ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এখন নীরব, খেলাটাই হারিয়ে যেতে বসেছে এই মাঠ থেকে
ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এখন নীরব, খেলাটাই হারিয়ে যেতে বসেছে এই মাঠ থেকে

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম: খেলাটাই যেখানে হারিয়ে গেছে

এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম—এইসব দিনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকায় পা রাখলে অনেকের ভেতরেই এমন প্রশ্ন জাগতে পারে!

এমনিতেই সংস্কারকাজ চলায় ২০২০ সাল থেকেই খেলাটেলা নেই দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এই ক্রীড়া স্থাপনায়। আপনি যদি খেলাপ্রেমী হন, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সঙ্গে আপনার যদি আত্মিক সম্পর্কটা থেকে থাকে, তাহলে একধরনের মন খারাপের অনুভূতি আপনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে—এখানে যে খেলা ছাড়া আর সবকিছুই হচ্ছে। আরেকটি বিষয় মনে হতেই পারে—এটা দেশের একটি ক্রীড়া ভেন্যু, নাকি কোনো বাজার! পরিবেশ দেখে এটিকে একটি বিশালকায় ‘ভাগাড়’ বললেও বেশি বলা হয় না।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ‘আধুনিক’ চেয়ার বসবে নতুন করে। কিন্তু সেই কাজ শেষ হবে কবে

স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখেই আপনাকে ‘বাধা’র সম্মুখীন হতে হবে। গাড়ি নিয়ে যদি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে চান, তাহলে বিপ পরা এক ব্যক্তি এসে আপনার গাড়ির গতিরোধ করবেন। তিনি পার্কিং চার্জ আদায় করছেন। ২০ টাকা তাঁর হাতে দিলে তিনি আপনাকে একটি টিকিট ধরিয়ে দেবেন। আপনি ২০ টাকা খরচ করে গাড়ি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে রাখতেও পারেন, না–ও পারেন। ইদানীং একটি জিনিস দেখা যায়, গুলিস্তান এলাকার যানজট এড়াতে অনেকেই ২০ টাকা ‘টোল’ দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ভেতর দিয়ে ‘বাইপাস’ করেন। মোটকথা, স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ পরিণত হয়েছে গুলিস্তান থেকে দিলকুশা বা মতিঝিল যাওয়া–আসার পথে।

কত স্মৃতি, কত ইতিহাস এই মাঠে

যান্ত্রিক যান তো তা–ও ২০ টাকা খরচ করে প্রবেশ করছে। রিকশা কিংবা ভ্যানের সেখানে অবাধ প্রবেশাধিকার। রিকশাচালক ভাইয়েরাও বুঝে গেছেন, যানজট এড়িয়ে গুলিস্তান থেকে মতিঝিল কিংবা দিলকুশা যাওয়া–আসার খুব ভালো পথ এটি। একটা দেশের এক নম্বর ক্রীড়া স্থাপনার কী নিদারুণ ব্যবহার! শুধু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রবেশপথগুলো থেকেই ২০ টাকা করে কী পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হচ্ছে, সেটিও একটা ভাবনার বিষয়। এই টাকা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ উন্নয়নের কোন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর কী আছে?

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রবেশ মুখ: প্রাকৃতিক কার্যাদি সারার স্থান। বসে আছে মাদকসেবীও

অথচ, এই স্টেডিয়াম দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সূতিকাগার। কতশত রোমাঞ্চকর স্মৃতি মিশে আছে এই স্টেডিয়ামের আকাশে–বাতাসে। এই স্টেডিয়ামে পা রেখেছেন মোহাম্মদ আলী, জিনেদিন জিদান, লিওনেল মেসি, আনহেল দি মারিয়া, হাভিয়ের মাচেরানো, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সের্হিও আগুয়েরো, ওবি ডি মিকেল, ভিনসেন্ট এনিমিয়ারা। মেসি–ওবি মিকেলরা ২০১১ সালে আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ মাতিয়েছিলেন এ স্টেডিয়ামের মাঠ।

সংস্কারের ভারে নুইয়ে পড়েছে এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম

এর আগেও তো কত স্মৃতি! কত কিছুর সাক্ষী এই মাঠ! ১৯৫৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামেই ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ‘হোম’ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছিল পাকিস্তান। তার ৪৫ বছর পর এ মাঠেই বাংলাদেশ খেলে অভিষেক টেস্ট, প্রতিপক্ষ ছিল সেই ভারতই। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বক্সিং—কী হয়নি এ মাঠে! দেশের ফুটবল ইতিহাসের বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ফুটবল ম্যাচের সাক্ষী এ মাঠ। ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার কালটা কেটেছে এ মাঠেই। ১৯৭৮ সালে এ মাঠেই ২৪ দেশকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯তম এশীয় যুব ফুটবলের জমজমাট আসর। ১৯৮৫, ১৯৯৩ আর ২০১০ সালের সাফ গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের পর ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর্দা উঠেছিল এ মাঠেই।

প্রবেশমুখে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। সব পাবেন এখানে

এ দেশের জন্মমুহূর্তেরও সাক্ষী হয়ে আছে এ মাঠ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর যে প্রথম দলটি ঢাকায় প্রবেশ করেছিল, তারা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই। স্বাধীনতার প্রত্যুষে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও এখানে ঘটেছিল। এই স্টেডিয়ামেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের পর মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদায়ী প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক এ স্টেডিয়ামেই।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট

যেকোনো বিচারেই ঐতিহাসিক এই মাঠ। অন্য কোনো দেশ হলে এতে পড়ত ‘হেরিটেজ’ তকমা। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে বানিয়েছি বারোয়ারি হাটবাজার। ওহ্‌! স্টেডিয়ামের প্রবেশপথে মাদকসেবীদের কথা না হয় না–ই বললাম। কী নিশ্চিন্তে বসে তাঁরা মাদক সেবন করে যাচ্ছেন বাধাহীন। কেউ দেখার নেই, কারও কিছু বলার নেই। সেখানেই কিছু মানুষ আবার বানিয়ে রেখেছে উন্মুক্ত শৌচাগার। জরুরি প্রয়োজনে সাধারণের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্থান দেশের এক নম্বর ক্রীড়া স্থাপনার প্রাঙ্গণ—এ লজ্জা রাখার জায়গা আমাদের কোথায়!

২০২১ সাল থেকে চলছে সংস্কারকাজ

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে খেলাধুলা নির্বাসিত অনেক দিন। দেশের ফুটবল আর অ্যাথলেটিকসের ভেন্যু এই স্টেডিয়াম। সংস্কারকাজ চলছে তো চলছেই। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের যবনিকাপাতের আশু কোনো সম্ভাবনা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই দেখছেন না। দেশের অন্যতম শীর্ষ খেলা ফুটবল প্রিমিয়ার লিগ আয়োজনের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ, সিলেট। এই যে আফগানিস্তান এল দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে, সেটি আয়োজন করতে হলো শহর থেকে দূরে, বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থিত বসুন্ধরা কিংস ক্লাবের মাঠে।

এ তো স্টেডিয়াম নয়, যেন বারোয়ারি বাজার

কিছুদিন আগে এএফসি কাপে আবাহনী আর মালদ্বীপের ক্লাব ইগলসের ম্যাচ আয়োজন করতে হয়েছে সিলেটের জেলা স্টেডিয়ামে। যে স্টেডিয়ামের মাঠ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দুই দলেরই খেলোয়াড়–কর্মকর্তারা। এখন শোনা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কারের প্রাথমিক ব্যয় যেটি ছিল (ডিপিপি) ৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অনেক কিছুরই সংস্কার হচ্ছে, মাঠ, ফ্লাডলাইট, গ্যালারির; স্টেডিয়ামের গ্যালারির ওপর বসানো হচ্ছে আচ্ছাদন। কিন্তু সব কাজই ভেতরের। বাইরের যে পূতিগন্ধযুক্ত পরিবেশ, এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। স্টেডিয়ামের বাইরের দিকের যে দোকানগুলোর কথা বলছিলাম, সেই দোকানগুলোর ব্যবসায়িক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রবেশপথগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

ঐতিহাসিক এই মাঠে আবার খেলা ফিরবে কবে

প্রবেশপথগুলো না হয় উদ্ধার করা সম্ভব দোকানিদের বলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে খেলাটাই যে হারিয়ে যেতে বসেছে, সেটির কী হবে! ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টেডিয়াম, এই ক্রীড়াস্থাপনা আর কতকাল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইবে? আর কত দিন এই স্থাপনা মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য হয়ে থাকবে আর কত দিন এটি হয়ে থাকবে অব্যস্থাপনার প্রতীক হয়ে। এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? এই উত্তরগুলো জানতে যে খুব ইচ্ছা হয়!