো করে দিয়েছিল। টপ অর্ডারে ভালো না করার এটিই অন্যতম কারণ হওয়ায় আমি আতঙ্কিত হচ্ছি না। তবে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে এই বক্সটিতেও টিক চিহ্ন দিয়ে যেতে চাই। ব্যাটিংয়ের দিক থেকে কিছু বক্সে টিক চিহ্ন দিয়েই বিশ্বকাপে যাওয়া দরকার। বোলিং নিয়ে আমি খুশি। কেবল একটিই অপ্রাপ্তি। গত আট বছরে একজন লেগ স্পিনার পেলাম না। আগামী তিন দিনের মধ্যেই যদি কাউকে পেয়ে যাই, নিয়ে নেব (হাসি), মজা করছিলাম। ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। তারপরও আমি চাচ্ছিলাম কেউ হাত তুলে বলুক, ‘আমাকে নিন। আপনার কাজটি করার জন্য আমি তৈরি।’
প্রশ্ন: বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তেও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এত বড় আসরের আগে এটা কি খুব আদর্শ?
হাথুরুসিংহে: অনেক বড় প্রশ্ন। উত্তর হলো, না। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আদর্শ জায়গায় নেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসব করা ঠিক? অবশ্যই না। এই ব্যাপারগুলো আরও দুই–আড়াই বছর আগেই বাজিয়ে দেখা উচিত ছিল। ওই সময় যাঁরা যাঁরা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, প্রশ্নটি তাঁদের করলেই বরং ভালো। ২০১৯ বিশ্বকাপের পরপরই এই ভাবনাটা জরুরি ছিল যে ২০২৩ সালে দলটিকে আমরা কোন অবস্থায় দেখতে চাই। এটিকেই সাফল্যের পরিকল্পনা বলে। এটি আরও অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার কথা।
আমি তো এলাম মাত্র ছয় মাস হলো। এ জন্যই আমাকে শেষ মুহূর্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেতে হচ্ছে। কোনো অজুহাত দিচ্ছি না। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। আমাকে তাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে হচ্ছে। এ জন্যই পরিস্থিতিটা এখন এমন। আশা করি, আমরা উতরে যাব। ৩-৪ বছর পর আমরা অনেক ভালো জায়গায় থাকব বলে বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন: আপনার কথায় স্পষ্ট যে এবারও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা যথেষ্ট আগে থেকে হয়নি। দল তৈরি করার কাজটি তো তাহলে অনেক কঠিন হয়ে উঠেছিল আপনার জন্য...
হাথুরুসিংহে: পরিকল্পনা যে একদমই ছিল না, সেটি বলব না। পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই পরিকল্পনা থেকে তাদের বিচ্যুত হতে হয়েছে। হতে পারে কখনো সেটি চোট-আঘাতের জন্য। আবার কখনো কিছু সিদ্ধান্তও সেটিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মরিয়া উদাহরণ হিসেবে আমি এউইন মরগ্যানের দলটির কথা বলব। (২০১৫-এর বিশ্বকাপে) অ্যাডিলেডে আমাদের কাছে হারার পরপরই ওদের পরের বিশ্বকাপের পরিকল্পনা দাঁড়িয়ে যায়। ওদের ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম যে ওরা বড় কিছু করার জন্য ফুঁসছে। এরপরই ইংল্যান্ড সবকিছু বদলে ফেলে। আর আমাদের দিকে দেখুন।
যেকোনো কারণেই হোক না কেন, আমাদের অধিনায়ক ঠিক হয়েছে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ হলো। আমি এলাম ছয় মাস আগে। এ রকম কিছু অবশ্যই আদর্শ নয়। তবে তার মানে এই নয় যে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। আবার এটিও বলছি না যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে নেবে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলতে চাইছি এমন কিছু করার কথা, যা আগে আমরা কখনো করিনি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য এখন পর্যন্ত এক আসরে সর্বোচ্চ তিনটি ম্যাচ জেতাই। তা কেউ যদি এখন এই স্বপ্ন দেখে যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে, তাহলে আমি তাঁকে বলব, ‘ঘুম থেকে জেগে উঠুন।’ অতীতে যা করেছি, তার চেয়ে ভালো কিছু অবশ্যই অর্জনযোগ্য। আমরা নিজেদের লক্ষ্য বড়ই রাখছি—সেমিফাইনাল খেলা।
প্রশ্ন: যখন দেখলেন বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, বোর্ডের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন?
হাথুরুসিংহে: পরিকল্পনা একদমই ছিল না, এমন নয়। হয়তো আদর্শ পরিকল্পনা ছিল না। আমি কিন্তু এবার এসে আগের চেয়ে অনেক ভালো একটি পেস আক্রমণই পেয়েছি। ব্যাটিং লাইনও অভিজ্ঞ। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় কয়েকজন চোটে পড়ায়। শান্ত ও লিটনের সঙ্গে তামিমের কথাও বলতে হয়। ওরা এমন তিনটি স্তম্ভ, যাদের ওপর আমাদের ব্যাটিংটা নির্ভর করে। সমস্যা এটিও নয়, সমস্যা গভীরতায়। একজনের চোটে আরেকজনকে যখন আনছেন, দেখা যাচ্ছে ওর সঙ্গে নিয়মিত খেলোয়াড়ের পার্থক্যের জায়গাটি বেশ বড়। এই পার্থক্য কমিয়ে গভীরতা বাড়ানোর ব্যাপারটিকই পরিকল্পনা। ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাকান। চোটে ছিটকে পড়া কারও জায়গায় যাকে খেলায়, দেখবেন ব্যবধানটা সামান্য।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপের ঠিক আগে একজন অধিনায়কত্ব ছাড়লেন, আরেকজন পেলেন। এটিও নিশ্চয়ই আদর্শ পরিস্থিতি নয়...
হাথুরুসিংহে: অবশ্যই আদর্শ নয়। বেশি কিছু বলতে গেলে বিতর্ক হতে পারে, তাই এ নিয়ে তেমন কিছু বলছি না। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার কোচ থাকার সময়ও একই অবস্থায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। ছয় মাসের মধ্যে তিনজন অধিনায়ক নিয়ে খেলা কিছুতেই আদর্শ হতে পারে না। দিমুত করুনারত্নে অধিনায়ক হয় বিশ্বকাপের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে। এটিকে কোনো পরিকল্পনা বলার সুযোগ তো নেই-ই, বরং বলতে হয় রাবিশ। অথচ আশা করা হয়েছিল যে দল বড় কিছু করবে! পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা—একই সমান্তরালে থাকা জরুরি। এই জায়গাটিতে আমরা উন্নতি করতে পারি। বাংলাদেশের ব্যাপারটা শ্রীলঙ্কার তুলনায় ভিন্ন। আমাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা অপ্রত্যাশিত ছিল।
প্রশ্ন: ক্রিকেটাঙ্গনে কিন্তু এমন আলোচনাও আছে যে তামিমের সিদ্ধান্তে আপনিও একটা প্রভাবক ছিলেন...
হাথুরুসিংহে: আমি তো ন-ই, এ রকম কিছু একটা হতে যাচ্ছে, তা কেউই জানত না। যেটি আমি জানিই না, সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ কোথায়?
প্রশ্ন: আসলে বলতে চাচ্ছি, যে বা যাদের কারণে তামিম ও রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আপনি নাকি তাদের একজন...
হাথুরুসিংহে: কথাটা যদি তামিম এসে বলে, তাহলে আমি উত্তর দিতে পারি। যদি অন্য কেউ বলে, আমি জানি না তারা কোত্থেকে এই খবর পেল। তামিম বললে ওর সঙ্গে বসে জিজ্ঞেস করতে পারি, আমি কখন, কোথায় কী করলাম! (হাসি...)। এ বিষয়ে আমার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আমি তো জানতামই না যে এ রকম কোনো ঘোষণা আসতে চলেছে।
প্রশ্ন: তামিম কী কারণে ও রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে মনে করেন?
হাথুরুসিংহে: সে তো আমার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্তটি নেয়নি। এ নিয়ে আমি ভাবতে চাই না।
প্রশ্ন: ওই ঘটনার পর থেকে আপনাদের মধ্যে নাকি যোগাযোগ নেই। সে কারণেও অনেকে আপনাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে বলে অনুমান করছেন...
হাথুরুসিংহে: তামিম এ রকম কিছু কোথাও বলেছে বলে আমার চোখে পড়েনি (হাসি...)। যোগাযোগ না হওয়ার বিষয়টি সত্যি নয়। তামিম কী করছে না করছে, সবই আমি জানি। ও মেডিকেল বিভাগের অধীনে আছে। ওরাই সব আপডেট আমাকে দিচ্ছে। তামিম কখন ব্যাটিং করছে, কীভাবে করছে, ওর অবস্থার উন্নতি কতটা হচ্ছে, আমি সবই জানতে পারছি। যা করার, পেশাদারের মতোই করছি। মানুষ কী বলছে শোনার দরকার নেই। কারও সঙ্গেই আমার কোনো অস্পষ্টতা নেই। একতরফা আলোচনায় কান না দিয়ে এ রকম মুখোমুখি বসলে আমিও বিষয়গুলো পরিষ্কার করে দিতে পারি।
প্রশ্ন: লম্বা বিরতির পর বিশ্বকাপে তামিম নিজেকে কতটা মেলে ধরতে পারবেন বলে মনে করেন কি?
হাথুরুসিংহে: তামিমের কাছ থেকে ওর সেরাটা দেখতে চাই। কারণ আমি জানি, ফর্মে থাকলে সে-ই বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। চোট ও নানা কারণে ক্রিকেট থেকে অনেকটা সময় দূরে থাকার পর ও নিজেকে কতটা মেলে ধরতে পারছে, তা আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারব। ওর কাছ থেকে আমি এটি শোনার অপেক্ষায় আছি যে ‘আমি ফিট।’
প্রশ্ন: বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যাওয়ার লক্ষ্যের কথা বললেন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটি কতটা সম্ভব মনে হচ্ছে?
হাথুরুসিংহে: সেমিফাইনালে যাওয়ার লক্ষ্য তো আছেই। তবে প্রথম লক্ষ্য হলো ধর্মশালায় প্রথম ম্যাচ জেতা। সেমিফাইনালে যাওয়াটা আমাদের জন্য হবে বিশাল চ্যালেঞ্জের।
প্রশ্ন: চ্যালেঞ্জ কোন কোন জায়গায়?
হাথুরুসিংহে: চ্যালেঞ্জ হলো অন্য দলগুলো আমাদের চেয়ে ভালো। এই চ্যালেঞ্জে জিততে সব ম্যাচেই ধারাবাহিকভাবে আমাদের সেরাটা দিয়ে যেতে হবে। কিছু দল আছে, তাঁরাও যদি সেরাটা ঢেলে দেয়, আমাদের কাজ কঠিন হয়ে যাবে। তবে আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি বলেই আবারও বাংলাদেশের চাকরিটা নিয়েছি। আমাদের মতো দল বড় দলকে হারিয়ে দিচ্ছে, আমার সন্তুষ্টির জায়গাটি এখানেই।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপ লম্বা সময় ধরে হবে। টানা ভ্রমণ ও খেলার ঠাসা সূচির মধ্যে চোট-আঘাতের ভয় থাকেই। সে ক্ষেত্রে আপনার ব্যাকআপ খেলোয়াড়েরা কেমন হবেন?
হাথুরুসিংহে: এর জন্য আমার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। নানা স্তরের ক্রিকেটারদের প্রচুর ক্যাম্পও করানো হয়েছে। এখনো ক্যাম্প চলছে। বাংলাদেশ টাইগার্সের ক্যাম্পও আলাদাভাবে চলছে। ছেলেরা শ্রীলঙ্কায় এসে ইমার্জিং এশিয়া কাপ খেলে গেছে। তা ছাড়া বিশ্বকাপেও বাড়তি কিছু ক্রিকেটারকে আমরা নিজেদের খরচে নিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: মাহমুদউল্লাহও নিশ্চয়ই বিশ্বকাপের বিবেচনায় আছেন...
হাথুরুসিংহে: হ্যাঁ, সে–ও পরিকল্পনায় আছে। নিউজিল্যান্ড সিরিজে ও খেলার সুযোগ পাবে। আশা করি সে আমাদের দেখাতে পারবে সে কী করতে পারে। কারণ, বাদ পড়ার পর সে তেমন কিছু করার সুযোগ পায়নি। আমরা একটা সিরিজে তাকে চেয়েছিলাম, কিন্তু হজ করতে যাওয়ায় তাকে পাওয়া যায়নি। যেহেতু সে অভিজ্ঞ, সে যদি রান করে ফর্মে ফিরে...আসলে বিশ্বকাপের জন্য আমরা চাচ্ছিই ফর্মে আছে এমন খেলোয়াড়।
আমি যখন এখান থেকে চলে গেলাম, তখন তারা বুঝতে পারল একটা কিছু তো হারিয়ে গেল এবং আবারও কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। তখন তারা আবার আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। একজন নয়, অনেকেই...এমনকি সিনিয়ররাও। কারও নাম বলব না।চন্ডিকা হাথুরুসিংহে
প্রশ্ন: আগেরবার যখন প্রধান কোচ হিসেবে এসেছিলেন, তখনকার সঙ্গে এবার এসে কী পার্থক্য দেখলেন?
হাথুরুসিংহে: একটা পার্থক্য হলো, আগেরবার আপনারা আমার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাই দেখাননি, সব সময় পেছনে লেগে থাকতেন (হাসি)...মজা করলাম। আসলে আগেরবার বাংলাদেশ দল সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। এখানে এসেই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কেমন, কেমন তাদের সম্ভাবনা। আমি বুঝে নিলাম আমাকে কী কী জিনিস পরিবর্তন করতে হবে এবং আমি তা করলাম। তারা যেভাবে অনুশীলন করত, দলের প্রতি তাদের মনোভাব—অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
আমার মনে হয় আমি সেবার ভালো কিছুই রেখে গিয়েছিলাম। ওদের মনোভাবে বদল আনতে পেরেছি, অনুশীলনের ধরনে পরিবর্তন আনতে পেরেছি, তারা যেভাবে চায়; সেই চিন্তায় পরিবর্তন আনতে পেরেছি। হয়তো পেছনে থেকে আমি কী কী কাজ করেছি, সব তারা দেখতে পায়নি। আমি যখন এখান থেকে চলে গেলাম, তখন তারা বুঝতে পারল একটা কিছু তো হারিয়ে গেল এবং আবারও কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। তখন তারা আবার আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। একজন নয়, অনেকেই...এমনকি সিনিয়ররাও। কারও নাম বলব না।
আমার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও ভালো যোগাযোগ ছিল। সবাই হয়তো ভেবেছিল, আমি তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছি। আসলে তা নয়। শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ার সুযোগ আসাটাও আমার চলে যাওয়ার একটা কারণ ছিল। নিজের দেশের কোচ হব, সেই আবেগও হয়তো কাজ করেছে। পরে হয়তো তাদের সঙ্গে আমার সবকিছু ঠিকঠাক যায়নি, তবে সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। আর কোভিডের সময় তো নিজেকে আমার খুবই ভাগ্যবান মনে হয়েছে। সবাই এখানে–ওখানে ট্রাভেল করছিল আর এ নিয়ে অভিযোগ করছিল, অথচ আমি নিজের বাড়িতেই ছিলাম। স্ত্রীকে সময় দিয়েছি, কুকুরটাকে নিয়ে বেড়িয়েছি।
সত্যি বলতে কি ৩০ বছর পর জীবনের সেরা সময়টা তখনই কাটিয়েছি। কারণ, আমার জীবনে শুধু ক্রিকেট, ক্রিকেট আর ক্রিকেটই ছিল। কোভিডের সময় অস্ট্রেলিয়ায় ৮–৯ মাস কোথাও যেতে পারেনি। ওই ৮–৯ মাস আমি নিজেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সতেজ করেছি। এরপর নিউ সাউথ ওয়েলস ডাকল। তারা দারুণ ক্রিকেটীয় সুযোগ–সুবিধা গড়ে তুলেছে, আমার বাড়ি থেকে সেটা মাত্র মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব। হেঁটেই সেখানে যেতে পারতাম। এদিকে যেহেতু বোর্ডের (বিসিবি) সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল, তারা আমাকে কয়েকবারই বলেছে, ‘যখন তুমি আসতে চাইবে, আমাদেরকে জানাবে।’ কিন্তু ওই সময় আমি প্রস্তুত ছিলাম না; কারণ, আমার ছেলে তখন ক্রিকেট খেলছিল। সম্ভবত গত বিশ্বকাপের সময় বোর্ড আমাকে খুব করে বলল চলে আসার জন্য। তখন আমিও ভাবলাম চলে আসি এবং তাদের সঙ্গে সাফল্যটা উপভোগ করি। একই সঙ্গে আমি এখানে নতুন কিছুও করতে চেয়েছি।
প্রশ্ন: আগেরবার বিসিবি খুব চেয়েছিল আপনি থেকে যান। কিন্তু আপনি শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিলেন, যেটা আপনার জন্য ভালো অভিজ্ঞতা ছিল না। পরে কি কখনো মনে হয়েছে, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে থেকে যাওয়াটাই ভালো ছিল?
হাথুরুসিংহে: আগেই বলেছি, আমার এ নিয়ে কখনো আক্ষেপ নেই। যখন আমি বাংলাদেশের দায়িত্ব নিই, মনে হয়েছিল আমি বাংলাদেশকে যতটুকু পারি এগিয়ে নিয়ে যাব। সেটা মোটামুটি হয়ে যাওয়ার পর মনে হলো তাদের আরেকটা পরিবর্তন দরকার, অন্য কেউ এসে তা করুক। কিন্তু আমি যাদের সঙ্গে কথা বলে শ্রীলঙ্কায় গেলাম, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সেখানে অন্য লোক চলে এল। সরকার বদলে গেল। আমাকে কী পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছিল, সেটা সংক্ষেপে বলি (হাসি)।
এই অল্প সময়ে সেখানে আমি দুজন ক্রীড়ামন্ত্রী পেয়েছি, আপনারা জানেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ক্রীড়ামন্ত্রীর কতটা প্রভাব। দুটি ভিন্ন নির্বাচক কমিটি পেয়েছি এবং তিনজন অধিনায়ক পেয়েছি (হাসি)। তবে এর মধ্যেই সাফল্য ছিল। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকায় হারিয়েছি। বার্বাডোজে জিতেছি, যেখানে এশিয়ার কোনো দল কখনো টেস্ট জেতেনি। বিশ্বকাপে আমরা ষষ্ঠ হলাম, র্যাঙ্কিংয়ে অষ্টম। ২০১৫ বিশ্বকাপের দিকে তাকান, তখন সাঙ্গাকারা, মাহেলার মতো ক্রিকেটার ছিল। অথচ তারা সেবার অষ্টম হয়েছিল।
মাঠের বাইরে এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা দলটাকে ঠিক রাখতে পেরেছিলাম। কুশল মেন্ডিসকে আমি দলে রেখেছি, এখন সে তার সেরাটা দিচ্ছে। সাদিরা সামারাবিরার কথা বলব। আমি যাদের এনেছিলাম, তখনকার বেশির ভাগ ক্রিকেটার এখন শ্রীলঙ্কা দলে খেলছে। সে কারণেই কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, আমি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের জন্য ভালো কিছুই করতে চেয়েছিলাম এবং আমি তা করতে চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে কিছু বিতর্কও তখন ছিল, ক্রিকেট দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। সেসবও বন্ধ হয়েছে। এসব তো মানুষ দেখে না। কিন্তু আমি আমার দেশের জন্য কাজ করেছি এবং আমি তার জন্য গর্বিত। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট যদি আগের মতোই চলত, তাতে শ্রীলঙ্কার অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।
যদি কেউ সর্বোচ্চ জায়গায় না যেতে পারে, আমি তাকে চাপ দেব না। কারণ, সেটাই তার সীমা। উদাহরণ হিসেবে মিরাজের কথা বলতে পারি। মিরাজ কেন পরবর্তী সাকিব হবে না? আমি যখন দেখব কাউকে চাপ দিলে সে পরের ধাপে যেতে পারবে, তার মধ্যে সে সম্ভাবনা আছে, আমি তাকে সেটা অবশ্যই দেব।চন্ডিকা হাথুরুসিংহে
প্রশ্ন: আগেরবার আপনাকে নিয়ে সবার মনোভাব ছিল যে আপনি খুব রূঢ়, কড়া হেডমাস্টারের মতো। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে সবার সঙ্গে অনেক খোলামেলা, উদার...
হাথুরুসিংহে: আপনি যখন কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চাইবেন, লোকজন কিন্তু পরিবর্তনটা নিতে চাইবে না। এটাই মানুষের স্বভাব, যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারে যে পরিবর্তনটা তাদের ভালোর জন্য। আমি যখনই আপনাকে কিছু বদলাতে বলব, আপনি বলবেন, কেন? যখনই আমি কিছু বদলাতে যাব, মানুষ ধরে নেবে আমি খুব কড়া এবং একগুঁয়ে, স্কুলশিক্ষকের মতো। আমাকে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছিল, যেটা আবেগ নিয়ে করা যায়নি। কারণ, আমাকে সঠিক কাজটাই করতে হতো।
আমি কিন্তু এখনো কড়া এবং আমাকে তা থাকতে হবে। গতকালও (পরশু) যেমন কিছু ছেলে ভালো খেলেছে, তবু আমি তাদের বলেছি আরও ভালো খেলতে হবে। তার মানে এই নয় যে আমি খুব কঠোর হয়েছি। এটাই আমার প্যাশন যে আমি তাদের সর্বোচ্চটা দিতে দেখতে চাই। এখন যদি কেউ সর্বোচ্চ জায়গায় না যেতে পারে, আমি তাকে চাপ দেব না। কারণ, সেটাই তার সীমা। উদাহরণ হিসেবে মিরাজের কথা বলতে পারি। মিরাজ কেন পরবর্তী সাকিব হবে না? আমি যখন দেখব কাউকে চাপ দিলে সে পরের ধাপে যেতে পারবে, তার মধ্যে সে সম্ভাবনা আছে, আমি তাকে সেটা অবশ্যই দেব।
প্রশ্ন: এবার যেমন সাকিব এশিয়া কাপের মধ্যেই দেশে গেল আবার ফিরে এল, বাংলাদেশ কোচ হিসেবে আপনার প্রথম পর্বে নিশ্চয়ই এ রকম কিছু আপনি হতে দিতেন না...
হাথুরুসিংহে: না না না না....এ রকম নয়। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমি আপনাকে বলছি...ওই তিন দিন আমাদের কোনো অনুশীলন ছিল না। দলের যে কেউ বাইরে গিয়ে নির্ভার হতে চাইলে আমি বাধা দিতাম না। আমি ছেলেদের বলেছি, তোমরা দেশটা ঘুরে দেখ। কারও যদি রাশিয়া যাওয়ার সামর্থ্য থাকে, তো সেখানে গিয়ে ঘুরে আসো। কোনো সমস্যা নেই। কারণ, ক্রিকেট থেকে মনটাকে একটু সরানো দরকার। রুমে পড়ে থেকো না। সাকিবের সামর্থ্য আছে, তাই সে দেশে গেছে। দলের অন্য ক্রিকেটাররাও চাইলে ঘুরতে যেতে পারত। এখানে এলিফ্যান্ট অরফানেজ আছে বা যেকোনো জায়গায়ই হোক, তারা যেতে পারত। আপনি যে ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছেন, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আপনারা জানেন না আসলে কী হয়েছিল তখন। শুধু আমি, সাকিব আর বোর্ড জানে। আমি বা সাকিব যার কথাই বলুন, আগে যা ছিলাম এখনো তা–ই আছি।
প্রশ্ন: আপনার সাবেক অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেছেন, বাংলাদেশের মতো দলের বিশ্বকাপ জিততে হলে একজন নেতা লাগবে, অধিনায়ক নয়। কারণ, অধিনায়ক একটা ম্যাচের কথা চিন্তা করে আর নেতা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। সাকিবের মধ্যে কি নেতা হওয়ার গুণ দেখেন?
হাথুরুসিংহে: হ্যাঁ, আমি তা দেখি সাকিবের মধ্যে। রানাতুঙ্গা দারুণ একটা কথা বলেছেন। তিনি নিজেও একজন নেতা ছিলেন। আমি তাঁর অধীনে খেলেছি এবং অন্য অধিনায়কদের অধীনেও খেলেছি। অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের মনোভাব এবং দলের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, সবকিছুই অসাধারণ। আগেরবার যখন ছিলাম, তখন সে অধিনায়ক ছিল না, ছিল একজন পারফরমার। এখন দলের সঙ্গে খুব ভালোভাবে সম্পৃক্ত সে। তার সবচেয়ে বড় গুণ, সে কখনো মাথা নত করে না। তার গতকালের ইনিংসটাই তার নেতৃত্বগুণের বড় বহিঃপ্রকাশ। একটা তরুণ দল নিয়ে খেলছে, সত্যি বলতে কি কারও কারও কাছ থেকে হয়তো সেভাবে সমর্থনও পাচ্ছে না। ২০১৯ বিশ্বকাপে ওর প্রস্তুতি নিয়ে আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে যা যা বলেছে, তাতেই বোঝা গেছে মানসিকভাবে সে কতটা শক্ত। লক্ষ্য অর্জনের জন্য কত কঠোর পরিশ্রম করেছে। সে নিজে নিজে অনুশীলন করেছে, সেরাটা করার জন্য সবকিছু নিজের ওপর নিয়েছে...এসব আমি জানতাম না।
নতুন ক্রিকেটাররা আসছে, যাদের সামর্থ্যের প্রকাশ এখনো সেভাবে ঘটেনি। আমাদের সেটা ঘটাতে হবে। সঠিক সময়ে বড় পর্যায়ে খেলতে দিতে হবে, যেটা হৃদয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে।চন্ডিকা হাথুরুসিংহে
প্রশ্ন: দলের সিনিয়ররা অনেকেই ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে এসেছেন। তাঁদের পর যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
হাথুরুসিংহে: সেটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় আমার জন্য, এ জন্যই আমি এখানে। এই ব্যাচটা ২০০৭–২০০৮–২০০৯–এ এসেছে। তারা এই পর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে নিয়ে এসেছে। এখন এটাই আমাদের বেঞ্চমার্ক। পরে যারা আছে, তাদের এটা অতিক্রম করে যেতে হবে। তাদের মধ্যে সে সম্ভাবনা আছে।
নতুন ক্রিকেটাররা আসছে, যাদের সামর্থ্যের প্রকাশ এখনো সেভাবে ঘটেনি। আমাদের সেটা ঘটাতে হবে। সঠিক সময়ে বড় পর্যায়ে খেলতে দিতে হবে, যেটা হৃদয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। ২০১৭ সালের কথা মনে করে দেখুন। ইবাদত ও শান্তকে (নাজমুল হোসেন), আমি দলের সঙ্গে রেখেছিলাম, নিউজিল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলাম ১৬ ও ১৭তম খেলোয়াড় হিসেবে। এখন তারা দলে জায়গা করে নিয়েছে। ওই রকম পরিকল্পনা করতে হবে। শুধু ১১–১২ জন নিয়ে ভাবলে হবে না। আরও খেলোয়াড় তুলে আনতে হবে। আমি সেই ভবিষ্যৎটা দেখি।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে দলের তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী থাকবে?
হাথুরুসিংহে: আমি চাই, ওরা চাপটাকে আলিঙ্গন করে নিক। সেটা করতে পারলে তাদের কাছ থেকে ফলাফল এমনিতেই আসবে। আমি চাই, তারা এই চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিক, নিজেদের কাছে নিজেদের প্রত্যাশার চাপটাকে ইতিবাচকভাবে নিক, যেটা আমরা ক্লাব ক্রিকেট বা অন্য পর্যায়ে তাদের নিতে দেখেছি। আমাদের সবারই প্রত্যাশা থাকে। প্রত্যাশা থেকে প্রথম যেটা আসে, সেটা হলো আমাকে ব্যর্থ হওয়া চলবে না। এটা কিন্তু সঠিক চিন্তা নয়। তাদের ভাবতে হবে, এটা একটা সুযোগ কিছু করে দেখানোর। তারপর বুঝতে হবে সে কী করতে চায়।