আনচেলত্তির কৌশলের সঙ্গে এবার পেরে ওঠেননি গার্দিওলা
আনচেলত্তির কৌশলের সঙ্গে এবার পেরে ওঠেননি গার্দিওলা

আনচেলত্তির ডিফেন্সিভ মাস্টারক্লাস আর ‘দার্শনিক’ গার্দিওলার ভবিষ্যদ্বাণী

গতি ও পরিবর্তনের সত্যতার সপক্ষে দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, ‘একই নদীতে দুবার গোসল করা যায় না।’ গতির মধ্য দিয়ে প্রতিটি বস্তুর সদা পরিবর্তনকে বোঝাতে উক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন হেরাক্লিটাস।

কদিন আগে হেরাক্লিটাসের সেই কথায় যেন ভিন্ন পটভূমিতে ও ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছে স্প্যানিশ কোচ পেপ গার্দিওলার মুখে। ফুটবলকে যদি দর্শন হিসেবে কল্পনা করেন, তাহলে গার্দিওলা তার মহত্তম দার্শনিকদের একজন। ফুটবলের নতুন দর্শনতত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর হাত ধরে। সেই গার্দিওলা চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটের প্রথম লেগের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদকে একইভাবে দুবার হারানো সম্ভব নয়।’

গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির মাঠ ইতিহাদ স্টেডিয়ামে রিয়ালকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করার স্মৃতির পুনরাবৃত্তি যে সম্ভব নয়, সেটি বোঝাতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন গার্দিওলা। ‘দার্শনিক’ গার্দিওলার সে ভবিষ্যদ্বাণী যে মিথ্যা ছিল না, সেটিই পরশু রাতে প্রমাণিত হয়েছে। এক বছর আগের সে রিয়াল এবং পরশু রাতের রিয়াল মোটেও এক দল ছিল না। না মানসিকতায়, না কৌশলে।

শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার পরপরই দলকে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলার নির্দেশ দেন রিয়াল কোচ আনচেলত্তি

রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৩-৩ গোলের ড্রয়ের সেমিফাইনালের ওঠার ভাগ্য নির্ধারণে সবার চোখ ছিল ইতিহাদে। ম্যাচের আগে ফর্ম আর সাম্প্রতিক হিসাব-নিকাশে সিটিকেই এগিয়ে রাখছিলেন সবাই। কিন্তু কে আর জানতেন, ইতিহাদে রীতিমতো দুর্গ নিয়ে হাজির হবেন আনচেলত্তি। ১২০ মিনিট এমনকি টাইব্রেকারেও সেই দুর্গকে হারাতে পারবেন না গার্দিওলা!

ম্যাচের ১২ মিনিটে গোল করে রিয়ালকে এগিয়ে দেন রদ্রিগো। এই গোলের পরই শুরু হয় আনচেলত্তির ডিফেন্সিভ মাস্টারক্লাসের প্রদর্শনীর। প্রথমার্ধে তবু আকস্মিক কিছু আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে পুরো ম্যাচটিই হয়ে পড়ে একরৈখিক। সিটির একের পর এক আক্রমণের ঝড় সামলেই কেটেছে পুরো সময়। এই অর্ধে রিয়াল শুধু নিজেদেরই নয়, সমর্থকদেরও স্নায়ুর পরীক্ষা নিয়েছে।

নিজেদের রক্ষণে আন্তোনিও রুডিগার, ফারলাঁ মেন্দি, দানি কারভাহালরা রীতিমতো ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা হয়ে ছিলেন। সে সময় মনে হচ্ছিল, প্রতিপক্ষ যদি গোলাবারুদ নিয়েও আসে, তবু রক্ষণের এই দুর্গ ভাঙতে পারবে না। ৭৬ মিনিটে কেভিন ডি ব্রুইনার গোলে সিটি সমতা আনলেও ঠেকিয়ে যাওয়ার কৌশল থেকে বিন্দুমাত্র টলানো যায়নি রিয়ালকে।

রিয়ালের ডিফেন্ডিং দেখে মনে হয়েছে, তারা চাইলে সিটিকে আরও অনেকক্ষণ আটকে রাখতে পারত

শুধু আক্রমণ নয়, কোনো দলের রক্ষণ সামলানোও যে আনন্দ নিয়ে দেখা যায়, সেটিই প্রমাণ করেছে আনচেলত্তির দল। এই সময় রক্ষণে রিয়ালের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার দৃশ্য মনে করিয়ে দিয়েছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই অমর কথাটি, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু হার মানতে পারে না।’

এই রিয়ালও যেন হারতে রাজি নয়! এ সময়টুকুতেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল, কেন তারা ইউরোপের রাজা। এই মঞ্চে একবিন্দু জায়গাও তারা বিনা যুদ্ধে দিয়ে দিতে রাজি নয়। এই মঞ্চে তারা এমনই অপ্রতিরোধ্য।

এটি একই সঙ্গে আনচেলত্তির কৌশলগত নৈপুণ্যের দুর্দান্ত প্রদর্শনীও। ম্যাচ শেষে তিনি বলেছেন, ‘সিটির বিপক্ষে জেতার এটাই একমাত্র উপায়। আমরা দুর্দান্ত ডিফেন্ডিং করেছি।’

টাইব্রেকারে সিটির দুটি শট ঠেকিয়ে দিয়েছেন রিয়াল গোলকিপার লুনিন

এটি স্পষ্ট যে প্রতিপক্ষের শক্তি সম্পর্কে সবটাই জানা ছিল আনচেলত্তির। সচেতন ছিলেন নিজের দলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও। ফলে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার কৌশলে হাঁটার চেষ্টাও করেননি ইতালিয়ান এই কোচ। মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা টাইব্রেকারে না যেত, তাহলে আরও কয়েক দিন এভাবে রক্ষণ সামলে যেতে পারত রিয়াল। কে জানে, রিয়ালের ডিফেন্সিভ মুভগুলো সামনের দিনগুলোয়ও গার্দিওলার স্বপ্নেও হানা দেয় কি না।

গার্দিওলার কৌশলের সপক্ষে ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরি বলেছেন, ‘ডিফেন্ডিং বলে কিছু আছে। ভালোভাবে রক্ষণ সামলেও আপনি ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন। আমি জানি, মানুষ বলবে সিটি সেরা দল। কিন্তু ডিফেন্ডিং ম্যাচেরই অংশ। আমি মনে করি, সেরা দল তারাই, যারা রক্ষণ ভালোভাবে সামলাতে পারে এবং সামনে এগিয়ে যেতে পারে।’

এই ম্যাচে শুধু মাঠের খেলাতেই নয়, টাইব্রেকারেও আনচেলত্তি তাঁর জাদুর কৌটা খুলেছেন। যেটি বাস্তবায়ন করেছেন ম্যাচজুড়ে অসাধারণ পারফর্ম করা আন্দ্রি লুনিন। ম্যাচ শেষে জয়ের অন্যতম নায়ক লুনিন বলেছেন, ‘টাইব্রেকারে কাউকে একজনের বিপক্ষে ঝুঁকি নিতে হতো, আমরা বের্নার্দো সিলভার বিপক্ষে নিয়েছি।’

গত বছর এ সিলভাই ছিলেন রিয়ালকে ডোবানোর নায়ক। কে জানে, সে প্রতিশোধই এবার আনচেলত্তি নিলেন কি না। কারণ যা-ই হোক, এই কৌশলও বক্সে টিক দিয়ে গেছে। আর রিয়াল পৌঁছে গেছে আরেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে। এখান থেকে আর মাত্র দুটি ধাপ পেরোলেই ১৫তম চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি, যা এখন রিয়ালের জন্য আর কোনো স্বপ্ন নয়। যা আপনি নিয়মিতই করেন, তা তো আর স্বপ্ন হতে পারে না।