তাসলিমা খাতুনের জীবনে অবসর বলে কিছু নেই। সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয় দুই মেয়েকে নিয়ে। স্বামী ইতালিতে। ফলে মেয়েদের পড়াশোনা, স্কুল-কলেজ একা হাতে সামলে নিজের জন্য আর সময় থাকে না। তার ওপর দুই মেয়ের দাবা খেলা পড়লে তো কথাই নেই। মেয়েদের ভেন্যুতে আনা-নেওয়া, খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কখনো কখনো সাত-আট ঘণ্টাও বসে থাকা। এই জীবনে আসলে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
২০২৩-এর শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় যেমন তাঁকে পাওয়া গেল পল্টনের বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন কক্ষে। অনেক সময়ই টুর্নামেন্ট চললে যা তাঁর ঘরবাড়ি হয়ে যায়। মগবাজারের বাসায় তালা মেরে সকাল ১০টায় বেরিয়েছেন। এদিন দাবা ফেডারেশনে এসেছেন একটা আনন্দকে সঙ্গী করে। আগের দিনই শেখ রাসেল ৪১তম অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় জুনিয়র দাবায় এক রাউন্ড হাতে রেখেই টানা ৮ ম্যাচ জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে ১৫ বছর বয়সী তাঁর ছোট মেয়ে ওয়াদিফা আহমেদ। শেষ দিনের আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচটা ফুরফুরে মেজাজে খেলে ড্র করেছে।
ম্যাচ শেষ করে ওয়াদিফা আবার আরেকটি টুর্নামেন্টে বসে পড়েছে একই জায়গায়। এটি রেটিং টুর্নামেন্ট। প্রথম ম্যাচটা শেষ করে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বেরিয়ে আসার পর মা জানতে চাইলেন, ‘রেজাল্ট কী?’ মেয়ে বলল, ‘জিতেছি।’ মুখে চওড়া হাসি নিয়ে মা এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘যার সঙ্গে জিতেছে, সে অনেক ভালো খেলোয়াড়।’
ছোট মেয়ের খেলা শেষ, তারপরও তাসলিমা খাতুনকে অপেক্ষায় থাকতে হলো। কারণ, তাঁর বড় মেয়ে ওয়ালিজা আহমেদও রেটিং টুর্নামেন্টে খেলছেন। ২০ বছর বয়সী ওয়ালিজা ২০২২ সালে জাতীয় জুনিয়র টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। পরের বছরই একই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন তাঁর পাঁচ বছরের ছোট বোন। বাংলাদেশের দাবায় এটি রেকর্ড। দুই বোনের খেলার উদাহরণই তো বিরল। অতীতে সৈয়দা শাবানা পারভীন নীপা-আফসানা পারভীন নীরা—দুই বোন খেলেছেন। তবে এই বোনদের মতো জাতীয় স্তরে একই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কীর্তি নেই তাঁদের।
তাসলিমা খাতুনের পরিশ্রম তাই অনেকটা সার্থক। ২০১৫ সালে ইতালির মিলানের প্রবাসজীবন ছেড়ে দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। এসেই এক যুদ্ধ। মেয়েদের বাংলা স্কুলে ভর্তি করাবেন কিন্তু তাঁরা তো বাংলা জানেন না। জানেন শুধু ইতালিয়ান ভাষা। অগত্যা বাসায় শিক্ষক রেখে অ, আ, ক, খ শিখিয়েছেন এক বছর। ওয়ালিজা এক বছর বিরতি দিয়ে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েছেন মগবাজার ইস্পাহানি স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথমও হয়েছেন। সপ্তম শ্রেণিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ভর্তি হয়ে এখন উচ্চমাধ্যমিক দেবেন। এর আগপর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই জিপিএ–৫ পেয়েছেন। ইস্পাহানিতে নবম শ্রেণিতে ওঠা ওয়াদিফা দাবা ফেডারেশন কক্ষে মায়ের পাশে বসে বলল, ‘আমরা বাংলা কিছুই পারতাম না। বাংলা শিখেই বাংলা মাধ্যমে পড়ছি।’
বড় বোন ওয়ালিজা কারাতেও শেখেন। বই পড়েন। একটু গম্ভীর। ওয়াদিফা চটপটে। আগে মিষ্টি পছন্দ করত, কিন্তু বড় বোন মিষ্টি খান না বলে সে-ও তা খায় না। ছোটজনের উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, বড়জন ৫ ফুট ৩। ওয়ালিজা হেসে বললেন, ‘চেহারা, উচ্চতা-টুচ্চতা মিলিয়ে সবাই আমাদের যমজ বোন মনে করে।’ পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশ দাবার আন্তর্জাতিক বিচারক হারুনুর রশিদ নতুন একটা তথ্য দেন, ‘জানেন তো, ওদের বাবা মাঈনুদ্দিন আহমেদ (মামুন) কিন্তু জাতীয় দাবাড়ু ছিল। একবার খেলেছে ন্যাশনালে।’
মাঈনুদ্দিন ইতালি চলে যান ১৯৯০ সালে। দেশে এসে ২০০০ সালে বিয়ে করেন। ২০০৩ সালে ওয়ালিজা, ২০০৮ সালে ওয়াদিফার জন্ম মিলানে। সেখানেই মেয়েদের দাবার হাতেখড়ি। তাঁদের মা গাজীপুরের কাপাসিয়ার মেয়ে তাসলিমা খাতুন বলে চলেন, ‘ওদের বাবা ইতালিতে গিয়েও দাবা খেলত। অনেক পুরস্কার আনত বাসায়।’ সেই পুরস্কার দেখে বড় মেয়ে ওয়ালিজার কৌতূহল জাগে। ওয়ালিজা ফিরে তাকান সেই সব দিনে, ‘বাবা বিশাল বিশাল কাপের মতো ট্রফি পেত। এগুলো দেখে আমি ভাবতাম, এত বড় কাপে বুঝি পানি খায়। বাবা প্রথমে সেভাবে দাবা শেখাতে চাইতেন না আমাকে। মা আমাকে ঘুঁটি-বোর্ড চেনান। যখন বাবা দেখেন আমি চাল দিতে পারি, উনি অবাক হন এবং আমাকে শেখান।’ আর বোনের কাছে শেখে ওয়াদিফা।
আপাতত মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই। জিএম হওয়ারও ইচ্ছা আছে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইট দেওয়ারও স্বপ্ন দেখি।আহমেদ ওয়ালিজা
দুজনই রুই লোপেজ ওপেনিং ভালোবাসেন। ওয়ালিজা আক্রমণাত্মক, ওয়াদিফা একটু রয়েসয়ে খেলে। ওয়ালিজা ২০২১ সালে জাতীয় মহিলা দাবায় রানারআপ হয়েছেন। ওয়াদিফা ষষ্ঠ হয়েছে এই প্রতিযোগিতায়। রানী হামিদের মতো কিংবদন্তি দাবাড়ুকে হারিয়ে চমক দিয়েছেন তাঁরা। দুজনই বিদেশে খেলেছেন কিছু টুর্নামেন্টে। গত বছর ঢাকায় জোনাল টুর্নামেন্টে ভালো করে সরাসরি মহিলা ফিদে মাস্টার হয়ে গেছে ওয়াদিফা। নেপালে সার্ক দাবায় রানারআপও। ওয়ালিজা ক্যান্ডিডেট মাস্টার থেকে চেষ্টা করছেন ফিদে মাস্টার হতে। কিন্তু পড়াশোনার চাপে খেলায় সময় দিতে পারেন কম।
তবু তাঁর দাবা-স্বপ্নটা বড়ই। বললেন, ‘আপাতত মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই। জিএম হওয়ারও ইচ্ছা আছে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইট দেওয়ারও স্বপ্ন দেখি।’ ওয়াদিফা বলল, ‘আমি চাই মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার হতে।’ রানী হামিদ, শারমিন সুলতানা শিরিন, শামীমা আক্তার লিজারা আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টারে আটকে আছেন বহু বছর। তাঁদের ছাপিয়ে যেতে দুই বোন বিদেশে আরও খেলতে চান, কোচ চান। সেই স্বপ্নপূরণে একটা বড় বাধা আর্থিক সীমাবদ্ধতা। এত কিছু জয় করার পর সেটিকেও অজেয় বলে কেন মনে করবেন তাঁরা!