সাইফুল বারী
সাইফুল বারী

‘উনি শ্রীলঙ্কার মানুষ তো, লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছেন’ 

এমন ফাইনাল ফুটবল ইতিহাসেই আর হয়েছে বলে মনে হয় না। গত পরশু অনূর্ধ্ব–১৯ সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালকে এমন অনন্য বানিয়ে দেওয়ার ‘কৃতিত্ব’ শ্রীলঙ্কান ম্যাচ কমিশনার ডি সিলভা জয়াসুরিয়া দিলানের। তাঁর অবিশ্বাস্য এক ভুলেই অনেক নাটকের পর যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করতে হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতকে। এই ফাইনালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশ নারী দলের কোচ সাইফুল বারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র

প্রশ্ন

প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন। মেয়েদের দলের কোচ হিসেবে প্রথম শিরোপা, সেটিও আবার এমন মহানাটকীয় এক ফাইনালের পর...অনুভূতিটা জানতে চাই।

সাইফুল বারী: দায়িত্ব পালন করতে পারার অনুভূতিটাই বড়। আমরা আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন, শিরোপাটা ধরে রাখতে পেরেছি, এটাই আসল। ব্যক্তিগত অনুভূতি সেভাবে নেই। আর ফাইনালে যেটা হয়েছে, সাধারণভাবে জিতে গেলে বা টাইব্রেকারে জিতে গেলেও হয়তো আরেকটু সুখকর হতো। ভারতকে দুবার হারানো যেত। তারপরও অনুভূতিটা ভালো।

প্রশ্ন

এত বছরের খেলোয়াড়ি জীবন, কোচিং ক্যারিয়ারও তো কম দিনের নয়—তারপরও এমন ফাইনালের অভিজ্ঞতার ধারেকাছেও নিশ্চয়ই কিছু নেই।

সাইফুল: (হাসি) তা তো বটেই। আমি কিন্তু এর আগেও এ ধরনের টাইব্রেকারে জড়িত ছিলাম। ২০২১ সালে ফেডারেশন কাপের গ্রুপ ম্যাচে আমি শেখ রাসেলের কোচ ছিলাম। ঢাকা আবাহনীর সঙ্গে টাইব্রেকারে ১৫টা করে পেনাল্টি মারতে হয়েছিল। ১১ জন মারার পর আবার রিপিট হয়েছিল। ভুল হতেই পারে, তবে একজন ম্যাচ কমিশনারের ফাইনালে এমন ভুল করাটা কী বলব...অবিশ্বাস্যই বলি। কারণ, এ ধরনের ঘটনা তো নতুন না। আপনার মনে আছে কি না, আফ্রিকান নেশনস কাপের ফাইনালে ঘানা আর আইভরি কোস্টের ম্যাচেও এমন হয়েছিল। তো এই ফাইনালে ১১টি করে শট হয়ে যাওয়ার পর আমি আমাদের গোলকিপারকে বোঝাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের অধিনায়ক প্রান্তি, মানে আফঈদাকে রেফারি ডেকে নিয়ে গেলেন টসের জন্য। ও তো ছোট মানুষ, ভেবেছে আবার শুরু হবে, কে আগে মারবে এ জন্যই হয়তো টস। এটা এত দ্রুত ঘটেছে, আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারিনি। হঠাৎ দেখলাম ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন দৌড় দিয়েছে, তখন ভাবলাম ঘটনা কী! আসলে এটা তো ম্যাচ কমিশনারের দায়িত্ব, বাইলজ তাঁরই জানার কথা। আমরা তো একটু কনফিউজড হবই, তাহলে বাইলজে এমন কিছু আছে কি না।

ম্যাচ কমিশনার অধিনায়ক আফঈদাকে ডেকে নিয়ে যান টস করার জন্য। ছবিতে টসের সেই মহূর্ত
প্রশ্ন

এরপর যা হলো, সেটিকে কীভাবে বর্ণনা করবেন?

সাইফুল: বলার মতো ভাষা নেই। জীবনে কোনো ম্যাচ শেষ করে এতক্ষণ মাঠে থাকতে হয়নি। তবে একটা কথা বলে নিই, ম্যাচটা তো আমরা ভালো খেলিনি। আমি যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম, প্রথমার্ধে তা একদমই কাজ করেনি। ভারত বেশ ভালো খেলছিল। ম্যাচটা একটু অন্যদিকে ঘোরানো যায় কি না, এ জন্য আমি চারজনকে বদল করেছি। আমাদের ক্যাপ্টেন আফঈদা ডিফেন্ডার, ওকে বলেছি, তুমি ওপরে স্ট্রাইকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। ওদের ৪ নম্বর প্লেয়ারটা লম্বা তো, ও তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে একটা সুযোগ চলে আসতে পারে। লাকিলি, আমরা সাগরিকার একটা স্পেশাল গোল পেয়ে গেলাম। এরপর ১১টি পেনাল্টির স্নায়ুর চাপ। জিতব–জিতব, আমাদের গোলকিপার একটা সেভ করল, সেটা আবার ও গোললাইন ছেড়ে আগেই বেরিয়ে আসায় বাতিল হয়ে গেল। কী বলব, এমন অভিজ্ঞতা আমার জীবনে হয়নি।

প্রশ্ন

আচ্ছা, টস করার আগে ম্যাচ কমিশনার দুই অধিনায়ক বা আপনাদের বলেনি যে টসের মাধ্যমে শিরোপার মীমাংসা হবে?

সাইফুল: এটা আমি ঠিক বলতে পারব না, ওখানে কী বলেছে কী বলেনি। তবে আমাদের, মানে কোচ বা ম্যানেজারকে কিছু বলেনি। আর জিনিসটা তিনি খুব তড়িঘড়ি করে করে ফেলেছেন। আমার মনে হয়, ম্যাচ কমিশনারও বোরড হয়ে যাচ্ছিল, আর কত...(হাসি)

১১–১ সমতায় শেষ হয় লম্বা টাইব্রেকার। ম্যাচ কমিশনার কি এতে ম্যাচ থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন
প্রশ্ন

ভদ্রলোকের দেশে ফেরার ফ্লাইট ধরার তাড়াই ছিল কি না...

সাইফুল: (হাসি) কে জানে...

প্রশ্ন

টসের পরই তো আসল নাটক। আবার টাইব্রেকার হবে শুনে ভারত মাঠ ছেড়ে চলে গেল, আপনারা মাঠে বসে থাকলেন—ওই সময়টার কথা যদি বলেন।

সাইফুল: টসে জিতে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা যখন উদ্‌যাপন করছে, তখন তো আমাদের প্লেয়াররা খুব মন খারাপ করে ছিল। পরে যখন বলা হলো, বাইলজে টস নেই, আবার টাইব্রেকার হবে, তখন ওদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। টাইব্রেকার শুরুর আগে যেটা বলেছিলাম, সেটাই আবার বললাম। টাইব্রেকারে আসল ব্যাপার হলো ফোকাস। যেকোনো একটা পাশে মারলেই গোল পাবে, কারণ পুরো গোলপোস্ট কাভার করা ছেলেদের জন্যই মুশকিল আর মেয়েদের জন্য তো আরও বেশি। গোলকিপার স্বর্ণার সঙ্গেও কথা বললাম। আমার মনে হচ্ছিল, এর আগেও কয়েকবার ও আগেই বেরিয়ে এসেছিল। যেগুলো গোল হয়েছে, সেগুলো রেফারি রিপিট দেয়নি। যেটা ঠেকিয়েছে, সেটাই দিয়েছে। ওকে তাই বললাম, শেষ মুহূর্তে একটা পা গোললাইনের পেছনে রাখতে হয়। এসবের বাইরে সবাইকে একটু চিয়ার আপ করার চেষ্টা করছিলাম আরকি।

সাগরিকা। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলে নতুন তারকা
প্রশ্ন

সাগরিকা সম্পর্কে একটু জানতে চাই। এই মেয়েটা তো মনে হয় স্পেশাল। অমন একটা চাপে যেভাবে বলটা নিয়ে গোলটা করল, দারুণ!

সাইফুল: সাগরিকার মূল শক্তি হলো ওর গতি। বল পায়ে যেমন, বল ছাড়াও। শারীরিকভাবে ওকে খর্বাকৃতিই বলা যায়, বড় বড় শরীরের অন্যদের সঙ্গে তো ওর পারার কথা না। কিন্তু ওর মেধা...আর আপনি যেটা বললেন, গোলের সামনে ওর ফার্স্ট টাচ, বল পায়ে গতি—এসব দারুণ। বড় ফুটবলার হওয়ার সব সম্ভাবনাই ওর আছে। তবে আমি চাই, এই বয়সের খেলোয়াড়দের নিয়ে বেশি মাতামাতি না হোক। এ জন্য ওদেরকে একটু আগলে রাখার চেষ্টা করি। যদিও এই ডিজিটাল যুগে তা ঠেকানো খুব কঠিন। এতে কী হয়, ওরা একটা সময় চ্যালেঞ্জ খুঁজে পায় না। মনে করে, আমার তো সব পাওয়া হয়েই গেছে। এ ধরনের খেলোয়াড় পেলে ভালো লাগে। আমরা এই টুর্নামেন্টের আগে সিনিয়র টিমের সঙ্গে চারটি ম্যাচ খেলেছি। ওই ম্যাচগুলোতেও সাগরিকা ভালো খেলেছে। আমার মনে হয়, পরিশ্রমটা ধরে রাখলে মেয়েটা অনেক ভালো করবে।

বল পায়ে কিংবা বল ছাড়াই দুর্দান্ত গতি সাগরিকার
প্রশ্ন

আচ্ছা, ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে? কিছু বলেছেন তাঁকে?

সাইফুল: না, আমি ম্যাচ কমিশনারের কাছে যাইনি। ডাগআউটেই ছিলাম। কী আর বলব, উনি শ্রীলঙ্কার মানুষ তো, লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছেন (হাসি)। আগেই বলেছি, যা হয়েছে, তা আসলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি শুধু বলব, উনি খুব খারাপ করেছেন। উনি ম্যাচ কমিশনার, বাইলজটা তো ঠিকমতো পড়বেন।