শুনতে কি পাচ্ছেন সেই ঘণ্টাধ্বনি? আওয়াজটা এখনো হয়তো খুব জোরালো নয়, তবে একটু কান পাতলেই কি তা শোনা যাচ্ছে না! ওই যে ঘণ্টাধ্বনি বাজছে। অলিম্পিকের।
ইংরেজিতে অলিম্পিক-ইয়ার বলে একটা কথা আছে। একেবারে আক্ষরিক অনুবাদে বাংলায় বলতে পারেন অলিম্পিক-বছর। সেই অলিম্পিক-বছর শুরুর দিন থেকেই দূরে কোথাও ওই ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করে। শুরু হয়ে যায় এই মর্ত্যধামে সবচেয়ে বড় উৎসবের ক্ষণগণনা। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। চার বছর পরপর যা একবার আসে।
এবার অবশ্য ব্যতিক্রম। এই প্রথম তিন বছর পরই অলিম্পিক আবার দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। বিশ্বকে ওলট-পালট করে দেওয়া করোনা মহামারি যে অলিম্পিককেও আক্রান্ত করেছে ভাইরাসে। অলিম্পিক ইতিহাস তাই প্রথমবারের মতো দেখেছে নামের সঙ্গে বছরের গরমিল। নামে ‘টোকিও ২০২০’, কিন্তু আসলে তা হয়েছে ২০২১ সালে। এমন বিষণ্ন অলিম্পিক এর আগে আর হয়নি কখনো। কোভিড ভাইরাস তখনো ভয়-আতঙ্ক-উদ্বেগের চাদরে ঢেকে রেখেছে পুরো বিশ্বকে। হাজারো বিধিনিষেধের সেই অলিম্পিক তাই অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে তার আসল মেজাজ। ‘প্যারিস ২০২৪’ তাই অলিম্পিকের আবার অলিম্পিকে ফেরার উপলক্ষ। বাড়তি উদ্যাপনেরও।
অলিম্পিকের ঘণ্টাধ্বনির কথা বলছিলাম রূপক অর্থে। তবে সত্যি সত্যিই আমি তা বাজতে শুনেছি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক ১২ ঘণ্টা আগে ৩ মিনিটে ৪০ বার ঢং ঢং করে অলিম্পিকের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিল বিগ বেন। কোন অলিম্পিক, তা কি আর বলে দেওয়ার কোনো দরকার আছে? ‘বিগ বেন’-ই তো বলে দিচ্ছে, এটা লন্ডন ছাড়া আর কোথায় হতে পারে!
নেতৃত্বে বিগ বেন, তবে সঙ্গীসাথি ছিল অনেক। ব্রিটেনের যেখানে যত ঘণ্টা আছে, সব ওই একই সময়ে সমস্বরে বেজে উঠেছে। সমস্বরে বলাটা ঠিক হলো কি না, তা অবশ্য বুঝতে পারছি না। স্বরে ভিন্নতা থেকেও থাকতে পারে, সব কি আর আমি শুনেছি নাকি? তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করেই বলতে পারছি। কারণ, তখনই তা ঘটা করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি ঘণ্টা বাজার বিশ্ব রেকর্ড নাকি ওটাই। রেকর্ড কত রকমই না হয়!
‘বিগ বেন’ বলায় লন্ডন নাহয় বুঝে ফেলা গেল। তবে আপনি যদি একটু ঘোরপ্যাঁচ পছন্দ করেন, তাহলে আরেকটা প্রশ্ন মোটামুটি অবধারিত বলেই মনে হচ্ছে। লন্ডন অলিম্পিক তো বুঝলাম, কিন্তু কোন লন্ডন অলিম্পিক? লন্ডনে তো অলিম্পিক হয়েছে তিনটি। সময়টা বললেই আপনার বুঝে নেওয়ার কথা, আমি এর কোনটির কথা বলছি।
লন্ডনে প্রথম অলিম্পিক সেই ১৯০৮ সালে। ৪০ বছর পর আবার যা ফিরেছে লন্ডনে। সেই ১৯৪৮ অলিম্পিকের আবার আলাদা একটা মহিমা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম অলিম্পিক। মাঝখানে অলিম্পিক ইতিহাসের দীর্ঘতম ১২ বছরের বিরতি।
১৯৪৮ সালের পর আবার ২০১২, যেবার অলিম্পিকের আয়োজক হয়েই লন্ডন একটা রেকর্ড গড়ে ফেলে। প্রথম শহর হিসেবে তিনবার অলিম্পিক আয়োজনের রেকর্ড। ঘটনাচক্রে আমারও সেটি তৃতীয় অলিম্পিক।
প্যারিস এবার সেই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলতে যাচ্ছে। ঠিক ১০০ বছর পর আবারও অলিম্পিক ফিরছে বিশ্বের রোমান্টিকতম শহরে। সর্বশেষটি ১৯২৪ সালে, এটা তো বুঝতেই পারছেন। প্যারিসে প্রথম অলিম্পিক এরও ২৪ বছর আগে। ২৪ বছরের মধ্যে দুটি অলিম্পিক আয়োজন করে ফেলার পর তৃতীয় অলিম্পিকের জন্য ১০০ বছরের অপেক্ষা!
আগামী অলিম্পিকে প্যারিস লন্ডনকে ছোঁবে। আর এ পর্যন্ত যা পরিকল্পনা, শেষ মুহূর্তে কোনো ঝামেলা বাগড়া না বসালে প্যারিস অলিম্পিকে আমি মাইকেল ফেল্প্সকে ছুঁয়ে ফেলব। ছাড়িয়ে যাব অলিম্পিকের আরেক অমর চরিত্র উসাইন বোল্টকে। এটা পড়ে আপনি হাসতে শুরু করে থাকলে একটুও রাগ করব না। এমনকি আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও না। কোথায় মাইকেল ফেল্প্স আর উসাইন বোল্ট, অলিম্পিকে কী–ই না সব কীর্তি এই দুজনের; আর সামান্য এক সাংবাদিক কিনা বলছেন, তাঁদের একজনকে ছুঁয়ে ফেলার কথা, আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার! আপনি হাসতেই পারেন।
তা যত ইচ্ছা হাসুন, আপত্তি নেই। তবে পুরোটা শুনে নিলেই কি ভালো হতো না! আমার দাবিটা কিন্তু একদিক থেকে ঠিকই আছে। কোন দিক থেকে? বলছি, বলছি। একটু ঘুরিয়ে বলি।
২০১৬ সালে রিও অলিম্পিক কাভার করে আসার পর থেকেই আমি একটা রসিকতা করি। পাত্রভেদে শুরুটা ‘বল তো’, ‘বলো তো’ বা ‘বলুন তো’ দিয়ে হয়, তবে প্রশ্নটা একই থাকে। সিরিয়াস মুখ করে আমি জানতে চাই, উসাইন বোল্টের সঙ্গে আমার মিল কী? কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর যাঁদের সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামোর সম্পর্ক, তাঁরা অবধারিতভাবেই দুজনের গাত্রবর্ণে মিলের দিকে ইঙ্গিত করে। যাঁদের সঙ্গে তা নয়, তাঁরা ‘ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত’–বোধক অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
মিল কিন্তু আসলেই একটা আছে। উসাইন বোল্টের চারটি অলিম্পিক, আমারও তা-ই। পার্থক্য বলতে বোল্ট ট্র্যাকে দৌড়েছেন, আর আমি ছিলাম প্রেস ট্রিবিউনে। ‘এথেন্স ২০০৪’-এ বোল্টের শুরু, ‘রিও ২০১৬’-তে শেষ। এ পর্যন্ত আমার শুরু-শেষও একই। তবে শুরুর মিলটা না হয় অপরিবর্তনীয়, শেষটা তো আর তা নয়। বোল্টের ক্ষেত্রে অবশ্য শেষটাও অপরিবর্তনীয়। শেষ পর্যন্ত যদি প্যারিস অলিম্পিক কাভার করতে যাওয়া হয়, তাহলেই তো উসাইন বোল্টের চেয়ে আমার একটি অলিম্পিক বেশি হয়ে যাবে।
কিন্তু ফেল্প্সকে ছুঁয়ে ফেলার ব্যাপারটা কী? ‘সিডনি ২০০০’-এ শুরু বলে ফেল্প্স বোল্টের চেয়ে এক অলিম্পিক সিনিয়র। তাঁর পাঁচটি অলিম্পিক। এই বিচারে প্যারিস অলিম্পিক কাভার করলে আমার ফেল্প্সকে ছুঁয়ে ফেলার দাবিটা কি অলীক হবে? বিবেচনার ভার আপনার।
ফেল্প্সকে ছোঁয়া, বোল্টকে ছাড়িয়ে যাওয়া—এসব যে নিছক রসিকতা, এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়ই? তবে এই রসিকতার একটা উদ্দেশ্য আছে। একটা গর্বের কথা সাড়ম্বরে সবাইকে জানানো। কত কীর্তিমান-কীর্তিমতীকেই না দেখেছে সোয়া শতাব্দীরও বেশি বয়সী আধুনিক অলিম্পিক! দেখেছে মানুষের সামর্থ্যের সীমাকে নতুন করে চেনানো অভাবনীয় সব পারফরম্যান্স, অচিন্তনীয় সব অর্জন। সবাইকে ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করছে ওই দুজনের নাম। অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুটি অধ্যায় বরাদ্দ বোল্ট আর ফেল্প্সের জন্য। সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান কে—এই আলোচনাটা অনেক রথী-মহারথীকে ছুঁয়ে এসে শেষ পর্যন্ত যে এই দুজনের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। আর অলিম্পিকের তৃতীয় বিশ্বের এক সাংবাদিক হয়েও আমি কিনা এই দুজনের অতিমানবীয় প্রায় সব কীর্তিরই প্রত্যক্ষদর্শী! সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর দিতে আমাকে তাই একমুহূর্তও ভাবতে হয় না।
‘প্রায়’ কথাটা রাখতে হচ্ছে, একটা পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে বেইজিং অলিম্পিকের প্রথম কয়েক দিন মিস করে ফেলায়। তত দিনে সেই অলিম্পিকে মাইকেল ফেল্প্সের ৬টি সোনা জেতা হয়ে গেছে। বেইজিংয়ে সময়মতো যেতে পারলে গর্ব করে বলতে পারতাম, অলিম্পিকে মাইকেল ফেল্প্সের ২৩টি সোনা জয়ের মুহূর্তেই আমি সশরীর অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে ছিলাম।
২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে না থাকায় কিছু আসত-যেত না। সেই অলিম্পিকে ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে মাইকেল ফেল্প্সের সাঁতারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে না অনেক পরে, যখন এথেন্সে পরের অলিম্পিকে তিনি ৬টি সোনা জিতেছেন। সিডনিতে পদকমঞ্চে ওঠা হয়নি। ১৫ বছর বয়সী সাঁতারুর পঞ্চম হওয়াটাই যদিও সোনালি এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছিল। তাই বলে পরের চারটি অলিম্পিকে ২৮টি পদক—যার ২৩টিই আবার সোনা—এতটা তো কল্পনারও অতীত। কল্পনায় সবই সম্ভব। তবু মানুষ তো কল্পনা করে বাস্তবের জমিনে দাঁড়িয়েই।
অলিম্পিকে একজন অ্যাথলেটেরই ২৮টি পদক কল্পনাতেই-বা কীভাবে আসতে পারে!
মাইকেল ফেল্প্স তাই কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া এক অ্যাথলেটের নাম। রিও অলিম্পিকে তাঁর শেষ ইভেন্টের পর সংবাদ সম্মেলনে মাইকেল ফেল্প্সকে একদৃষ্টে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, সামনে বসে থাকা মানুষটিকে কী বলে ব্যাখ্যা করা যায়! ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ কথাটা এর আগে অনেকবারই ব্যবহার করেছি। অনেক বড় বিশেষণ, কিন্তু আরও কতজনকেই তো তা বলা হয়েছে। আমি তাই লিখেছিলাম, জীবন্ত কিংবদন্তিতে মাইকেল ফেল্প্সকে আর ধরা যাচ্ছে না। অতিপ্রাকৃত এক মানব বললে হয়তো যদি কিছুটা বোঝানো যায়।
এমন মনে হয়েছিল বলেই মাইকেল ফেল্প্সকে একবার ছুঁয়ে দেখেছিলাম।
অলিম্পিকে গিয়েই প্রথম মিক্সড জোনের সঙ্গে পরিচয়। মিক্সড জোন মানে অ্যাথলেট আর সাংবাদিকদের মিথস্ক্রিয়ার জায়গা। প্রতিযোগিতা শেষে যে পথ দিয়ে অ্যাথলেটরা বেরিয়ে যান, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন সাংবাদিকেরা। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তো আসেন শুধু পদকজয়ীরাই। মিক্সড জোনে সবার সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ মেলে। লন্ডন অলিম্পিকে মিক্সড জোনে কথা শেষ করে ফেল্প্স যখন চলে যাচ্ছেন, হঠাৎ কী মনে হলো, আমি বললাম, ‘কিছু মনে না করলে আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।’ ফেল্প্স একটা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছুঁয়ে দেখার কারণটা জিজ্ঞেস করেননি। হয়তো তা জানেন বলেই।
তখন তো আর জানি না, লন্ডনেই বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন করে ফেলা ফেল্প্সকে রিওতেও ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাব! অবসর-পরবর্তী উদ্দাম ও বেহিসাবি জীবন থেকে ফিরে এসে রিওতেও জিতবেন আরও ৫টি সোনা। আবারও আলাদা করে তাঁর বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন হবে, সেখানেও থাকব আমি। আচ্ছা, অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদকজয়ীর দুটি বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে থাকতে পারাটাও কি গর্ব করে বলার মতো নয়!
মাইকেল ফেল্প্স অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পদকের মালিক হতে পারেন, তাঁর অর্জনের বিশালত্ব হয়তো আপনাকে বিমূঢ়ও করে দেবে, তবে মন ছুঁয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠলে কৃষ্ণকায় এক জ্যামাইকানের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। ট্র্যাকে এবং ট্র্র্যাকের বাইরে উসাইন বোল্ট এতটাই আনন্দদায়ী প্যাকেজ যে অলিম্পিক–ইতিহাসেই সম্ভবত তাঁর কোনো তুলনা নেই। তুলনা খুঁজতে গেলে বাইরে যেতে হয়।
অলিম্পিকে বোল্টের ৯টি সোনার একটিই শুধু স্টেডিয়ামে বসে দেখিনি। যতটুকু মনে করতে পারছি, তা কোনো একটা রিলেই হবে। পরে এক সতীর্থের ডোপ-পাপে একটি সোনা হারিয়ে ফেলার সেই রিলেটাই কি? হতে পারে। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই নিশ্চিত হওয়া যেত। বোল্টের গল্পে সেটি এমন কোনো জরুরি নয় বলে কষ্টটা আর করতে ইচ্ছা করছে না।
আমার কাছে বোল্ট নামটার কিছু প্রতিশব্দ আছে। বোল্ট মানেই আনন্দ, বোল্ট মানেই বিনোদন, বোল্ট মানেই অবিশ্বাস্য কিছু দেখতে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি। এমন মনে হওয়াটাকে ব্যক্তিগত করে নেওয়ার চেষ্টাটা গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। বোল্টকে নিয়ে এটা তো সর্বজনীন অনুভূতি।
নামটাও সার্থক। ইলেকট্রিফাইং বলে যে একটা কথা আছে, সেটির বাংলা কি বিদ্যুতায়িত হয়? তাহলে বলতে হয়, বোল্টের সংস্পর্শে আসামাত্র স্টেডিয়ামের বাতাসই যেন বিদ্যুতায়িত হয়ে যেত। ভোজবাজির মতো বদলে যেত পুরো অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পরিবেশটাই। দৌড় শুরুর আগে স্টেডিয়ামের দর্শকদের জাগিয়ে তোলাটাকে নিতেন অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হিসেবে। শোম্যান তো বটেই, তবে শুধু এ কারণেই অমন করতেন বলে মনে হয় না। নিজেকে জাগিয়ে তুলতেও বোল্টের গ্যালারির ওই এনার্জি লাগত। আর দৌড় শেষ হওয়ার পর বোল্টের উদ্যাপন তো সিনেমার টুকরো টুকরো সব ক্লিপ। স্মৃতিতে ধুলো পড়ে গিয়ে থাকলে ইউটিউবে সার্চ দিন। কাল্পনিক তির ছোড়ার ওই ভঙ্গির বাইরেও আরও অনেক কিছু পেয়ে যাবেন।
তারপরও যাঁরা শুধু ট্র্যাকের বোল্টকে দেখেছেন, তাঁরা বোল্টের কতটুকুই-বা দেখেছেন! সংবাদ সম্মেলনের বোল্ট তো আরও বেশি আকর্ষণীয়, আরও বেশি মোহময়। বেইজিং থেকে লন্ডন হয়ে রিও—বোল্টের কোনো সংবাদ সম্মেলন আমি মিস করেছি বলে মনে হয় না। লেখার খোরাক জোগাড় করা তো অবশ্যই একটা কারণ, তাই বলে একমাত্র নয়। উসাইন বোল্ট আজ কী বলেন, আজ কী করেন—এটাই চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যেত সাংবাদিকদের। সংবাদ সম্মেলনের উসাইন বোল্ট ছিলেন আনন্দের এক নির্ঝরিণী। নিজে হাসছেন, সবাইকে হাসাচ্ছেন। প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে নিয়ে মজা করছেন, পাশে বসে থাকা রুপা বা ব্রোঞ্জজয়ী কাউকে নিয়েও কখনো কখনো। যাকে বলে নেভার আ ডাল মোমেন্ট।
অলিম্পিকে সোনা ছাড়া আর কিছুই জেতেননি। সেটা তো আর কারও স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না। অন্যের স্বীকৃতি প্রয়োজন, এমন যা কিছু আছে, সেসবের সংজ্ঞাও নিজেই দিয়ে দিতেন। কী করলে কিংবদন্তি হয়ে যাবেন, কী করলে গ্রেটেস্ট—নিজেই তা আগাম বলে দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। তা করে ফেলার পর সাংবাদিকদের সেটা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, ‘আই অ্যাম আ লেজেন্ড নাউ’, ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’। অনেক সময় এসব বলতে বলতেই নাটকীয় ভঙ্গিতে ঢুকেছেন সংবাদ সম্মেলনে।
নিজের ঢোল নিজে পেটানোও যে এত সুন্দর লাগতে পারে, বোল্টকে দেখার আগে তা বুঝিনি। বোল্টের মুখে যখনই এসব শুনতাম, অবধারিতভাবেই মনে পড়ে যেত মোহাম্মদ আলীকে। ওই যে বলছিলাম, বোল্টের তুলনা খুঁজতে অলিম্পিকের বাইরে যেতে হয়! কী বলছেন, অলিম্পিক ইতিহাসে তো মোহাম্মদ আলীও আছেন। হ্যাঁ, তা তো আছেনই। আলীও অলিম্পিয়ান। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে সোনা জিতেছেন। তবে তখনো তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে। নামে ও চরিত্রে মোহাম্মদ আলীতে বিবর্তন আরও অনেক পরে।
ফেল্প্সকে নিয়েও চাইলে আরও অনেক কিছু লেখা যেত। তবে একসময় তা শেষ করা যেত বলেই মনে হয়। উসাইন বোল্টকে নিয়ে বিচিত্র সমস্যা। লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কোনটা রেখে কোনটা লিখি! মাইকেল ফেল্প্সকে আরও অনেক বেশি পদক জিততে দেখেছি, তবে চরিত্র হিসেবে বোল্টের ধারেকাছে নন। বোল্টকে প্রথম দেখার সেই অবিশ্বাস্য অনুভূতিটাই নাহয় শুধু বলি আজ। এথেন্সে উসাইন বোল্ট অদৃশ্য হয়েই ছিলেন। জ্যামাইকার বাইরে কেউই তাঁকে চিনত বলে মনে হয় না। বাকি বিশ্বের মতো আমারও প্রথম বোল্ট-দর্শন তাই বেইজিংয়েই। ভাষায় বর্ণনা করা যায় না বলে যে একটা কথা আছে, বেইজিংয়ের ১০০ মিটারে বোল্টকে দেখার পরও ওই অবস্থাই হয়েছিল।
১০০ মিটার স্প্রিন্টে বেশির ভাগ সময় যেখানে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় খালি চোখে তা আলাদা করা যায় না, সেখানে প্রায় ২৫-৩০ মিটার বাকি থাকতেই একজন উদ্যাপন শুরু করে দিয়েছেন, এমন দৃশ্য তো কেউই এর আগে কখনো দেখেনি। কোনো দিন আর দেখবে বলেও মনে হয় না। চারটি অলিম্পিকে কত রকম অভিজ্ঞতাই না হয়েছে, বিস্ময়-অবিশ্বাস-মুগ্ধতা এসব মিলিয়ে বেইজিংয়ের বার্ডস নেস্টে বোল্টের ওই ১০০ মিটারের ধারেকাছেও আর কিছু নেই।
কপালটাও ভালো ছিল। শেষটা দেখেছিলাম, যতটা কাছ থেকে দেখা সম্ভব, ততটাই দূরত্ব থেকে। অলিম্পিকের প্রেস ট্রিবিউনে ডেস্ক বরাদ্দ থাকে বড় দেশের সাংবাদিকদের জন্য। আমাদের মতো অলিম্পিকের তৃতীয় বিশ্বের সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা সামনের চেয়ারে। এ নিয়ে প্রথমে একটু মন খারাপও হয়েছিল। পরে যেটিকে মনে হয়েছে শাপেবর। সামনের চেয়ারে বসতে হয়েছিল বলেই না মাত্র হাত দশ-পনেরো হাত দূর থেকে ওই অবিশ্বাস্য সমাপ্তি দেখতে পেয়েছি। পরে অন্য খেলাতেও ছড়িয়ে পড়া বোল্টের বিখ্যাত সেই উদ্যাপনও।
বেইজিংয়ের পর লন্ডন, লন্ডনের পর রিও—আমার অলিম্পিক-স্মৃতি এতটাই উসাইন বোল্ট–মুখর যে প্যারিসেও আমি তাঁকে খুঁজে বেড়াব।
অলিম্পিক কি শুধুই বোল্ট আর ফেল্প্সের! নাতালিয়া পার্তিকা, নাতালি ডো টুইট, ইয়ান মিলারদেরও নয়? নামগুলো অপরিচিত লাগছে বলেই অনুমান করি। কেন চিনবেন? এঁদের কেউ তো বোল্ট-ফেল্প্সের মতো অর্জনে ভাস্বর নন। কিন্তু তাঁরাও চ্যাম্পিয়ন। মানুষের স্বপ্নের সীমাটা এমন বড় করে দিলে তাঁকে চ্যাম্পিয়ন বলবেন না?
নাতালিয়া পার্তিকাকে দেখতেই লন্ডন অলিম্পিকে টেবিল টেনিসে গিয়েছিলাম একদিন। পার্তিকার ডান হাতে কনুইয়ের নিচে আর কিছু নেই। টেবিল টেনিস এক হাতেই খেলা হয় সত্যি, কিন্তু সার্ভিস করার সময় বল ওপরে ছোড়ার জন্য অন্য হাতটাও তো লাগে। পার্তিকা কী করেন, ডান হাতের ভাঁজে বল রেখে তা ছুড়ে দেন ওপরে, তারপর বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে বাঁ হাতে সার্ভিস করেন। প্যারালিম্পিকে এমন সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই অংশ নেন অ্যাথলেটরা। পার্তিকাও সেবার লন্ডন অলিম্পিকের পরেই প্যারালিম্পিকে খেলেছেন। কিন্তু মূল অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেই কি অদৃশ্য একটা পদক জিতে ফেলেননি?
নাতালি ডো টুইটের গল্পটাও অনেকটা এমনই। লন্ডন অলিম্পিকে সাগরের খোলা পানিতে ৪০ কিলোমিটার সাঁতারে অংশ নিয়েছেন। অথচ এর সাত বছর আগেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলেছেন একটা পা। এক পা নিয়ে সাঁতরেই ২৫ জনে ১৬তম। বিশেষ একটা স্মারক দেওয়া হয়েছে তাঁকে। ওই ইভেন্টে সোনাজয়ী দারুণ একটা কথা বলেছিলেন। স্মারক কেন, শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই বিশেষ একটা পদক দেওয়া উচিত ছিল নাতালি ডো টুইটকে।
ইয়ান মিলারের গল্পটা এই দুজনের চেয়ে কিছুটা আলাদা। তাঁর কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নেই। ইয়ান মিলারের গল্প লেগে থাকার, বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অদম্য মানসিকতার। তা অপুরস্কৃতও থাকেনি। ফেল্প্স-বোল্টের মতো তাঁর নামটাও অক্ষয় হয়ে গেছে রেকর্ড বইয়ে। সবচেয়ে বেশি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার রেকর্ড। দশম অলিম্পিকে এসে প্রথম একটা পদক ইয়ান মিলার জিতেছেন, বয়স যখন ৬৫ বছর।
লন্ডন অলিম্পিকে ইয়ান মিলারের এই কীর্তির কথা শুনে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। শুধু তাঁকেই দেখতে, নইলে যে খেলাটা তিনি খেলেন, তার বিন্দুবিসর্গও তো বুঝি না। শুধু জানি, খেলাটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলতে হয়। টিভিতে ইকুস্ট্রেরিয়ান দেখতে অবশ্য আমার খুব ভালো লাগে। তবে সরাসরি দেখা ওই একবারই।
এমন অনেক খেলাই প্রথম দেখার সুযোগ করে দিয়েছে অলিম্পিক। বাংলাদেশে সিনক্রোনাইজড সুইমিং হলে না দেখব। অলিম্পিকে যখন প্রথম ফেন্সিং দেখি, বাংলাদেশে তখনো তা চালু হয়নি। এর আগে যা শুধু টেলিভিশনেই দেখে এসেছি, তা স্বচক্ষে দেখার প্রথম অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না।
শুধু খেলাই নয়, বিখ্যাত কত খেলোয়াড়কেও তো দেখেছি অলিম্পিকের কল্যাণে। শুধু টেনিসের কথাই যদি বলি—রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, ভেনাস উইলিয়ামস, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, অ্যান্ডি রডিক, মার্টিন দেল পোত্রো, মারিয়া শারাপোভা…কত নাম বলব! একসময় টেনিসের চারটি গ্র্যান্ড স্লামই কাভার করার একটা স্বপ্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত একটাও করা হয়নি। গ্র্যান্ড স্লাম যদি ‘দুধ’ হয়, অলিম্পিক টেনিস হয়তো ‘ঘোল’-এর মর্যাদাও পাবে না। তবে আমার পক্ষে এভাবে বলাটা অকৃতজ্ঞতা হবে। টেনিস-আকাশের ওই সব নক্ষত্রকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে তো অলিম্পিকই।
এর চেয়েও বড় প্রাপ্তি মনে হয় উইম্বলডনে ম্যাচ দেখার সুযোগকে, প্রথম দিন গিয়েই যেটির প্রেমে পড়ে যাই। কোর্ট সবুজ। ভবনগুলোর দেয়ালে সবুজ গাছ। সময় যেন এখানে থমকে আছে। সব এমন সাজানো-গোছানো, তারপরও সবকিছু থেকেই ফুটে বেরোচ্ছে আভিজাত্য। অথচ অলিম্পিক টেনিসের উইম্বলডনের সঙ্গে গ্র্যান্ড স্লামের উইম্বলডনের অনেক পার্থক্য। গ্র্যান্ড স্লামের উইম্বলডনে পোশাকের রং হতে হয় শুধুই সাদা। অলিম্পিকে সেই বিধিনিষেধ নেই। রঙিন সেই উইম্বলডন দেখাও তো এক বিরল অভিজ্ঞতা। অনেক বছর উইম্বলডন দেখেও হয়তো অনেকের সেই সুযোগ হয়নি।
সেই উইম্বলডনে এমন একটা ম্যাচ দেখেছি, অলিম্পিকের সীমানা ছাড়িয়ে যেটি সব ধরনের টেনিসেই এখনো রেকর্ড হয়ে আছে। টেনিস ইতিহাসের দীর্ঘতম তিন সেটের ম্যাচ। রজার ফেদেরার-মার্টিন দেল পোত্রো সেমিফাইনালটি শেষ হতে সময় লেগেছিল ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিট। টাইব্রেকারহীন তৃতীয় সেটটা শেষ হতেই তো এর অর্ধেকের বেশি—২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট। ১৯-১৭ গেমের সেই সেটই তো বাকি জীবন গল্প করার মতো।
উইম্বলডন যদি টেনিস-তীর্থ হয়, ফুটবলে সেই মর্যাদা ওয়েম্বলির। উইম্বলডনের মতো ওয়েম্বলিতে ম্যাচ কাভার করতে পারার জন্যও তো অলিম্পিককে ধন্যবাদ জানাতে হয়। ওয়েম্বলিতে অলিম্পিক ফুটবল ফাইনালে ব্রাজিলকে হারতে দেখেছি, চার বছর পর রিও অলিম্পিকে মারাকানায় দেখেছি জিততে। যে জয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের সফলতম দলের অলিম্পিক ফুটবলে সোনা জিততে না পারার দুঃখ ঘুচেছে।
সেই রাতে মারাকানায় থাকাও একটা অভিজ্ঞতা বটে। তারপরও উইম্বলডন-ওয়েম্বলির মতো মারাকানার কথা আলাদা করে না বলার কারণ, মারাকানার সঙ্গে পরিচয় অলিম্পিকের সুবাদে নয়। রিও অলিম্পিকের দুই বছর আগে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে গিয়েই তো মারাকানার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে।
অলিম্পিক নিয়ে এত যে আনন্দের কথা বললাম, এত কিছু উপভোগের গর্ব—একটা দুঃখের কথাও কি এখানে বলে নেব! প্রাচীন অলিম্পিকের মতো আধুনিক অলিম্পিকও যেখানে শুরু, সেই এথেন্সেই আমার অলিম্পিক-অভিষেক। তা আরও স্মরণীয় হয়ে থাকত, যদি অলিম্পিকের সূতিকাগার অলিম্পিয়াতে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। সেই অলিম্পিকে পুরুষদের শটপুট ইভেন্টটাই শুধু হয়েছিল সেখানে, সেই প্রাচীনকালের আবহেই। শটপুট ছোড়ার গোল দাগটা ছাড়া আর কিছু নেই। দর্শক-সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থাও ঘাসের ঢালে।
অলিম্পিক কাভার করতে যাওয়া হাজার হাজার সাংবাদিকের প্রায় সবাই যেখানে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না! লটারির মাধ্যমে সৌভাগ্যবান ২০০ জন সাংবাদিকই শুধু সুযোগ পেয়েছিলেন অলিম্পিকের আঁতুড়ঘরে যাওয়ার।
লটারিতে যে আমার নাম ওঠেনি, তা মনে হয় বুঝে ফেলেছেন। নইলে কি আর একটা দুঃখের কথা বলব বলে অনুচ্ছেদটা শুরু করি!