আট বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়া কামরান আকমল এখন আছেন পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটের দল গনি গ্লাসের পরিচালক পদে। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সময়টায় দেশটির সব সাবেক ক্রিকেটারের পরিচয়ই বদলে গেছে, সবাই এখন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। ছোট পর্দায় চলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে তাঁদের কাটাকুটি। চুক্তির বাইরে কথা বলার সময়ই নেই কারও। পরশু গভীর রাতে সেই ব্যস্ততা থেকেই কিছু সময় বের করে পাকিস্তানের সাবেক উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান মুঠোফোনে সময় দিলেন প্রথম আলোকে। কথা বললেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্তানের ব্যর্থতা, আধুনিক ক্রিকেটের হাইব্রিড মডেল, বাংলাদেশের ক্রিকেট আর বিপিএল নিয়েও—
২৯ বছর পর পাকিস্তানে আইসিসির কোনো ইভেন্ট হচ্ছে। কিন্তু ঘরের মাঠের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্তানই সেমিফাইনাল খেলতে পারছে না। কতটা হতাশার এটা?
কামরান আকমল: টুর্নামেন্টের জন্য পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড যে দল ঘোষণা করেছিল, সেটাতে কোনো কম্বিনেশনই ছিল না। দলে একজনমাত্র বিশেষজ্ঞ ওপেনার ছিল, ফখর জামান। সেও প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয় বলেই চোটে পড়ে। দলে খুব বেশি স্পিনারও ছিল না। টুর্নামেন্টটা এশিয়ায়, স্কোয়াডে অবশ্যই দুই-তিনজন বিশেষজ্ঞ স্পিনার থাকা দরকার ছিল। এখানে স্পিনারদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্য দলগুলোকে দেখুন… ভারত ৫ জন স্পিনার নিয়ে খেলছে। পাকিস্তান কেন তা করল না? তিন বছর ধরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে আমরা মাঝের ওভারের বোলিং নিয়ে সমস্যায় আছি। ২০ ওভার পরই দেখা যাচ্ছে বোলারদের হাত থেকে মোমেন্টাম ছুটে যাচ্ছে। ভালো স্পিনারের অভাবেই এটা হচ্ছে। যেকোনো সাদা বলের ক্রিকেটেই পাকিস্তান দলে অন্তত দুজন বিশেষজ্ঞ স্পিনার ও একজন ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার প্রয়োজন। টিম কম্বিনেশনে গলদ ছিল বলেই ওরা ভালো খেলতে পারেনি।
পাকিস্তানের ব্যাটিং নিয়ে কী বলবেন? চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কন্ডিশন অনুযায়ী তো সেটাও ভালো হয়নি…
কামরান: এ রকম ব্যাটিং দেখে আসলেই আমি অবাক হয়েছি। এটা ২০২৫ সাল, কিন্তু পাকিস্তান যেন ’৯০-এর দশকের ব্যাটিং করল! আমি বুঝি না এ রকম ব্যাটিংয়ের মানে কী! অন্য দলগুলোর ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকান, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে ওরা। পাকিস্তান সেটা খেলতে পারেনি। তারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে হবে তাই খেলেছে, আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার মতো। কোনো ইন্টেন্ট ছিল না, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার মতো সচেতনতা ছিল না, অ্যাপ্রোচও ভালো ছিল না। বর্তমান সময়ে সাদা বলের ক্রিকেটে আমি বিশ্বাস করি না কন্ডিশন খুব বড় বিষয়। মানসিকতাটাই আসল। সবকিছুই পেশাদারভাবে করতে হবে। পাকিস্তান দলের সমস্যা হলো তারা পেশাদারি মানসিকতা নিয়ে খেলে না।
আপনার দৃষ্টিতে বাবর আজম পাকিস্তানের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। তার পারফরম্যান্সে কতটা সন্তুষ্ট হয়েছেন?
কামরান: আমি এখনো বিশ্বাস করি বাবর আজম পাকিস্তান দলের ১ নম্বর ব্যাটসম্যান। ক্লাস ইজ পারমানেন্ট, ফর্ম ইজ টেম্পোররি। কাজেই মূল জায়গাটাতে যেতে হবে। ৭-৮ বছর ধরে সে কীভাবে পারফর্ম করেছ, বড় বড় দলের বিপক্ষে অনেক রান করেছ...সেসব ভিডিও দেখো, নিজের ব্যাটিং দেখো, খেলার ধরন দেখো। সব খেলোয়াড়ের জীবনেই বাজে সময় আসে। পাকিস্তানের এক নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে তাকে অবশ্যই ভালো খেলতে হবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি পেশাদার দল একজন মাত্র ব্যাটসম্যানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে পারে না। দল হিসেবেই খেলতে হবে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা—ওরা কিন্তু কোনো একজনের ওপর নির্ভর করে থাকে না।
মোহাম্মদ রিজওয়ানের নেতৃত্বও সমালোচনার মুখে পড়েছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। তাঁর অধিনায়কত্বকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কামরান: রিজওয়ানের অধিনায়কত্ব অতটা ভালো হয়েছে বলব না। আবার এত তাড়াতাড়ি অধিনায়ক বদলও করা যায় না। তবে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। টেস্ট ও ওয়ানডের জন্য আলাদা ও টি-টোয়েন্টির জন্য আলাদা দল গড়তে হবে। টি-টোয়েন্টির জন্য নতুন অধিনায়ক নিতে হবে। রিজওয়ান আমাদের মূল খেলোয়াড়। তিন সংস্করণেই খেলালে তার চোটে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। আমার মতে, সে টেস্ট এবং ওয়ানডেই শুধু খেলুক। টেস্টে সব ম্যাচ খেলানো হোক, ওয়ানডে শুধু বড় দলের বিপক্ষে। এমনিতে সে ভালো অধিনায়ক। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অনেক সময় ভালো বা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ১৫ জনের দলটা ভালো হওয়া দরকার ছিল। আমার মনে হয় সেখানে রিজওয়ান নির্বাচকদের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেছে। অধিনায়ককে নেতৃত্ব দিতে হয়, দল জেতাতে হয়। আমি মনে করি, টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের অন্য কাউকেই দেওয়া উচিত।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির স্বাগতিক হয়েও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা পাকিস্তানকে দুবাইয়ে গিয়ে খেলতে হলো। এত বছর পর আইসিসির টুর্নামেন্ট পেয়েও সেটার অর্ধেক আয়োজন করতে হলো দুবাইয়ে। পাকিস্তানের একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে এটাকে কীভাবে নিচ্ছেন?
কামরান: অনেক বছর পর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজন করাটা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের অসাধারণ এক অর্জন। পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষ এতে খুব খুশি। হ্যাঁ, হতাশা তো অবশ্যই আছে। কেন এমন হচ্ছে, কেন আমরা এভাবে খেলছি, কেন আমরা খেলা নিয়ে যুদ্ধ করছি; আমি মনে করি, আলোচনার টেবিলে বসে সেটা ভারত ও পাকিস্তান সরকারকেই বুঝতে হবে। এতে দুই দলের সমর্থকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের কোনো সমর্থক বা কেউই হাইব্রিড মডেল নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষ এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের জন্যও এটা বেদনাদায়ক। ১০-১২ বছর ধরেই ভারতের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। আমরা শুধু আইসিসির টুর্নামেন্টেই খেলছি, দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলছি না। দুই দেশের সরকারকে আলোচনার মাধ্যমেই এটার সমাধান খুঁজতে হবে।
আপনি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে ভারতের অবস্থানের পরও কি আপনার মনে হয় ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রতি পাকিস্তানের মানুষের এই ভালোবাসা থাকবে?
কামরান: পাকিস্তানের মানুষ ভারতীয় ক্রিকেটারদের পছন্দ করে, এটা আমার মতামত। তবে আপনি ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের জিজ্ঞেস করুন, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের জিজ্ঞেস করুন; সবাই পাকিস্তানে খেলতে পছন্দ করে। আমাদের গ্যালারিতে দর্শকেরা দুই দলকেই সমর্থন জানায়। বিরাট কোহলির মতো সুপারস্টারকে পাকিস্তানে খেলতে দেখতে এ দেশের প্রতিটা মানুষই চাইবে। আমার বিশ্বাস, বিরাট কোহলি আরও খেলবে। কে জানে পাকিস্তানের মানুষও হয়তো তাকে পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে দেখবে।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের খেলা কেমন দেখলেন?
কামরান: বাংলাদেশের ক্রিকেট আমি দেখি। আমি নিজেও বাংলাদেশে গিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি, বিপিএলে খেলেছি। আমার অবাক লাগে, দলটা ওপরের দিকে যেতে যেতে কেন একটা জায়গায় হঠাৎ থেমে গেল! বাংলাদেশের ক্রিকেট ভালো চলছে বলেই জানি। খেলোয়াড়েরা বিপিএল এবং অন্যান্য বিদেশি লিগে খেলছে। তাহলে কেন তারা এগোচ্ছে না? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা দল হয়ে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। ক্রিকেট কোনো ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের খেলা নয়। এ ছাড়া ঘরোয়া চার দিনের ক্রিকেটটা কঠিন কন্ডিশনে হওয়া উচিত। সিমিং কন্ডিশনে খেলতে হবে। মিরপুরের বাইরের ভেন্যুগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশন ও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের উইকেট বানিয়ে খেলাতে হবে। ঘরোয়া লাল বলের ক্রিকেটটা খেলোয়াড়েরা কীভাবে খেলছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। লাল বলের ক্রিকেটকে গুরুত্ব দিলে অন্য সংস্করণেও উন্নতি আসবে। সবাই এখন টি-টোয়েন্টি নিয়েই ভাবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও সেটাই সমস্যা মনে হচ্ছে।
একসঙ্গে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার শেষ দিকে পৌঁছে গেছেন। নতুনরা আসছেন। এ রকম সময় দলটার জন্য কী পরামর্শ থাকবে আপনার?
কামরান: সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, এর আগে ছিল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি—এরা সবাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্পদ। ওদেরকে ঘরোয়া ক্রিকেটে কাজে লাগাতে হবে। অন্য ক্রিকেটারদের তাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ দিতে হবে। ভবিষ্যতে তাদের অধীনে কোচিং করাতে হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভালো ভবিষ্যতের জন্যই তাদের অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগানো উচিত। এরা সবাই ভালো পারফরমার, চাপের মধ্যে দেশের ক্রিকেটকে ভালো কিছু এনে দিতে পেরেছে। তাদের কাছ থেকে সেটাই শিখতে হবে অন্যদের, যাতে তাদের শূন্যতা পূরণ করতে পারে। প্রয়োজনে ক্যাম্প আয়োজন করে তাদের একসঙ্গে রেখে অভিজ্ঞতা বিনিময় করাতে হবে।
একসময় বিপিএলে খেলেছেন, এখন নিশ্চয়ই দূর থেকে দেখছেন। এবার টুর্নামেন্টে তারকা বিদেশি ক্রিকেটাররা খেলেননি। এই টুর্নামেন্ট সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
কামরান: বিপিএলকে সবার আগে সংশ্লিষ্ট সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। বিশেষ করে টাকাপয়সা আর চুক্তির ব্যাপারে। এ বছর শুনেছি অনেক খেলোয়াড় এসব নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে চিটাগং যেটা করেছে, সেটা ঠিক করেনি। একটা দেশের ক্রিকেটের জন্য এসব ভালো জিনিস নয়, ভালো দেখায় না। ক্রিকেটারদের সঙ্গে এসব পেশাদারভাবেই হওয়া উচিত। বিপিএল একটা আন্তর্জাতিক লিগ। বিসিবির উচিত খেলোয়াড়দের সঙ্গে এসব নিয়ে সরাসরি কথা বলা, তাদের যেটুকু করার আছে সেভাবে সমস্যার সমাধান করা। বড় রানের ম্যাচ যেন নিয়মিত হয়, সেটাও দেখতে হবে। ১৮০-২০০ রানের উইকেট বানাতে হবে।
শেষ প্রশ্ন—চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে কারা খেলবে মনে করেন?
কামরান: একটা তো অবশ্যই ভারত। ব্যাটিং, বোলিং সব দিক দিয়েই শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ দল। ফিল্ডিংও অসাধারণ। আরেক সম্ভাব্য ফাইনালিস্ট বলব দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তারাও বেশ ভালো দল। আমার ধারণা, এই দুটি দলই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে খেলবে।