সাক্ষাৎকার

'নেপথ্যের মাশরাফি'র নেপথ্য গল্প

অধিনায়ক মাশরাফি তো বটেই মানুষ মাশরাফিতেও মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ছবি: শামসুল হক
অধিনায়ক মাশরাফি তো বটেই মানুষ মাশরাফিতেও মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ছবি: শামসুল হক

প্রাতঃস্মরণীয় সুকুমার রায়ের কাছ থেকে ধার করে যদি বলি, ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বিড়াল’, তাহলে একটু বাড়াবাড়ি হয়। ভোজবাজির মতো এতটা বদল তো হয়নি! হ্যাঁ, বদল একটা হয়েছে। ভণিতা না করে স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়—হওয়ার কথা ছিল আমার লেখা, হয়ে গেল মাশরাফির সাক্ষাৎকার।

সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলো ঈদসংখ্যায়। ‘নেপথ্যের মাশরাফি’ শিরোনামের ওই সাক্ষাৎকারের নেপথ্যেও একটা গল্প আছে। মাশরাফিকে নিয়ে লিখতে বসে লেখার বদলে সেটির মাশরাফির সাক্ষাৎকার হয়ে যাওয়ার গল্প। অথচ শুরুতে চিন্তাটা এমন ছিল না। প্রথম আলো ঈদসংখ্যা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ আমার লেখাই চেয়েছিলেন। বিষয়টাও পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, যেটি হয়তো ছিল তাঁর আগাম ভেবে রাখা শিরোনামও—নেতা মাশরাফি।

অধিনায়কত্ব মাশরাফি আগেও করেছেন। তবে সর্বশেষ ওয়ানডে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ দলের যে বিস্ময়কর রূপান্তর; বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পর দেশের মাটিতে একের পর এক পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রূপকথাসম সাফল্য—সেটিরই রহস্য উন্মোচন করার কথা ছিল ওই লেখাতে।

‘অধিনায়ক মাশরাফি’ না বলে সাজ্জাদ শরিফ যে লেখার বিষয় হিসেবে বলেছিলেন ‘নেতা মাশরাফি’, তাতেই বলা হয়ে গিয়েছিল তিনি শুধু মাশরাফির অধিনায়কত্বের ট্যাকটিক্যাল দিক নিয়ে আলোচনা চাইছেন না। চাইছেন মাশরাফি বিন মর্তুজার সামগ্রিক চরিত্র ফুটে ওঠে, এমন একটা লেখা। যেটি বুঝিয়ে দেবে মাশরাফির নেতৃত্বের মহিমা।

ক্রিকেট অধিনায়ককে বুঝতে যেটি খুব জরুরিও। মাঠে ক্রিকেট অধিনায়কের অধিনায়কত্বটুকু সবাই দেখে। কিন্তু অধিনায়কত্বের আসল কাজটা তো হয় পর্দার আড়ালে। এখানে বলা উচিত, মাঠের বাইরে। তা এটি নিয়ে লেখা আর এমন কী কঠিন! মাশরাফিকে দেখে আসছি প্রায় দেড় যুগ। ক্রিকেটার মাশরাফি, অধিনায়ক মাশরাফি, মানুষ মাশরাফি—এর যেকোনো একটা বিষয় নিয়েই তো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ফেলতে পারি। আর এই লেখায় তো তিনটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এ জন্য তেমন গবেষণারও প্রয়োজন নেই। সব তো জানাই, বসলেই তরতর করে লেখা এগিয়ে যাবে।

কিন্তু লিখতে বসে টের পেলাম, যতটা সহজ ভেবেছিলাম, কাজটা তত সহজ নয়। কয়েকটা লাইন লেখার পর দেখি লেখা আর এগোয় না। মাশরাফি সম্পর্কে বেশি জানি বলেই সমস্যা হলো কি না, কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা লিখি, বুঝতে পারছি না। মাথাটা পরিষ্কার করার জন্য ঠিক করলাম, একবার মাশরাফির সঙ্গে কথা বলে নিই। এত বছরের সম্পর্কের কারণে যেটি একদমই কঠিন কিছু নয়। ১০–১৫ মিনিটে হবে না, এক–দেড় ঘণ্টা, প্রয়োজনে এর চেয়েও বেশি সময় একান্তে কথা বলতে চাই—এই চাওয়াতেও মাশরাফি সানন্দে রাজি। কিন্তু কখনো তাঁর ব্যস্ততা, কখনো বা আমার—ব্যাটে–বলে আর হয় না। এদিকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে মাশরাফির ইংল্যান্ড–যাত্রার দিন ঘনিয়ে আসছে। একদিন সন্ধ্যায় তাই ফোন দিয়ে বললাম, ‘তুমি কোথায় আছো বলো, আজই কথা বলতে হবে।’

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মাশরাফির দেওয়া ঠিকানা খুঁজে মিরপুরের এক ছয়তলা বাড়িতে। নিচেই দেখা এক তরুণের সঙ্গে। হাতে গিটার, কেয়ারটেকারের কাছে মাশরাফির খোঁজ করছেন। ঘটনা কী? সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে রোমাঞ্চিত ওই তরুণ জানালেন, তাঁর অনেক দিনের একটা স্বপ্ন আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। মাশরাফিকে নিয়ে একটা গান লিখেছেন। সেটি মাশরাফিকে শোনাতে চান। আমি একটুও উৎসাহ দেখালাম না। বরং মাশরাফিকে একান্তে পাওয়ায় বাধা বলে উটকো ঝামেলাই মনে হলো ওই তরুণকে।

মাঠের বাইরে মাশরাফি মানেই তাঁকে ঘিরে বন্ধুদের একটা বৃত্ত। ছয়তলার চিলেকোঠায় যথারীতি বন্ধু পরিবৃত মাশরাফির দেখা মিলল। টেলিভিশনে কী একটা ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। সেটিতে চোখ রেখে চলছে তুমুল আড্ডা। গিটার হাতে ওই তরুণ আমার সঙ্গেই ঘরে ঢুকেছেন। মাশরাফিকে চর্মচক্ষে দেখতে পাওয়ার আনন্দে তাঁর প্রায় মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। মাশরাফি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। আবেগে থরথর ওই তরুণ ‘আপনাকে নিয়ে আমার গানটা আজ শোনাবই’ বলে গিটার বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। গানটা ভালোই হয়েছে, ছেলেটার গলাও খারাপ না। কিন্তু আমি তখন ঠিক তা উপভোগ করার মতো অবস্থায় নেই। ঈদসংখ্যার লেখাটার রসদ জোগাড়ের জন্য লম্বা একটা আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা, সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে প্রথম আলোর ম্যাগাজিনের জন্য বড় একটা সাক্ষাৎকারও নিতে হবে। অনেক সময় লাগবে। একই সঙ্গে গীতিকার–সুরকার–গায়ক—থ্রি ইন ওয়ান এই তরুণ বিদায় হলে বাঁচি।

মাশরাফিকে নিয়ে নিজের আবেগের কথা জানিয়ে, তাঁকে নিয়ে লেখা গানের সিডি উপহার দিয়ে একসময় তিনি বিদায় হলেন ঠিকই, কিন্তু মিনিটখানেকের মধ্যে আরেকজন এসে হাজির। এবারের দর্শনার্থী আট–নয় বছরের এক শিশু। সঙ্গে তার বাবা। কানাডায় থাকেন। ছেলে মাশরাফি বলতে পাগল। ওই শিশুও আরেক থ্রি–ইন–ওয়ান। মাশরাফিকে নিয়ে গান লিখে নিজেই সুর দিয়ে সারা দিন তা গেয়ে বেড়ায়। মাশরাফিকে সেই গানও শুনতে হলো। আমার তো না শুনে উপায় নেই। ভক্তদের অত্যাচার সারা জীবনই হাসিমুখে সয়ে এসেছেন মাশরাফি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না।

এই পর্বও একসময় শেষ হলো। ততক্ষণে রাত প্রায় নয়টা। মাশরাফিকে মজা করে বললাম, ‘আজ তো মনে হচ্ছে “মাশরাফি সংগীত রজনী”! তা এরপর আর কজন আছে?’ মাশরাফি তাঁর ভুবনভোলানো হাসিটা দিয়ে বললেন, ‘আর কেউ নেই, এবার আপনি চাইলে একটা গাইতে পারেন।’

আমি মাশরাফির অনুরোধ রাখার কোনো কারণ দেখলাম না। কারণটাও বললাম, ‘এত বড় শাস্তি তোমার প্রাপ্য নয়।’ বন্ধুদের আড্ডা থেকে মাশরাফিকে বের করে পাশের খোলা ছাদে গিয়ে বসলাম। এর আগেই জেনেছি, এই বাড়িটা মাশরাফির আড্ডার জায়গা। তাঁর নিজেরই বাড়ি। আইপিএলের টাকায় কেনা। ওই যে যেবার দুই নায়িকা জুহি চাওলা ও প্রীতি জিনতার টানাটানিতে ৬০ লাখ ডলারে উঠে গিয়েছিল মাশরাফির দাম। মিরপুরে মাশরাফির নিজের ফ্ল্যাটের মতো এই বাড়িতেও সবার অবারিত দ্বার। নড়াইল থেকে নানা কাজে যাঁরা ঢাকায় আসেন, তাঁদের জন্য তো ‘অলিখিত হোটেল’!

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে সাক্ষাৎকারটা দ্রুতই শেষ করে ফেললাম। এরপর শুরু হলো অধিনায়ক মাশরাফি আর মানুষ মাশরাফিকে নিয়ে আড্ডা। দেশে মাশরাফির সঙ্গে খুব নিয়মিত দেখা হয় না। তবে ট্যুরে বেশির ভাগ সময় একই হোটেলে থাকার সুবাদে একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটে। মাশরাফির একটু ভিন্নরকম জীবনবোধের সঙ্গে তাই আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সেটি যে কিছুটা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া, মাশরাফির বাবা গোলাম মোর্ত্তজাকে চিনি বলে জানা ছিল তা–ও। তারপরও শুধুই এই বিষয় নিয়ে মাশরাফির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি রীতিমতো মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। পেশাদার সাংবাদিক হয়েও ক্রিকেটার মাশরাফির বরাবরের ভক্ত। মানুষ মাশরাফিতে মুগ্ধতাও নতুন কিছু নয়। তবে সেই রাতে চেনা মাশরাফিকে যেন আবারও নতুন করে চিনলাম। জীবন সম্পর্কে তাঁর আপাত সরল চিন্তাভাবনাতেই কী গভীর ব্যঞ্জনা! মানবীয় মূল্যবোধের জায়গাগুলোতে এত পরিষ্কার যে এ নিয়ে তাঁর কথাগুলো যেন আদর্শ জীবনবোধ নিয়ে লেখা কোনো বই থেকে উদ্ধৃতি। আর সেসব বলছেন কিনা একজন ক্রিকেটার!

তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, মাশরাফিকে নিয়ে যদি লিখি, সেটি পরে কখনো লেখা যাবে। আপাতত মাশরাফি যা বলছেন, সেটিই মানুষকে জানানো বেশি দরকার। আমার কথা দিয়ে জায়গা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ঈদসংখ্যা সম্পাদককে পরিবর্তিত পরিকল্পনা জানানোর পর প্রথমে তাঁকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। বুঝতে পেরে আমি বললাম, ‘আমি সাক্ষাৎকার ফর্মেই লেখাটা দিই, আপনি পড়ে সিদ্ধান্ত নিন।’

পড়ার পর সিদ্ধান্ত কী হবে, তা নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয়ই ছিল না। ঈদসংখ্যায় মাশরাফিকে নিয়ে আমার লেখার পরিবর্তে মাশরাফির সাক্ষাৎকারই ছাপা হলো। এই লেখাটা শুরু করার আগে যে সাক্ষাৎকারটা আবারও পড়লাম। নতুন করে আচ্ছন্ন করে দিল পুরোনো উপলব্ধিটাই—ক্রিকেটার হিসেবে মাশরাফি তো বড়ই, মানুষ হিসেবে হয়তো আরও বড়।