রাত তখন প্রায় ১১টা। কখন আসবে প্রতীক্ষিত সেই সময়! অবশেষ তা এল। ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের বিশাল বলরুমের আলোঝলমলে রিংয়ে নামলেন সুর কৃষ্ণ চাকমা। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নামেন নেপালের মহেন্দ্র বাহাদুর চাঁদ।
গত রাতে শেষ হওয়া প্রো-বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২.০ ফাইট নাইটে আটটি বাউটের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাউট। যার জন্য হলভর্তি আমন্ত্রিত অতিথি আর দর্শকেরা মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও রাজি ছিলেন। সুর কৃষ্ণ নিরাশ করেননি। এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের সুপার লাইটওয়েট ইন্টারকন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপে ঠিকই বাজিমাত করেছেন। হারিয়ে দিয়েছেন নেপালের বক্সারকে।
জয়ী ঘোষণার পর সুর কৃষ্ণকে পরিয়ে দেওয়া হয় পেশাদার বেল্ট। পেশাদার বক্সিংয়ে যেটি প্রথম কোনো বাংলাদেশি বক্সার হিসেবে পেলেন তিনি। আর সেই বেল্ট পরে উচ্ছ্বসিত সুর কৃষ্ণ রাত প্রায় ১২টার দিকে রিংয়ে দাঁড়িয়ে একের পর এক ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছিলেন। চারপাশে করতালির শব্দ। প্রতিক্রিয়া জানানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল সুর কৃষ্ণের জন্য।
তবু রিংয়ে দাঁড়িয়ে এক ফাঁকে এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘এটি এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের বেল্ট। অনেক স্বপ্নের বেল্ট আমার জন্য। বাংলাদেশে যা আর কেউ পায়নি। এই টাইটেল বেল্ট পেয়ে আমি খুব খুশি। প্রতি তিন মাস পরপর এখন আমাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের যে টাইটেল তালিকা আছে, ওখানে আমার নাম থাকবে।’
পেশাদার বক্সিং করছেন বলে এখন আর অপেশাদার খেলায় অংশ নিচ্ছেন না সুর কৃষ্ণ। অপেশাদার বলতে বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের অধীনে যেসব আয়োজন হয় সেসব। সুর কৃষ্ণ গত বছর কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এরপর আর খেলছেন না। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সুর কৃষ্ণ জানান দুটি ভিন্ন ঘরানার কথা, ‘পেশাদার আর অপেশাদার বক্সিং আলাদা। দুটোর অনুশীলনও আলাদা। দুটি একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। তাই আমি পেশাদার বক্সিংয়ে পুরো সময় দিচ্ছি।’
সুর কৃষ্ণ এরপর যোগ করেন, ‘পেশাদার বক্সিংয়ে ভালো করলে দেশেরই নাম হয়। আমি তাই এটাতেই সময় দিচ্ছি। অ্যামেচারে (অপেশাদার) যে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, সে দেশের হয়ে কোনো গেমস বা টুর্নামেন্টে খেলে। কিন্তু পেশাদার বক্সিং হয় র্যাঙ্কিং অনুযায়ী। এর সূচিটাই আলাদা। আপনি আপনার মান অনুযায়ী অন্য বক্সারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।’
পেশাদারের তুলনায় অপেশাদার বক্সিংই বাংলাদেশি বক্সারদের কঠিন মনে করা হয়ে থাকে। এ নিয়ে সুর কৃষ্ণের ব্যাখ্যাটা এ রকম, ‘আপনি যখন এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে যাবেন তখন দেখবেন প্রতিপক্ষ বক্সাররা অনেক বেশি অভিজ্ঞ। তিন মাস অনুশীলন করে আমরা তাদের সঙ্গে কখনো রেজাল্ট করতে পারব না। এ জন্য অপেশাদার বক্সিংয়ে ভালো করা বাংলাদেশিদের জন্য অনেক কঠিন। আমি দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে যদি খালি ঘুরে আসি, তাহলে দেখতে খারাপ লাগে। এ জন্য আমি জানিয়ে দিয়েছি অ্যামেচার বক্সিং আর করব না। পেশাদার বক্সিং করব। এখানেও দেশের নাম করা যায়।’
ছেলে সুর কৃষ্ণের সাফল্যে দারুণ খুশি মা সারনা চাকমা। রাঙামাটি থেকে তিনি ঢাকায় ছুটে এসেছেন ছেলের টাইটেল ফাইট দেখতে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে সুর কৃষ্ণ সবার বড়। ছোটজন দেব চাকমা এসেছে মায়ের সঙ্গে। এসেছেন সুরের স্ত্রী, শাশুড়িও। মধ্যরাতে বাউট শেষে হোটেলে সুর কৃষ্ণের সঙ্গে পাওয়া গেল তাঁদের। উচ্ছ্বসিত মা বললেন, ‘অনেক দূর এগিয়ে গেছে আমার ছেলে। আমরা খুশি। ছোটবেলায় ওকে কারাতেতে ভর্তি করে দেয় ওর বাবা। কারণ, ঘুষাঘুষির প্রতি আগ্রহ ছিল ওর। আর এটা সে ভালো পারে। আজ ওর বাবা নেই, মারা গেছেন (সোনালি ব্যাংকে চাকরি করতেন)। তিনি থাকলে খুশি হতেন।’
রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে সুর কৃষ্ণ বাড়ি জোড়াছুড়ি যেতে হয়। নৌকাই নাকি যাওয়ার একমাত্র পথ। সেই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে এসে সুর কৃষ্ণ এখন বাংলাদেশের বক্সিংয়ের আলোচিত নাম। তাঁর পরিবারের কেউ বক্সিং করেননি। ছোটবেলায় বিকেএসপিতে ভর্তি হতে ফুটবলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন সুর কৃষ্ণ। কিন্তু ফুটবলে না টেকার পর ট্রায়াল দেন বক্সিংয়ে। টিকেও যান। ব্যস, এভাবেই হয়ে গেলেন বক্সার।
২০০৭-১৩ বিকেএসপিতে কাটিয়ে আজ তিনি পেশাদার বক্সিং করছেন। এতে গর্বিত ভাবেন নিজেকে, ‘এর আগে আমি পাঁচটি পেশাদার টুর্নামেন্ট খেলেছি। ভারতে দুটি, দেশে তিনটি। সব কটিতেই আমি জিতেছি। সামনে আরও জিততে চাই। অনেক দূর যেতে চাই।’
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পেশাদার বক্সিং চালুর পর থেকে মানুষ বক্সিংয়ের কথা শুনছে, জানছে। আগে অনেকে বক্সিংয়ের কথা জানতই না মন্তব্য করে সুর কৃষ্ণ বলেন, ‘২০১৪ থেকে আমি অপেশাদার বক্সিং করি। কিন্তু আমাকে কেউ এত দিন চিনত না। পেশাদার বক্সিং শুরুর পরই চিনছে। মানুষ খেলাটা নিয়ে জানার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এখানে আর্থিক সুবিধা আছে, যেহেতু পেশাদার। বাংলাদেশে এখন অনেকেই পেশাদার বক্সিং করে।’
বাংলাদেশের প্রো-বক্সিংয়ের আয়োজক এক্সবিসির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ। তাতে অংশ নিয়েছেন রাশিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, নেপাল, ভারত ও স্বাগতিক বাংলাদেশের ১৬ জন বক্সার। আটটি বাউটে খেলেন তাঁরা। সুপার মিডলওয়েট বাউটে চার রাউন্ডের ম্যাচে বাংলাদেশের জুয়েল আহমেদ জনি হারিয়ে দেন ভারতের যুগন্ধর তাম্বাটকে।
মেয়েদের ছয় রাউন্ড ফ্লাইওয়েট বিভাগে বাংলাদেশের স্বদেশি আফরা খন্দকারের বিপক্ষে জিতেছেন বাংলাদেশেরই তানজিলা। ওয়েল্টার ওয়েটে বাংলাদেশের আল আমিনের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরেছেন রাশিয়ার কনস্ট্যান্টিন রুডেনকো। তবে তুরস্কের বাতুহান বোরালের কাছে হেরেছেন বাংলাদেশের জাহিদুল ইসলাম। এটি ছিল লাইট হেভিওয়েট।
গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ বক্সিং ফাউন্ডেশন সফলভাবে আয়োজন করেছিল প্রো-বক্সিং ইভেন্ট সাউথ এশিয়ান প্রফেশনাল বক্সিং ফাইট নাইট। এরই ধারাবাহিকতায় এবার হয়েছে আরেকটি চ্যাম্পিয়নশিপ। যার স্পনসর ছিল বেক্সিমকো। আর তাতে সব আলো কেড়ে নিয়েছেন একজন— সুর কৃষ্ণ।