দেশের একমাত্র উয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ তিনি। কেবল লাইসেন্সের কারণেই নয়, অনেকের চোখেই তিনি দেশের সেরা কোচ। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই কোচ বর্তমানে দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর। দেশের ফুটবলের বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে প্রায়ই সমালোচনামুখর হন মারুফুল। বাফুফের একাডেমি, জাতীয় দল ও ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে তিনি আজ কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে...
কিরগিজস্তান সফরে ৩ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। দলের পারফরম্যান্স সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন ?
মারুফুল হক: গত দু বছর যে রকম দেখে এসেছি, সে রকমই খেলেছে বাংলাদেশ। নির্দিষ্ট কোনো একটা কৌশলে উন্নতি চোখে পড়েনি। যেটা খেলছে সেটা হলো ডিরেক্ট (নিচ থেকে লম্বা পাসে) ফুটবল। যে যেখান থেকে বল পাচ্ছে, সামনের দিকে লম্বা করে বল মারছে। কিন্তু এই কৌশলে খেলার জন্য নাম্বার নাইন হিসেবে যে মানের খেলোয়াড় প্রয়োজন, তা আমাদের দলে নেই। এমনকি আমাদের দেশেই নেই।
তাহলে কৌশলটা কি আমাদের জন্য উপযোগী না?
মারুফুল: কৌশলটা আমাদের জন্য উপযোগী না, সেটা আমি বলব না। খেলোয়াড়েরা হয়তো অনুশীলনে করতে পারে। তাই কোচ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু ম্যাচে গিয়ে তারা পারছে না।
আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, বাংলাদেশের ফুটবলাররা দুর্ভাগা। আমি সরাসরি বলব হতভাগা। যে অল্প বয়সে তাদের ফুটবলের মৌলিক বিষয়গুলো শেখা উচিত ছিল। সেটা পায়নি তারা। এখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। শিখে না আসলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। খেলোয়াড়দের কোনো দোষ নেই। এটা আমাদের ফুটবল অবকাঠামোর দোষ।মারুফুল হক, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ
আপনি নিজেও ২০১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন। এই অঞ্চলের ফুটবল সম্পর্কে আপনার ভালো জানা। সাফে বাংলাদেশের আশা কেমন দেখছেন ?
মারুফুল: আমি অবশ্যই আশাবাদী। ভারত ছাড়া বাকিরা তো আমাদের সমশক্তিরই। আসলে আমি বা কোচ আশা করলে তো হবে না। মাঠে নেমে খেলোয়াড়দের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে হবে। আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, বাংলাদেশের ফুটবলাররা দুর্ভাগা। আমি সরাসরি বলব হতভাগা। যে অল্প বয়সে তাদের ফুটবলের মৌলিক বিষয়গুলো শেখা উচিত ছিল। সেটা পায়নি তারা। এখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। শিখে না আসলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। খেলোয়াড়দের কোনো দোষ নেই। এটা আমাদের ফুটবল অবকাঠামোর দোষ।
শুনেছেন নিশ্চয়ই আজ (কাল) বাফুফে একটা এলিট একাডেমির উদ্বোধন করেছে ...
মারুফুল: প্রশ্নটা হলো এলিট কারা ? এলিট হলো একটা পর্যায়ের সেরা খেলোয়াড়েরা। এখন কথা হলো এটার বাছাই প্রক্রিয়া কেমন ছিল। ৪০ মিনিট দেখে একজন সেরা খেলোয়াড়কে বেছে নেওয়া যায় না। আমার গ্রাসরুটে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন খেলোয়াড়কে হয়তো প্রথম দিনে ভালো লাগেনি; কিন্তু ৩ দিন পর দেখা গেল সেই দলের মধ্যে সেরা খেলোয়াড়। বাছাই প্রক্রিয়াটা আরও লম্বা হওয়া উচিত ছিল। অনেকে বাছাইয়ে ভালো খেলতে পারেন। কিন্তু সে দীর্ঘ মেয়াদি কোচিং নেওয়ার উপযোগী কিনা, সেটা বুঝতে হবে।
বাফুফে একাডেমির কোচদের মান নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মারুফুল: আমি মনে করি তারা যথার্থ উপযোগী নয়। আমি কাউকে ছোট করছি না। আসলে তাঁরা আধুনিক কোচিংয়ের সঙ্গে পরিচিত নয়। সিলেট বিকেএসপি থেকে ৯ মাসে অনেক খেলোয়াড় বের হয়েছে। তারা ভালো। কিন্তু তাদের অনেক সাধারণ ব্যাপারে জানা ছিল না। কারণ তারা ভালো ভাবে শিখতে পারেনি। এই একাডেমি থেকেও দেখা যাবে ওই ধরনের খেলোয়াড় বের হয়ে আসবে।
একাডেমিতে দেখলাম ৪-৩-৩ কৌশলে তাদের খেলানো হচ্ছে। আমাদের জাতীয় দলকে দেখি ৪-২-৩-১ বা ৪-১-৪-১ কৌশলে খেলতে। নতুন করে ৩-৪-৩। জাতীয় দলের খেলার কৌশলের সঙ্গে একাডেমির তো মিল থাকা উচিত !
মারুফুল: শুরুতে ৪-৩-৩ খেলাটা সমস্যা নয়। সমস্যাটা হলো আমাদের কোনো ভিশন নেই। আমাদের খেলার মূল কৌশলটা কী হবে, আমরা কেউ জানি না। আমাদের নিজস্ব কোনো খেলার ধরন নেই। আগে নিজেদের উপযোগী জাতীয় দলের একটা কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। সে অনুযায়ী বয়সভিত্তিক দলগুলো তৈরি হবে। কিন্তু সেটাই তো ঠিক করা যায়নি এত দিনে।
সাফের পরেই অনূর্ধ্ব-২৩ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব। দুটি টুর্নামেন্টের জন্য আলাদা আলাদা কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠন করেছে ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপ। বাংলাদেশ সেটি করতে পারত কিনা ?
মারুফুল: আমাদের একজন যোগ্য টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ( পল স্মলি) আছেন। তাঁর কাজটা কী ? এই পরিকল্পনাগুলো তো তাঁর করা উচিত। তাঁর জানতে হবে সাফে আমাদের লক্ষ্যটা কী ? সেটা আমাদের অর্জন করা সম্ভব কিনা! তাহলে আমি সাফের জন্য সেরা দলটাই দেব। সেখানে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের খেলোয়াড় থাকলে সমস্যা নেই। বাকি খেলোয়াড়দের নিয়ে অনূর্ধ্ব-২৩ দল গঠন করা যেতো। অনূর্ধ্ব- ২৩ বাছাইপর্বে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে অন্য একটা দল পাঠালে জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরি হতো। এখন জাতীয় দলের খেলার সময় কোচকে ভাবতে হবে, আমার তো আবার এর পরেই অনূর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্ট খেলতে হবে। তখন সে দলে আবার পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করে। কারণ সেও তো মানুষ।
প্রিমিয়ার লিগ শেষের পথে। এবারের লিগ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন ?
মারুফুল: প্রতি বছরই উন্নতি হয়। কিন্তু লিগের উন্নতিটা কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে না। সেই উন্নতির প্রভাবটা জাতীয় দলেও পড়ে না। কারণ ঘরোয়াতে খেলোয়াড়েরা প্রতি বছর দল বদল করে। আবার জাতীয় দলের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো অন্যরকম। যেমন সাদ উদ্দিন ক্লাবের হয়ে রাইটব্যাক খেলে জাতীয় দলের হয়ে খেলে উইঙ্গার। মতিন মিয়া খেলে ক্লাবে উইঙ্গার বা স্ট্রাইকারের পেছনে , কিন্তু জাতীয় দলে সে নাম্বার নাইন।
নতুন কোনো সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় চোখে পড়েছে ?
মারুফুল: সম্ভাবনাময় অনেক খেলোয়াড় আছে। কিন্তু তাঁদের নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। যেমন উত্তর বারিধারার পাপন সিং। জাতীয় দলের যে কোনো মিডফিল্ডারের চেয়ে সে ভালো। ওর মধ্যে প্রকৃতি- প্রদত্ত কিছু বিষয় আছে। প্রতিপক্ষ অনেক খেলোয়াড়ের মধ্যে পাপন বল ধরে রাখতে পারে।
বসুন্ধরা কিংস ঘরোয়া ফুটবলে অপরাজেয় হয়ে উঠেছে। সেখানে আপনার দলের বসুন্ধরাকে তিনবার হারানোর রহস্য কী ?
মারুফুল: ওদের খেলাটা খুব সহজে বোঝা যায়। ওদের শক্তিশালী ও দুর্বলতা গুলো খুঁজে বের করা সহজ। কারণ ওরা সব সময় একই ঘরানার ফুটবল খেলে।
ঘরোয়া ফুটবলে বিদেশি কোচের সংখ্যা বাড়ছে। এটা কী স্থানীয় কোচদের ওপর আস্থার অভাব?
মারুফুল: আমি আমার আত্মবিশ্বাস থেকে বলতে পারি, যে কোনো ভালো মানের দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন ফাইট দিতে পারব। আসলে স্থানীয় কোচেরা উপেক্ষিত, তা বলা যাবে না। আগে আমাকে তৈরি হতে হবে। প্রিমিয়ার লিগে একটা দল চালানোর যোগ্যতা থাকতে হবে। সে যোগ্যতা আমার দৃষ্টিতে মাত্র ৪-৫ জনের আছে।