টি-টোয়েন্টির অন্যতম উদ্ভাবনী ক্রিকেটারই বলা যায় বেনি হাওয়েলকে। মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে অন্তত ১০ ধরনের স্লোয়ার বল তো করতে পারেনই, এবারের বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে ইংলিশ এই অলরাউন্ডার স্পিন বোলিংয়েও সফল! আছে ডেথ ওভারে চার-ছক্কা মারার সামর্থ্যও। ছোটবেলা থেকেই একধরনের মানসিক রোগে (এডিএইচডি) ভোগায় ক্রিকেট বিশ্বের বাড়তি আকর্ষণও আছে তাঁর প্রতি। গতকাল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাওয়েল কথা বলেছেন ক্রিকেট এবং তাঁর মানসিক সমস্যা নিয়েও—
বাংলাদেশে সময়টা কেমন কাটছে?
বেনি হাওয়েল: মাঠ ও মাঠের বাইরে এখন পর্যন্ত ভালোই সময় কাটছে। আমরা তিন ম্যাচের মধ্যে দুটিতে জিতেছি। বাংলাদেশের মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ। কোনো অভিযোগের সুযোগ নেই।
মূলত বোলিংয়ের জন্যই আপনার খ্যাতি। এবার তো টানা তিন ম্যাচে তো ভালো ব্যাটিংও করলেন…
হাওয়েল: ব্যাটিং নিয়ে দুই বছর ধরেই পরিশ্রম করছি। এখানে এসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছি, এটা বড় ব্যাপার। পারফর্মও করতে পারছি। আমি যে জায়গায় ব্যাটিং করি, সেখানে সব সময় রান করা সম্ভব নয়। এখন ব্যাটিংটা ভালো হচ্ছে এবং সেটা উপভোগও করছি। ম্যাচের পরিস্থিতিও আমাকে প্রথম বল থেকে মেরে খেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। আমিও এভাবেই খেলতে পছন্দ করি।
এবার তো স্পিন বোলিংও করছেন। এটা কেন?
হাওয়েল: আমি সব সময়ই বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে চাই। ব্যাটসম্যানদের মনে ধাঁধার জন্ম দিতে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বোলিং করার চেষ্টা করছি। এখানেও সেটাই করছি।
স্পিন বোলিংয়ের শুরুটা কীভাবে?
হাওয়েল: দুই বছর ধরে আমি স্পিন নিয়ে কাজ করছি। আমি এখন মিডিয়াম পেসার, পাশাপাশি স্পিনার হিসেবেও দলে অবদান রাখতে পারছি। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে যদি মনে হয় মিডিয়াম পেস ভালো, তাহলে মিডিয়াম পেস করি। যদি স্পিন কার্যকরী হয়, তাহলে স্পিন। আমি দুটিতেই দক্ষ হতে চাই। বিপিএলে এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছে। দেখা যাক চট্টগ্রামের কন্ডিশন কেমন হয়।
এটা কি শুধুই কন্ডিশনের কারণে, নাকি দলের বোলিংয়ের সমন্বয়টাও কারণ?
হাওয়েল: দুটিই, তবে কন্ডিশনটা বড় ব্যাপার। আর সমন্বয়ের ব্যাপার তো আছেই। কাকে কী ধরনের বোলিং করা যায়, সেসব নিয়ে ম্যাচের আগে আমরা অনেক গবেষণা করি। আর ঢাকার উইকেটে তো স্পিন বরাবরই কার্যকর। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঢাকায় বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানকে স্পিনই করব। উপমহাদেশের উইকেটের জন্য এটাই আমার পরিকল্পনা।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন একবার বলেছিলেন, ভবিষ্যতে অফ স্পিনার, লেগ স্পিনার, পেসার—এসব ভেদাভেদ থাকবে না। আপনাকে দেখে তো তা–ই মনে হচ্ছে...
হাওয়েল: আসলেই সামনে এসব থাকবে না। গতি, স্পিন—এসব আলাদা করা কঠিন হবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। সবাই দেখবেন সব ধরনের বোলিং করছে। এটার একটা আলাদা মজাও আছে। অনেকটা ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার মতো। আমরা সবাই ছোটবেলায় দৌড়ে এসে বল করতাম, আবার স্পিনও করতাম। টি-টোয়েন্টিতে আপনি সামনে এসবই দেখতে পাবেন।
বোলিংয়ে লেগ স্পিন যোগ করলেন কবে?
হাওয়েল: ২০১৯ সালে আমার হাঁটুতে বড় একটি অস্ত্রোপচার হয়। আমাকে তখন ছোট রানআপে বল করতে হতো। তখন ভাবলাম লেগ স্পিন করে দেখা যায় কি না। এরপর দেখলাম ভালোই তো হচ্ছে। শুরুতে ঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারতাম না। চেষ্টা করতে করতে এখন পারছি। তবে আমাকে আরও উন্নতি করতে হবে।
পেসারদের স্টক ডেলিভারির সঙ্গে সাধারণত ২-৩টি স্লোয়ার বল থাকে। আপনার স্লোয়ার বলের সংখ্যাটা শুনেছি ১০–এর বেশি। এটা কি সত্যি?
হাওয়েল: আমি অনেক অস্ত্র নিয়েই মাঠে যাই, সব ব্যবহার করি না। বেশির ভাগ সময় এক ম্যাচে তিন ধরনের বৈচিত্র্য ব্যবহারের চিন্তা থাকে। কিন্তু আমি কাজ করি দশটির বেশি স্লোয়ার বল নিয়ে। একটি থেকে আরেকটির পার্থক্য খুবই সূক্ষ্ম। কিছু সিম পজিশনের পার্থক্য, কিছু গ্রিপের পার্থক্য—ব্যাটসম্যানদের ধাঁধায় ফেলতে এটুকুই যথেষ্ট। আমি আমার দক্ষতা সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করি। আমি ঘণ্টয় ৮৫ মাইল বেগে বল করতে পারি না। তাই নিজের সীমার মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করি। ব্যাটসম্যানকে মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত করতে পারলেই হলো। ব্যাটসম্যানের ব্যাট সুইং, তাতেই এলোমেলো হয়ে যায়।
বেশির ভাগ স্লোয়ার বলের ধারণা নিশ্চয়ই বেসবল থেকে নিয়েছেন...
হাওয়েল: হ্যাঁ, বেসবল পিচাররা এটাই করে। আমি ওদের থেকেই শেখার চেষ্টা করি। আমি মজা করে এসব বলের অনেক নামও দিয়েছি। যেমন বাবল বল, ওয়াবল বল, নাকল বলও আছে। আমার তিন রকমের নাকল বল আছে।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে আপনিই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের চতুর্থ সেরা ইকোনমি বোলার, চতুর্থ সেরা বোলিং গড়ও আপনার। তবু আপনাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বড় আসরগুলোতে দেখা যায় না কেন?
হাওয়েল: আমি জানি না। এটা হতাশাজনক বলতে পারেন। আমাকে হয়তো অনেকে বোঝে না আমি আসলে কী। আমি একজন ফাস্ট বোলারও না, স্পিনারও না। আমার অলরাউন্ড দক্ষতা আছে, তবু আমার ব্যাটিং নিয়েও তেমন আলোচনা হয় না। আমার ব্যাটিং মোটামুটি, কিন্তু বিশ্বমানের নয়। আমি তাই এটা নিয়ে কাজ করছি। ব্যাটিংয়ে উন্নতির সঙ্গে যদি আমি স্পিন বোলিংও করতে পারি, আশা করি আমি হয়তো ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও খেলার সুযোগ পাব।
আপনি জন্মগতভাবে একধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এটাও কি একটা কারণ হতে পারে?
হাওয়েল: হ্যাঁ, এটা হয়তো একটা কারণ। তবে আমার বিশ্বাস, অসুস্থতা কোনো সমস্যা নয়। যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা খুবই হতাশাজনক হবে। আমি যে দলেই খেলি না কেন, আমি সে দলের জন্য সবটা দিই। যারা আমার সঙ্গে খেলেছে, সবাই বলেছে আমার সঙ্গে খেলতে তাঁরা ভালোবাসে।
অসুস্থতার সঙ্গে মানিয়ে কীভাবে পেশাদার ক্রিকেট খেলছেন?
হাওয়েল: আমি প্রতিদিন ধ্যান করি, ব্যায়াম। নিজের মনকে শান্ত রাখতে এ রকম অনেক কিছু করি। এতে আমি ধারণা পাই, আজকের দিনটা থেকে আমি কী নিতে পারি। এরপর আমি আমার ভাবনাগুলো এক এক করে লিখে রাখি। তখন সব পরিষ্কার হয়ে যায়। সবারই নিজস্ব কিছু থাকে, সবাই যে যার মতো মানিয়ে চলে। আমিও চলছি। বলতে পারেন, আমার এই অসুস্থতা একভাবে আমার খেলায় সাহায্যও করছে। আমি এক জিনিসে স্থির থাকতে পারি না। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করার চিন্তা করি।