পরপর তিনটি দৃশ্য। দেখলে কিংবা বর্ণনা করলে মুহূর্তগুলোর মাধুর্যটা ধরা যায়।
প্রথম দৃশ্য। সাঁতার পুলে কিছুক্ষণ আগেই আরিয়ার্নে টিটমাস ও মলি ও’কালাহানের ধুন্ধুমার লড়াই শেষ হয়েছে। নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে (১ মিনিট ৫৩.২৭ সেকেন্ড) সোনা জিতেছেন মলি ও’কালাহান। বলা যায়, মেয়েদের ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে তাঁর কানের পাশ দিয়ে ‘টিটমাস গুলি’ গেছে। সর্বশেষ অলিম্পিকে এ ইভেন্টে টিটমাস ছিলেন চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক রেকর্ড ও বিশ্ব রেকর্ডও ছিল তাঁর দখলে। কিন্তু মাত্র দুই মিনিটের ব্যবধানে টিটমাসের এ ‘পৃথিবী’ ওলট-পালট!
কাল টিটমাসকে মাত্র ০.৫৪ সেকেন্ড ব্যবধানে পেছনে ফেললেন মলি ও’কালাহান। তাতে এই ইভেন্টে তাঁর সোনা এবং অলিম্পিক রেকর্ডও হয়ে গেল। এমনিতে ও’কালাহান টিটমাসেরই অস্ট্রেলিয়ান সতীর্থ। শুধু সতীর্থ বললে ভুল হবে। দুজন একই কোচের (ডিন বোক্সাল) শিষ্য, অনুশীলনসঙ্গী এবং বন্ধুও। এই দুজনের অমন লড়াইয়ের পর জন্ম নিল দৃশ্যগুলো। অলিম্পিকে লোকে যা দেখে চোখ জুড়াতে চায়, তেমন দৃশ্য।
সাঁতার শেষে টিটমাসের চোখেমুখে হতাশার লেশমাত্র নেই! পুলেই জড়িয়ে ধরেন ও’কালাহানকে। প্রথম দৃশ্যের অবতারণা এখানেই।
দ্বিতীয় দৃশ্যটি ধরিয়ে দিয়েছেন ‘থর্পেডো’খ্যাত ইয়ান থর্প। অলিম্পিক সাঁতারে পাঁচটি সোনাজয়ী অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ফক্স স্পোর্টসকে বলেছেন, ‘পুল থেকে ডেকে ওঠার পর মলি ও’কালাহান যখন দুই হাত তুলে ধরল, তখন আরিয়ার্নে টিটমাস তাকে জড়িয়ে ধরে।’
তৃতীয় দৃশ্যটি এতক্ষণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে আসার কথা। মলি যেহেতু সোনা জিতেছেন, তাই বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন সবচেয়ে ওপরের ধাপে। কিন্তু বন্ধুকে নিচে রেখে একা একা সেখানে দাঁড়াতে হয়তো তাঁর ভালো লাগছিল না। তাই ডেকে নেন টিটমাসকে। বর্তমান সময়ে অন্যতম সেরা দুই সাঁতারু যখন বিজয়মঞ্চে সবচেয়ে উঁচু ধাপে একসঙ্গে দাঁড়ালেন, চ্যানেল নাইনের ধারাভাষ্যকার ম্যাট থম্পসন বলে উঠলেন, ‘মলির আরেকটি “ক্ল্যাসি” ছোঁয়া। মঞ্চে সোনা জয়ের জায়গাটি সে ভাগ করে নিয়েছে।’
টিটমাসকে নিশ্চয়ই আপনার জানা। এ মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারের ‘সাইনবোর্ড’। এবারের প্যারিস অলিম্পিকে ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ‘রেস অব দ্য সেঞ্চুরি’তে যুক্তরাষ্ট্রের জায়ান্ট কেটি লেডিকিকে হারিয়ে সোনা জিতেছেন। গত ১০০ বছরে ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে টানা দুটি অলিম্পক সোনাজয়ী প্রথম নারীও টিটমাস। বাইরে যতই বন্ধুত্ব থাক, পুলের এই দৈত্যই যখন প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন মলির ভাবনা কী? টিটমাস কেন, প্রতিদ্বন্দ্বী যে-ই হোক, মলির ভাবনা একটাই, ‘চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। হয় আপনি পালাবেন, নয় লড়াই করবেন। আমি লড়াই বেছে নিয়েছি।’
সেই লড়াই শেষে অবশ্য দুজন আবার বন্ধু। মলি তাঁর বন্ধুর প্রাপ্য প্রশংসাই করলেন, ‘সবার সঙ্গে থাকতে পারা এবং আরিয়ার্নের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারা আমার জন্য সম্মানের। সে দুর্দান্ত। পশুর মতো সাঁতরায়। দারুণ একটি দলের অংশ হওয়া এবং তার সঙ্গে অনুশীলন করতে পারাও আমার জন্য সম্মানের।’
সম্মানের কথাই যেহেতু উঠল, তাই দৃশ্যপটে সবার আগে আনতে হয় মলির মা টনিকে। মলি সোনা জয়ের পর মা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বলেছেন। সংবাদকর্মীরা সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টনি বলেছেন, ‘কতটা গর্বিত, সেটা বলেছি। কয়েক সপ্তাহ ওর সঙ্গে কথা বলিনি। চেয়েছিলাম, নিজের কাজটা সে ভালোভাবে করুক।’ ওদিকে মলির সামনে সংবাদকর্মীরা তাঁর মা–বাবার প্রসঙ্গ তুলতে তিনি কেঁদেই ফেললেন। কারণটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘মা–বাবাকে দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি। আমি মূলত তাঁদের জন্য সাঁতরাই। ছোটবেলায় তাঁরা আমার সাঁতারের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা না থাকলে আমি এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। কান্না করাটা হয়তো উচিত হয়নি। তবে তাদের পেয়ে আমি সৌভাগ্যবান।’
প্যারিসে মা–বাবাকে পেয়ে মলির নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করাই স্বাভাবিক। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকে অস্ট্রেলিয়া দলের সর্বকনিষ্ঠ অ্যাথলেট ছিলেন মলি। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। ওই বয়সে মা–বাবাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা এবং ঝামেলার ব্যাপারে মোটামুটি সবারই কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে। ও’কালাহান পরিবার অবশ্য সন্তানের এমন সাফল্যে বসে থাকেনি। মলির এই সোনালি সাফল্য আইরিশ পানশালায় গিয়ে উদ্যাপন করেছেন টনি ও নিক ও’কালাহান।
মলির অলিম্পিক ক্যারিয়ারে ব্যক্তিগত ইভেন্টে এটি প্রথম সোনার পদক। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে তিনি ছুটেছেন ব্যক্তিগত কারণে নয়, ‘সত্যি বলতে, আমি এটা দেশের জন্য করেছি। নিজের জন্য নয়। এই সব মানুষের (অস্ট্রেলিয়ান) জন্য আমি সাঁতরাই।’
তো, এসব মানুষের আওতায় তো টিটমাসও পড়েন। মলিকে তিনি যতই জড়িয়ে ধরেন, ভেতরে–ভেতরে হৃদয় তো ভেঙেছেই। পরপর দুটি ‘গোল্ডেন ডাবল’ জয়ের সুযোগটা যে মলির জন্যই হাতছাড়া হলো! টিটমাসেরও তাই চোখ ভিজেছে। কিন্তু মলির চেয়ে যেহেতু বয়সে বড়, সতীর্থ হিসেবেও সিনিয়র, তাই ২৩ বছর বয়সী এই সাঁতারুর কথায় কষ্ট অনূদিত হওয়ার চেয়ে অভিজ্ঞতাই ফুটল বেশি, ‘এ আনন্দাশ্রু। এমন পরিস্থিতিতে আবেগ ধরে রাখা কঠিন। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হলে কেমন লাগে, আমি জানি। মলির জন্য সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে।’
টিটমাসের এই সুখানুভূতির ব্যাখ্যাটা অলিম্পিক শুরুর আগেই দিয়ে রেখেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। অস্ট্রেলিয়ার সাঁতার দলের সবাই বিশ্বাস করেন, ও’কালাহানের মধ্যে কিছু একটা আছে! অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দুই সাঁতারু এমা ম্যাককিওন ও স্টেফানি রাইসকে কোচিং করানো মাইকেল বোলের কথা শুনতে পারেন। বোলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করা ডিন বোক্সালের ছাত্রীই টিটমাস ও ও’কালাহান। বোল বলেছেন, ‘যেভাবে সে সাঁতরায়, যেন পাঠ্যবই। কৌশলগত দিক থেকেও নিখুঁত এবং দারুণ অ্যাথলেট।’
ও’কালাহানকে কাছ থেকে দেখা প্রায় সবাই একটি ব্যাপারে একমত। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিকতা এবং পানিতে ‘কিক’ করার কৌশল বাকিদের চেয়ে আলাদা। ও’কালাহান সাত বছর বয়সে যখন ব্রিসবেনে ওয়াটারওক্স ক্লাবে সাঁতার শিখতে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তাঁর কোচ ছিলেন পল স্যানসবাই। সেই স্মৃতি স্মরণ করে গত এপ্রিলে গার্ডিয়ানকে স্যানসবাই বলেছিলেন, ‘(তখন) তার পায়ের পাতার অবস্থা এমন ছিল যে তার মাটিতে হাঁটতে পারার কথা নয়।’
ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ও’কালাহান ‘পিজিওন-টোড’, অর্থাৎ কবুতরের মতো দুই পায়ের পাতা ভেতরের দিকে রেখে হাঁটতেন। হাঁটু একটি বেশি সম্প্রসারিত হওয়ায় পানির মধ্যে ‘কিক’ করায় আলাদা শক্তিও পান। স্যানসবাইয়ের ভাষায়, ‘সবাই তাকে বলে “পানিতে পিচ্ছিল”। বাকিরা যতটুকু চেষ্টা করবে, সে একই চেষ্টা করে পানির মধ্যে বাকিদের তুলনায় চার থেকে পাঁচ মিটার দূরত্ব বেশি যেতে পারবে। পানিতে সে প্রচণ্ড দক্ষ। যেন পানিতেই তার জন্ম। অনেকটাই মানবরূপী ডলফিন।’
‘তাসমানিয়ান টার্মিনেটর’ টিটমাস দুঃখের পর নিশ্চয় খুশিও হয়েছেন। ‘টার্মিনেটর’–এর হাত থেকে ডলফিন এ যাত্রায় তো বেঁচে গেল। হাজার হোক বন্ধু তো!