উজ্জ্বল আলোটা ড্রাইভারের চোখে পড়তেই চাকার কর্কশ শব্দ শোনা গেল এবং হার্ড ব্রেক করে সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি থেমে গেল। কিন্তু পেছনের আসনে বসে থাকা আমি কিছুক্ষণ আগের আলাপ নিয়ে এতটাই বিমোহিত ও সম্মোহিত ছিলাম যে শুরুতে ব্যাপারটা টেরই পাইনি। আর আশু বিপদের কথা বুঝতে পারা তো অনেক দূরের ব্যাপার ছিল।
ঢাকা শহরে গভীর রাতে তিন চাকার অটোরিকশায় চড়ার অনুভূতিটা কিছুটা পরাবাস্তবই বলতে হয়। অদ্ভুত গড়নের এই ছোট্ট যানটির দিনভর ট্রাফিক জ্যাম আর নির্দয় ধাক্কাধাক্কিতে দম খিঁচে থাকে। কিন্তু রাতের বেলা সে পুরাণের পক্ষিরাজের মতো কাল্পনিক পাখায় ভর করে উড়ে বেড়ায়। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে শোনা যায় দুর্বল ইঞ্জিনের ঘর্ঘর যান্ত্রিক শব্দ। মনে হয়, হাঁপানি রোগী যেন টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, আমি এ অভিজ্ঞতার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত। যদিও সে রাতের ব্যাপারটা ছিল একটু ভিন্ন। লিওনেল মেসি আরও একটি অবিশ্বাস্য প্রদর্শনীর পসরা মেলে ধরলেন। মেসি অবশ্য ইদানীং অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাকেই বাস্তব করে তোলেন প্রতিদিন। স্বপ্ন আর বাস্তবের জগতের পর্দাটা সরিয়ে দেন।
তবু সেদিনের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। সেদিন গভীর রাতে অফিসের কাজ শেষ করে, আর্জেন্টিনার ফাইনালে ওঠা নিশ্চিত করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। তবে আমার এক সহকর্মীর তখনো কাজ বাকি ছিল। আর অধিক উত্তেজনায় আমারও আর অপেক্ষা করার ইচ্ছা ছিল না। তাই অফিসের গাড়ি বাদ দিয়েই বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
রাস্তায় একটি খালি সিএনজিতে চেপে বসার পরপরই আর্জেন্টিনা সমর্থক এক বন্ধু ফোন দিল। তাকে বললাম, ‘কী দারুণ রে! কী অবিশ্বাস্য! আমি তোরে কথা দিচ্ছি, এ নিয়ে আজকে রাতে একটা লেখা লিখব, কাল পত্রিকায় দেখতে পাবি। আমাদের কী সৌভাগ্য, এই জাদুকরের জাদু আমরা দেখতে পাচ্ছি, বল নিয়ে এই অপূর্ব স্বর্গীয় নৃত্য দুনিয়াতে বসেই আমরা দেখতেছি।’
‘আপনি কি লেখক? আপনি কি মেসির খেলা নিয়ে লিখবেন?’ ভারী কণ্ঠে ড্রাইভার ফোন রাখার পর জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, ‘হ্যাঁ ভাই, আমি খেলাধুলা নিয়ে লিখি আর বাসায় গিয়েই মেসিকে নিয়ে একটা লেখা লিখব।’ ড্রাইভারের পাল্টা প্রশ্ন, ‘সত্যি কইরা কন তো, এমন খেলা কোনো দিন দেখছেন? বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ১ গোল দেওয়াই তো বড় ব্যাপার, আর ওরা ৩টা দিল! আর কী যে সুন্দর খেলা!’
আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে এর চেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড আছে। কিন্তু ভদ্রলোকের উত্তেজনায় আর বললাম না। ‘জি ভাই, এই জিনিস অবিশ্বাস্য। আপনি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করেন? মেসির ভক্ত?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘জি। আমি ফুটবল খেলতামও একসময়। আচ্ছা বলেন তো, তিন নম্বর গোলটা দেইখা মনে হইছে না ভানুমতির খেল?’
‘আবার জিগায়! পুরা গোলটাই আসলে মেসির! যেইভাবে সে বলটা নিয়ে নাচল, অত শক্তপোক্ত বিপক্ষের ডিফেন্ডারটাকে বোকা বানায়ে রসগোল্লার মতো বলটা বানায়ে দিল! খালি পায়ে টাচ করাতেই গোল।’
‘ঠিকই কইছেন। আমি তো তব্দা খাইয়া গেছিলাম। চিল্লাইতেও ভুইলা গেছিলাম।’ কঠোর চেহারার ড্রাইভার মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন। তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললাম, ‘এই বছর কাপটা মেসির, এই অদৃষ্ট খণ্ডানো যাবে না। কেউ পারবে না।’
এই কথোপকথন চলার ফাঁকেই সেই শক্তিশালী আলোটা জ্বলে উঠল আর সিএনজিটা ঘ্যাচ করে থেমে গেল। তিনজন লোক গাড়িটা থামানোর পর ড্রাইভারের পাশে এসে হেসে দিয়ে বললেন, ‘ওস্তাদ! মুরগি ধইরা ফালাইছেন দেখি!’ এই বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটা কটাক্ষের হাসি হাসলেন। ‘ঝামেলা না কইরা বাইর হইয়া আসেন, যা আছে আমাদের দিয়া দেন।’
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভার বললেন, ‘না। উনি মেসির ভক্ত। উনি ফুটবল নিয়ে লেখেন। আজকে মেসিকে নিয়ে লিখবেন। আজকে রাইতে উনি আমার মেহমান। আমার লগে আয় *** (প্রকাশের অযোগ্য) পোলারা।’ ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি একদল ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছি। কিন্তু পালের গোদার উদ্দেশ্য কি? এ কোন নাটক?
‘আমরা সামনের ওই চায়ের দোকানে গিয়ে আজকের খেলায় জিতা উপলক্ষে একলগে চা খামু।’ আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। এই অদ্ভুত লোকটা কী করতে চাইছে? এ আবার কোন নাটক?
‘লেখক ভাই, খেলাটা নিয়ে আরও কিছু কন। একসময় আমি খুব ফুটবল খেলোয়াড় আছিলাম আর আমার খেলা দেখতে গঞ্জের মানুষ ভিড় করত। কত দিন যে লোকের কান্ধে চাইপা বাড়ি ফিরছি! আচ্ছা, দুই নাম্বার গোলটা নিয়া আপনার কী মত?’
‘সন্দেহ নেই কপাল ভালো ছিল, কিন্তু আলভারেজেরও কৃতিত্ব আছে বলতেই হবে। শেষ ডিফেন্ডারটা বাজে রকম ভুল করছে আর মাঝমাঠেও ফাউল না করে তারে আগাইতে দিছে, কিন্তু আলভারেজের যে দৌড় আর চেষ্টা, ওইটারই ফল এই গোল। মনে রাখার মতো গোল।’
‘আপনি জানেন, আমি সব সময় এমন গোল দিতে চাইতাম কিন্তু আমার কপালই এমন যে জীবনে আকাম করলাম সেই শেষ ডিফেন্ডারের মতো’, সিগারেটে জোরে এক টান দিয়ে বলে উঠলেন সরদার। ওনার চোখে যেন দেখতে পেলাম বহু দূর অতীতের স্বর্ণালি ছবি। মেসি হইতে চাওয়া এক দুরন্ত বালকের সুখস্মৃতি। গালে দাগওয়ালা, কঠোর চেহারার লোকটার চোখের কোনায় জমা পানিতে ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে যেন চিরিক করে উঠল।
সরদার বলতে লাগলেন, কীভাবে এক ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ওনার এলাকায় মারামারি হয়েছিল। সেই মারামারিতে ওনার ভাইকে নির্দয়ভাবে মেরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন ফুঁসতে থাকা কিশোরটা প্রহারকারীদের একজনকে ছুরি মেরে বসেন। এরপর গ্রাম থেকে পালানো ছাড়া ওর আর কোনো উপায় ছিল না।
এরই মধ্যে ওস্তাদের এক স্যাঙাত ফোড়ন কাটল, ‘এক নম্বর গোলে প্লান্টিকটা কিন্তু হয় নাই। ভুয়া কল দিছে রেফারি।’ ততক্ষণে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত সাহস চলে এসেছে। একদল ছিনতাইকারীর মধ্যে বসেও বিন্দুমাত্র ভয় করছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, বন্ধুদের আড্ডায় চা পান করছি। ফলে আমি জোর গলায় বলে উঠলাম, ‘আরে নাহ্! নিয়ম অনুসারে ওইটা শতভাগ পেনাল্টি। স্ট্রাইকারের কৃতিত্ব যে সে পেনাল্টি আদায় করে নিছে।’ পাশে দাঁড়িয়ে ওস্তাদ মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার মতো আমারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না খেলায় ফিরে আসার। একটা মাথা গরম, ফেরারি আসামি। কম বয়সী পোলা হইল ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে সহজ মুরগি। এদের আর ফেরার উপায় থাকে না।’ এরপরই হুট করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই কৌশল নিয়ে লিখেন? আজকের কোচ দারুণ ছিল না?’
‘আবার জিগায়। কাউন্টার অ্যাটাকভিত্তিক প্ল্যানটা একটা মাস্টারস্ট্রোক ছিল। লাতিন ইগো বাদ দিয়ে উনি চারজনের মিডফিল্ড সাজায়ে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরছেন। প্রতিপক্ষ আউলায়ে গেছে। বল ছাড়া অবস্থায় ওনার খেলোয়াড়েরা ক্রোয়েশিয়ার তিনজনের শক্তিশালী মিডফিল্ডকে এক কোনায় চাপায়ে দিছে আর ওদের হুমকি নাই করে দিছে। আবার যখন ট্রানজিশন বা নিজেরা বল পেয়ে আক্রমণে গেছে, তখন এতটা তেড়েফুঁড়ে গেছে যে প্রতিপক্ষ খেই হারায়ে ফেলছে।’
‘একদম! আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরাও এমনেই কাজ করে। আমিও একদিন ডন হমু’, আবারও সেই পুরোনো ক্রু হাসি ফিরে এল তাঁর মুখে। কিন্তু ততক্ষণে আমার ভয় উবে গেছে। আমি বরং ওনার সঙ্গে হাসিতে তাল মেলালাম। এই হাসি দুই ফুটবল ভাইয়ের হাসি। এই ভ্রাতৃত্ব এক অনন্য বন্ধন। এর চেয়ে শক্ত বন্ধন দুনিয়াতে হয় বলে আমার জানা নেই। চা খাওয়া শেষে বলেন, ‘যান, একটা রিকশা নেন, বাসায় গিয়ে আরাম কইরা লেখাটা শেষ করেন।’
‘এইবার কাপ মেসি নিবে বস’, রিকশায় উঠে বিদায় নিতে নিতে চিল্লায়ে বললাম। চারজনই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
আর ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি আমার শোবার ঘরের ছাদ। মুহূর্তের জন্য ভাবলাম, আমি কি জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখলাম! আমার সঙ্গে আসলেই কি এমন হইছিল? নাকি না? মেসির খেলা তো স্বপ্ন আর বাস্তবতার দূরত্ব মিটিয়ে দেয়, তাই না?