মিরপুর সুইমিংপুলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে মূল্যবান ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড। সাঁতার ফেডারেশন ঘরোয়া প্রতিযোগিতা সারছে হ্যান্ডটাইমিংয়ে
মিরপুর সুইমিংপুলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে মূল্যবান ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড। সাঁতার ফেডারেশন ঘরোয়া প্রতিযোগিতা সারছে হ্যান্ডটাইমিংয়ে

৫ কোটি টাকার ‘ভুতুড়ে’ ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড

বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন চারবার। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, এসএ গেমস মিলিয়ে আরও আটবার নেমেছেন আন্তর্জাতিক গেমসের পুলে। কিন্তু এসএ গেমসে সোনাজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন যখনই দেশের বাইরে গিয়ে ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে নিজের টাইমিং দেখেন, প্রতিবারই বিব্রত হন। দেশে সারা বছর হ্যান্ডটাইমিংয়ে অনুশীলন করা মাহফুজার কাছে আন্তর্জাতিক গেমসের সাঁতারের ছবিটাই যেন অন্য রকম!

২০১৯ সালে মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড বসানো হলেও এখনো সাঁতারুদের অনুশীলন ও ঘরোয়া প্রতিযোগিতা চলে হ্যান্ডটাইমিংয়ে। ২০১৯ সালে সেরা সাঁতারুর খোঁজে প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সুইমিংপুল সংস্কারের উদ্যোগ নেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। এরই অংশ হিসেবে পুরোনো স্কোরবোর্ড সরিয়ে বসানো হয় ডাকট্রোনিকস কোম্পানির নতুন স্কোরবোর্ড। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকার স্কোরবোর্ড দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না সঠিক টাইমিং।

নতুন স্কোরবোর্ড বসানোর পর বাংলাদেশ গেমস, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ও বয়সভিত্তিক জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়েছে। কিন্তু সবই হয়েছে হ্যান্ডটাইমিংয়ে। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, সব কটি লেনে একসঙ্গে টাইমিং ওঠে না। কখনো আট লেনের মধ্যে পাঁচটি বা ছয়টি লেনে টাইমিং ওঠে। যে কারণে ওই হিটের কোনো সাঁতারুর টাইমিংই ধরা সম্ভব হয় না। কখনো আবার সর্বশেষ লেনের টাইমিং দৃশ্যমান হয় প্রায় ১০ সেকেন্ড পরে। এতে ওই সাঁতারু যে সময়ে সাঁতার শেষ করেন, স্কোরবোর্ডে তাঁর নামের পাশে টাইমিং দেখা যায় আরও ১০ সেকেন্ড বাড়তি। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড থাকার পরও বাংলাদেশের সাঁতারে এখনো তাই ভরসা হয়ে আছে হ্যান্ডটাইমিং।

ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের এমন অদ্ভুত আচরণ কেন, সেটি গত তিন বছরেও ধরতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। এটি সংস্কার বা বদলানোরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে এনএসসির কর্মকর্তা ও ফেডারেশনের মধ্যে চলছে চাপান–উতোর। এনএসসি অনেক সময় অভিযোগ করেছে, সাঁতারুরা ঠিকভাবে ‘টাচ প্যাডে’ স্পর্শ করতে পারেন না বলেই নাকি স্কোরবোর্ডে টাইমিংও ঠিকভাবে ওঠে না। আবার ফেডারেশনের দাবি, সমস্যা স্কোরবোর্ডেই।

এনএসসির কর্মকর্তারা ফেডারেশনকে একাধিকবার স্কোরবোর্ড বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাই সেটি বুঝে নিচ্ছে না ফেডারেশন। সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই স্কোরবোর্ড বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ট্রায়ালের আয়োজন করে এনএসসি। ট্রায়ালে আনা হয় বিকেএসপি ও নৌবাহিনীর সাঁতারুদের। কিন্তু সেদিনও একই ঘটনা। ৯ বার ট্রায়াল নিয়েও পাওয়া যায়নি সঠিক টাইমিং!

স্কোরবোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রকৌশলী এনএসসির সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সুকুমার সাহা বলেছেন, ‘স্কোরবোর্ডে একেক সময়ে একেক লেনে একেক রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যে কারণে বিভ্রান্তি থেকেই যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা নিজেরাও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। তবে সমস্যা একটা আছে, সেটা বুঝতে পেরেছি।’

সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বুয়েটের শরণাপন্ন হতে চান তিনি, ‘এই ধরনের স্কোরবোর্ড বিশেষজ্ঞ আমাদের দেশে নেই। চেষ্টা করছি বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এটা দেখানোর। সরকারের এত টাকা খরচ হলো, কিন্তু সেটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। এর জবাবদিহি তো করতেই হবে।’

স্কোরবোর্ডে ঝামেলার শেষ দেখতে চান সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা বদরুল সাইফ, ‘আমরা টেকনিক্যাল বিষয় বুঝি না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এটা দিয়ে ট্রায়াল দিয়েও সঠিক টাইমিং পাইনি। বাধ্য হয়ে প্রতিটি গেমস চালাচ্ছি হ্যান্ডটাইমিংয়ে। এর স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। ঢাকায় আট দেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক গেমস করার পরিকল্পনা করেছি। তাই দ্রুত স্কোরবোর্ডটি সচলের দাবি জানাচ্ছি।’

বাংলাদেশের সাঁতারে অবশ্য ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড একটা পুরোনো সমস্যা। ১৯৯৩ সাফ গেমসের আগে মিরপুর সুইমিংপুলে বসানো হয়েছিল প্রথম ইলেকট্রনিক বোর্ড। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে ওই স্কোরবোর্ডে অদ্ভুতুড়ে আচরণ করত। ২০১০ এসএ গেমসে সেটা সচল করার পরও প্রায়ই তাতে সমস্যা দেখা দিত। এরপর ২০১৯ সালে বসানো হয় বর্তমান স্কোরবোর্ডটি। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকার সেই স্কোরবোর্ডের আচরণও একই রকম—ভুতুড়ে!