>পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা। আকসু প্রতিনিধিদের কাছে ২০১৩ বিপিএলে ম্যাচ পাতানো ও স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেন আশরাফুল। ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা আগামীকাল ১৩ আগস্ট শেষ হচ্ছে। ৩৪ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান এই মুহূর্তে আছেন লন্ডনে। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা, নিজের উপলব্ধি আর ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনের মুখোমুখি হলেন তিনি
* এই মুহূর্তে লন্ডনে কী করছেন?
আশরাফুল: ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ম্যাচ খেলছি। ফিটনেস নিয়ে কাজ করছি। আগামী বিশ্বকাপে হবে এখানে। জাতীয় দলে খেলা নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটা উঠে যাচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার লক্ষ্য ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলা।
* জাতীয় দলের প্রসঙ্গে পরে আসছি। যেটা বলছিলেন, অবশেষে পুরোপুরি মুক্তি পেতে যাচ্ছেন নিষেধাজ্ঞা থেকে—নিশ্চয়ই ভীষণ স্বস্তি দিচ্ছে বিষয়টা?
মোহাম্মদ আশরাফুল: এই দিনটার জন্য গত সাড়ে ৫ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। পুরোপুরি মুক্ত হব কবে, পুরোপুরি খেলায় ফিরতে পারব কবে, জাতীয় দলে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত হব কবে—এমন ভাবনা কাজ করেছে অনেক দিন। অবশ্যই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। অবশ্য গত দুই বছর ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও লিস্ট ‘এ’ খেলছি। নিষেধাজ্ঞা ছিল জাতীয় দল ও বিপিএলে। দুটিই পুরোপুরি কেটে যাচ্ছে। খুবই ভালো লাগছে।
* ব্যক্তিগত কিংবা খেলোয়াড়ি জীবন—দুটিই কতটা কঠিন ছিল এই সাড়ে পাঁচ বছর?
আশরাফুল: শুধু আমার নয়, কঠিন সময় গেছে আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু—সবারই। খেলাটা ভীষণ ভালোবাসি, ছোটবেলায় মাদারটেক থেকে ধানমন্ডি হেঁটে হেঁটে অনুশীলনে যেতাম। অনেক পরিশ্রম করে ক্রিকেটার হয়েছি। গত সাড়ে পাঁচ বছর নিষিদ্ধ ছিলাম কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনো ম্যাচ নেই, যেটা আমি দেখিনি। খেলতে পারিনি—একটা কঠিন সময় তো গেছেই। নিষেধাজ্ঞার শুরুতে বেশি কঠিন গেছে। এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি।
* নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে হতাশা থেকে কখনো ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার ভাবনা এসেছে?
আশরাফুল: নাহ, কখনোই মনে হয়নি। ওই ঘটনা যখন ঘটেছে, তখন থেকে মনে হয়েছে, আমাকে আবার ফিরতে হবে। আবার দেশকে কিছু দিতে হবে। আমি একটি ভুল করেছি। সেটা স্বীকারও করেছি। সততা থেকে যদি ফের কিছু করতে পারি, সেটাই হবে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। যখন স্বীকার করেছিলাম (স্পট ফিক্সিংয়ের কথা), ওই সময় ভেবেছি যদি আরেকটা সুযোগ পাই কিছু করে দেখাতে হবে। যেহেতু আমি ব্যাটসম্যান। এই সাড়ে পাঁচ বছরে কখনোই মনে হয়নি যে ফিরতে পারব না। কিছুটা সৌভাগ্যবান, দেশে কিংবা দেশের বাইরে ভক্ত-সমর্থকেরা প্রচুর সমর্থন জুগিয়েছেন আমাকে। আগে যখন খেলতাম, ভক্তসংখ্যা যদি ৫০ হয়, স্বীকার করার পর সেটি বেড়েছে অনেক। যারা ভক্ত ছিল না, তারাও এখন অপেক্ষা করছে—ফিরে এসে কেমন করি, সেটা দেখতে। এ-ও সত্যি, অনেকে চান না আমি ফিরি।
* তারা কেন চায় না, আপনি ফেরেন?
আশরাফুল: এমনি শুনেছি। সত্যি কথা বলেছি বলে তারা এত ঘৃণা করে! আর যারা স্বীকার করেনি, তারা তো ঠিকই দাপটের সঙ্গে আছে সব জায়গায়।
* ২০১৩ সালে আপনার স্বীকারোক্তিতে আরও অনেকের নাম এসেছিল, তাঁদের শাস্তি না হওয়াটা কীভাবে দেখেন?
আশরাফুল: এগুলো নিয়ে আমি ভাবি না। নিজের অংশটা নিয়েই ভাবি। যে অন্যায় করেছি, শাস্তি হয়েছে। শাস্তি শেষে যেহেতু নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে, নতুন করে শুরু করতে চাই। অন্যদের কী হলো না হলো, সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না।
* নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে আপনার সবচেয়ে বড় উপলব্ধি কী?
আশরাফুল: যে পরিবারে বড় হয়েছি, আমাদের মূল শিক্ষা হচ্ছে, যেটাই ঘটুক, সেটার ইতি ও নেতিবাচক দুটি জিনিসই চিন্তা করা। আমি একটু অন্য রকম। অনেকে মনে রাখে কে তার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে। আমি অবশ্য এত কিছু মনে রাখি না। অন্যায় করেছি, ক্ষমা চেয়েছি।
* আপনি কি মনে করেন, আগের মতো আপনার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন সতীর্থ, দল কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট?
আশরাফুল: সেটার জন্যই ফিরতে চাইছি। যদি ভালো ভালো ইনিংস উপহার দিতে পারি, তবে যে ভুলটা করেছি, সেটা মানুষ ক্ষমা করতে পারবে।
* এত বড় ঘটনার পরও আপনাকে নিয়ে এখনো মানুষের বেশ আগ্রহ দেখা যায়। অমন একটা ঘটনার পরও এ জনপ্রিয়তা থাকার রহস্যটা কী?
আশরাফুল: যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করি, প্রায় প্রতিটি দলেই কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। বর্তমান সময়েও অনেক দুর্দান্ত খেলোয়াড় আছে। তবে ১০-১৫ বছর আগের ছবিটা যদি মনে করেন, প্রতিটি দলেই ক্ল্যাসিক খেলোয়াড় থাকত। ওই সব দলের বিপক্ষে তখন আমরা সেভাবে জিততে পারতাম না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর টানা চার বছর কোনো ম্যাচই জিততে পারিনি। ২০০০ থেকে ২০০৮-০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশের বেশির ভাগ জয়ে আমার অবদান ছিল। ২০০৪ সালে যে ম্যাচ দিয়ে জয়খরা কাটল, সেটাতেও আমি দ্রুতগতিতে ফিফটি করেছিলাম। মানুষ হয়তো এসব ইনিংসের কথা মনে রেখেছে। আর সব সময়ই চেষ্টা করেছি বড়-ছোট সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে।
* এই যে মানুষ আপনাকে এত পছন্দ করে, নিষেধাজ্ঞার সময়ে কখনো কি মনে হয়নি, তাদের সঙ্গে কেন এ প্রতারণা করলাম?
আশরাফুল: এটা মনে হয়নি। কেন হয়নি বলি, যে শাস্তিটা পেয়েছি, সব স্বীকার করেছি বলে। প্রতারণার মতো কিছু করিনি। কখনোই দলকে হারিয়ে দিইনি। যদি এসব করতাম, তাহলে বলা যেত প্রতারণা করেছি। হ্যাঁ, অন্যায় যে করেছি, সেটি স্বীকার করেই নিয়েছি। তবে ওই অন্যায় করিনি যে...হ্যাঁ, অনেকে আমাকে ঘৃণা করে। সবাই তো আর ভালোবাসবে না। কেউ কেউ ঘৃণা করবে। তবে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, দেশের সঙ্গে কখনো প্রতারণা করিনি। দলকে হারিয়ে দিয়েছি, এমন কিছু কখনো করিনি।
* আপনার কাছে যখন কোনো তরুণ খেলোয়াড় আসে, তাঁদের প্রতি আপনার বার্তা থাকে কী?
আশরাফুল: সংক্ষিপ্ততম সংস্করণের ক্রিকেটে, বিশেষ করে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নানা প্রলোভন, নানা প্রস্তাব আসতে পারে। এ ধরনের লিগে নানা ধরনের লোকজন যেহেতু যুক্ত থাকে, অনেক ধরনের প্রস্তাব থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে সৎ থাকতে হবে, কার সঙ্গে মিশছেন, সেটি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
* জাতীয় দলে ফের সুযোগ পাবেন কি না, সেটা বলা কঠিন। তবে দুয়ার অন্তত উন্মুক্ত হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে আপনি যে দলটি দেখে গিয়েছেন, সেটির সঙ্গে বর্তমান দলের নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। আপনি কি মনে করেন, এই দলে জায়গা পাওয়ার সামর্থ্য আপনার আছে?
আশরাফুল: বাংলাদেশ দল এখন যে আক্রমণাত্মক বা ইতিবাচক ক্রিকেট খেলে, ক্যারিয়ারের শুরুতে এভাবেই খেলেছি। আমি তো কখনো ‘টুক টুক’ ব্যাটিং করিনি। ১৮ বছর আগেই যদি ইতিবাচক ক্রিকেট খেলি, এখন আমার কোনো সমস্যা হবে না। বিশ্বাস করি, এই দলে জায়গা করে নিতে পারব, যদি আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়। এখন যদি কেউ ভাবে ‘আমাকে নেবেই না’, তাহলে তো সুযোগ পাওয়ার প্রশ্ন নেই। গত মৌসুমেও লিস্ট ‘এ’তে পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছি। বাংলাদেশ দল অনেক ভালো খেলছে। কিন্তু ধারাবাহিক ভালো খেলছে কারা? পাঁচ সিনিয়র খেলোয়াড়। জুনিয়ররাও ভালো খেলোয়াড়। তবে আমি মনে করি, অভিজ্ঞতা দিয়ে দলে জায়গা করে নেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।
* এখন মুমিনুল হকের মতো ব্যাটসম্যানই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সুযোগ পাচ্ছে না। সংস্করণ বাছাইয়ের উপায় নেই, পছন্দের ব্যাটিং অর্ডারে খেলারও নিশ্চয়তা নেই। তাহলে জাতীয় দলের কোথায় নিজেকে দেখছেন?
আশরাফুল: আমি তিনে খেলেই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছি। আর কে সুযোগ পাচ্ছে, কে পাচ্ছে না, সেটা আমার ভাবনার বিষয় নয়। সবকিছুই নির্ভর করছে পারফরম্যান্সের ওপর। এটিই সব ঠিক করে দেবে।
* ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেঞ্চুরি নিয়ে বলছিলেন, কিন্তু আপনার ৭৪.১৩ স্ট্রাইকরেট নিয়েও তো কথা উঠেছে। পাশাপাশি আপনার ফিটনেস প্রসঙ্গটাও এসেছে।
আশরাফুল: আমার স্ট্রাইকরেটটা ৯০ থাকলে ভালো হতো। উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে এই ১৫-১৬ ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে পারব আশা করি। ধারাবাহিক ভালো খেললে একটা সুযোগ তো আসতেই পারে।
* ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলার কথা বলছিলেন, প্রায় ছয় বছর বাইরে থেকে এত দ্রুত জাতীয় দলে ফেরা আসলেই সম্ভব?
আশরাফুল: কেন নয়? আরও ১১ মাস আছে। অক্টোবর থেকে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মৌসুম শুরু। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যদি ভালো খেলি, জানুয়ারিতে বিপিএলে ভালো খেলি, কেন সম্ভব নয়? সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ বাদে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কার জায়গাটা পাকা? বাকিরাও ভালো। তবে তরুণদের কারও জায়গা পোক্ত নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেললে অবশ্যই সুযোগ থাকবে।