‘লর্ডসে টেস্টের চতুর্থ দিনে যাব বলে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ৫ হাজার ৫০০ মাইল উড়ে এলাম মাত্র।’
টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব পিয়ার্স মরগানের টুইটের প্রথম অংশটা ছিল এমন। তবে পাদটীকা দিয়ে মরগান লিখেছেন, ‘হয়তো চতুর্থ দিন বলে কিছু থাকবে না।’ একটু পর আগের টুইটটা রিটুইট করে লিখলেন, ‘আপডেট—আমি কাল লর্ডসে যাচ্ছি না।’
গত জুনে এই লর্ডসেই টেস্ট ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নতুন ইংল্যান্ডের আবির্ভাব। টেস্ট ব্যাটিংয়ের অভাবিত এক আক্রমণাত্মক প্রদর্শনীতে দলকে আগেভাগেই জিতিয়ে দর্শকদের পয়সা ফেরত দেওয়ার ‘ব্যবস্থা’ করিয়েছিলেন জো রুটরা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজে ট্রেন্ট ব্রিজ ও হেডিংলিতে পরের দুই টেস্টেই একই রূপে দেখা দিয়েছিল স্টোকস–ম্যাককালামের দল। এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে আগের বছরের বকেয়া টেস্ট ম্যাচেও তা–ই। ট্রেন্ট ব্রিজ আর এজবাস্টনে তো পঞ্চম দিনের ‘বিনোদন’ দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল বিনা পয়সায়।
সেই ইংল্যান্ডই আবার যখন লর্ডসে টেস্ট খেলতে নামল, কী নাটকীয়ভাবেই না বদলে গেল সব! দক্ষিণ আফ্রিকান গতিতে উড়ে গিয়ে তিন দিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডের হার, সেটিও আবার ইনিংস ব্যবধানে। ‘বাজবল’ বলে কী একটা শোনা যাচ্ছিল না? কই, সেই ‘বাজবল’ কই?
ইংল্যান্ডের খেলার ধরনে হয়তো চমকে গিয়েছিল কিউইরা, চাপ সামাল দিতে পারেনি আনকোরা অধিনায়কের অধীনে থাকা ভারতও। তবে ডিন এলগারের দক্ষিণ আফ্রিকা লর্ডসে ইংল্যান্ডকে যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগটাই দিল না। ক্রিকভিজের ডেটা অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বল বাই বল ডেটা আসার পর থেকে ইংল্যান্ডের মাটিতে এত গতিতে (গড়ে ঘণ্টায় ৮৬ মাইল) বল করেনি কোনো পেস আক্রমণ। কাগিসো রাবাদা, আনরিখ নর্কিয়ার গতির সঙ্গে এলগারের দারুণ অধিনায়কত্ব, ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন, চাপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া—দক্ষিণ আফ্রিকা যেন ‘রিয়েলিটি চেক’–এর সামনেই দাঁড় করিয়ে দিল ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ দর্শনকে।
যে দর্শনের উপযোগিতা নিয়ে সিরিজ শুরুর আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এলগার। স্টোকস এ নিয়ে আলোচনায়ই যেতে চাননি। ম্যাচের পরও যেতে চাইলেন না সেভাবে। শুধু মনে করিয়ে দিলেন, একটা ম্যাচ হেরেছেন বলে কিছুই আসে যায় না। নিজেদের নতুন দর্শনে পূর্ণ আস্থা আছে তাঁর নিজের এবং দলেরও।
আসলেই একটা ম্যাচ হারলেই সব শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু হারেরও তো ধরন থাকে। যা ‘বাজবল’–এর পতাকা উড়িয়ে দেওয়া আগের চার টেস্টের সঙ্গে এই টেস্টের বড় একটা পার্থক্যকে আরও বড় করে তুলেছে। ওই চার টেস্টেই পরে ব্যাটিং করেছে ইংল্যান্ড। টেস্টে প্রথম দিনের সকালের চ্যালেঞ্জটাই নিতে হয়নি তাদের ব্যাটসম্যানদের। তবে লর্ডসে যা নিতে হলো এবং তাতে চরম ব্যর্থতা। যেটির রেশ আর কাটিয়েই উঠতে পারেনি ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে ডিন এলগারও রীতিমতো অবাক। অবধারিত প্রশ্নটা তাই উঠেই গেছে—অমন চরম আক্রমণের তারে বাঁধা ব্যাটিং দর্শন নিয়ে আসলেই কি টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য পাওয়া সম্ভব?
স্টোকসের মনে অবশ্য এমন কোনো সংশয় নেই। তাঁর মতো করে পরাজয়ের যে ময়নাতদন্ত করেছেন, তা এ রকম, ‘যে ধরনের ক্রিকেটই আপনি খেলতে চান না কেন, এর কাছাকাছি কিছু খেলতে না পারলে আপনাকে হারতেই হবে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে গত তিন দিনে ব্যাটিং–বোলিংয়ে যা–ই করেছি, তারা এর জবাব দিয়েছে। তাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। আমরা ছন্দে ছিলাম না এবং আমাদের দিক থেকে ব্যাপারটি ঠিকঠাক। এমন না যে এখন বাচ্চাদের মতো হাত–পা ছোড়া শুরু করব আমি।’
শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফলটা কী হলো, সেটিও ভুলে যেতে বলছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক, ‘আমি সত্যিই এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছি, যাতে দল ম্যাচের ফল নিয়ে খুব বেশি না ভাবে। ভালো খেলুন বা খারাপ—ফল আসলে তাতেই নির্ধারিত হয়।’
হারলে কিছুই যায় আসে না, ব্যাপারটি যে অমন নয়, স্টোকস মনে করিয়ে দিয়েছেন সেটিও, ‘ম্যাচ হারলে তা সব সময়ই হতাশার। ফিরে তাকালে দেখা যাবে, আমরা আসলে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারিনি। কৃতিত্বটা আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার। এই তিন দিন তারা আমাদের পাত্তাই দেয়নি। ঠিক আছে, এটা মেনে নিতে হবে। তবে আমরা একটা ম্যাচই হেরেছি। আরও দুটি ম্যাচ বাকি আছে, এখন লক্ষ্য ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জেতা।’
এরপর যা বলেছেন, তা নিজেদের দর্শনের ওপর আস্থার কথা পুনর্ব্যক্ত করাই, ‘আমাদের খেলার একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। আমরা জানি সেসব বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের হারানো কঠিন। তবে প্রতিদিনই আমরা দারুণ খেলতে পারব না। এ সপ্তাহেও একটু খাপছাড়া ছিলাম। তবে আমরা এসব মনে রাখব না। সব ভুলেই ম্যানচেস্টারে যেতে চাই।’
গত মাসে ভারতের বিপক্ষে জয়ের পর ইংল্যান্ড দলের কয়েকজন দ্য হানড্রেডে খেলেছেন। তবে কেউ কেউ ছিলেন একেবারেই খেলার বাইরে। এ বিরতি ইংল্যান্ডের ছন্দে প্রভাব ফেলেছে কি না, এই প্রশ্নও হয়েছে। যেটির জবাবে স্টোকস বলেছেন, ‘পাঁচ সপ্তাহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে ভিন্ন সংস্করণে খেলা অবশ্যই আদর্শ নয়। তবে আমরা অনেক দিন ধরেই পেশাদার ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানি কীভাবে ক্রিকেট খেলতে হয়। সেদিকে তাকালে দেখবেন, আমরা অজুহাতভিত্তিক কোনো সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই না। আমরা ব্যাপারটিকে শুধু এভাবে দেখছি—দক্ষিণ আফ্রিকা আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছে।’
স্টোকসদের খেলার ধরনকে যে ‘বাজবল’ নামে ডাকা হচ্ছে, সেটি মূলত কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ডাকনাম থেকেই। যদিও ম্যাককালামের তা পছন্দ নয়। লর্ডসে হারের পর স্টোকসের মতো ইতিবাচক তিনিও, ‘অবশ্যই আমরা হতাশ, টেস্ট ম্যাচ হারা কারোরই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। আমাদের একটু কাজ করতে হবে। তবে রাতারাতি আপনি ভালো থেকে মন্দ দলে পরিণত হতে পারেন না। এ নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আগেও বলেছি, এই ভ্রমণে আটঘাট বেঁধে নামতে হবে। আমরা আরও শক্তিশালী হয়েই ফিরে আসব। স্টোকসি এবং আমি দুজনই এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—আমরা কীভাবে খেলতে চাই, কোনো পথে এগোতে পারি। কিছু দিক শুধু একটু ঘষামাজা করতে হবে।’
সে ঘষামাজার ফল কী হয়, তা দেখতে খুব একটা অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে ২৫ আগস্ট।