বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিক গেমসে খেলার সুখস্মৃতি তাঁকে আন্দোলিত করে আজও। প্রায় ৩২ বছরের পুরোনো স্মৃতিতেও যেন এতটুকু ধুলো পড়েনি। ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক গেমস কাজী শাহানা পারভীনের কাছে যেন এই সেদিনের ঘটনা।
ফিরে আসার পর যে অভিজ্ঞতা, সেটিও পরিষ্কার মনে আছে তাঁর, ‘অলিম্পিক গেমস কী, তখন বাংলাদেশের মানুষ খুব কমই জানত, বা জানতই না। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে অলিম্পিকে খেলে আমি দেশে আসার পর অনেকে বলল, “তুমি গোল্ড পেলে না কেন?” শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমরা যে তখন অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছি, এটাই তো যথেষ্ট। আচ্ছা, বলুন তো অলিম্পিকে সোনা জেতা কি হাতের মোয়া!’
কাজী শাহানা পারভীন আজও ভাবেন, লোকে ওই প্রশ্নটা তাঁকে কীভাবে করেছিল। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের অর্জন তো শুধু অভিজ্ঞতাই। পদক জয় তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত অলিম্পিক গেমসে নিজের যোগ্যতায় সরাসরি খেলার সুযোগই পেয়েছেন বাংলাদেশের শুধু দুজন খেলোয়াড়। ২০১৬ রিও গেমসে গলফার সিদ্দিকুর রহমান ও ২০২০ টোকিও গেমসে আর্চার রোমান সানা। এর মধ্যে একমাত্র রোমান সানাই সরাসরি কোয়ালিফাইং পেরিয়ে। সিদ্দিকুর রিওতে গিয়েছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের সুবাদে। বাংলাদেশের বাকি সবার অংশ নেওয়াই তো বিশেষ বিবেচনার ওয়াইল্ড কার্ডে।
আজ শুক্রবার, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের অনেক সাফল্য থাকলেও দিবসটি ক্রীড়াঙ্গনে সেভাবে উদ্যাপিত হয় না। খোদ বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থাই নিশ্চুপ থাকে এই দিনে। উদ্যাপন বা স্বীকৃতি না থাকলেও মেয়েরা ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে চলেছেন। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের আলোকবর্তিকা নারীদের হাতেই। নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হওয়ার গৌরবে ভেসেছে দেশ। ফুটবলে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে শিরোপা আসছে প্রায় নিয়মিতই।
এশিয়ান গেমসে নারী ক্রিকেটে এসেছে সোনা, এশিয়া কাপ ক্রিকেটে শিরোপা। দলীয় খেলার বাইরে আছে ব্যক্তিগত সাফল্যও। রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মিশ্র দ্বৈতে রুপা জিতেছেন আর্চার দিয়া সিদ্দিকী। আর্চারিতে নাসরিন আক্তারসহ কয়েকজন পদক এনেছেন। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) সাঁতারে জোড়া সোনা জিতেছেন মাহফুজা খাতুন। টানা দুটি এসএ গেমসে সোনা জয়ের কৃতিত্ব আছে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারের। কারাতেকা হুমায়রা আক্তার, ফেন্সিংয়ে ফাতেমা মুজিবেরা অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসএ গেমসে সোনা জিতেছেন।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সামগ্রিকভাবে নারীদের অবস্থান এখন কেমন? কীভাবে দেখেন সবকিছু? নারী দিবস সামনে রেখে এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রথম নারী অলিম্পিয়ান বলেন, ‘ক্রিকেট-ফুটবলের মেয়েরা ভালোই করছে, সাফল্যও পাচ্ছে। ওরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়মিতই খেলে। কিন্তু এখন সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও অন্য খেলায় তেমন কিছু তো দেখছি না। এসব জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অন্যতম সফল খেলা শুটিং। সেই সাফল্যে বড় অবদান রেখেছেন কাজী শাহানা, সাবরিনা সুলতানা, শারমিন আক্তার রত্নারা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক শুটিংয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের পদক জয়ের খবর পাওয়া যায় না। সাবেক শুটারদের অনেকেই এখন শুটিং–বিমুখ। এমনকি প্রথম নারী অলিম্পিয়ানেরও তাঁর নিজ খেলার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
অভিমানেই কি শুটিং থেকে দূরে সরে থাকা? ‘অভিমান তো কিছুটা আছেই। কেউ আমার খোঁজখবর নেয় না, আমিও যাই না। আমি যে একজন শুটার ছিলাম, বা বাংলাদেশের প্রথম নারী অলিম্পিয়ান ছিলাম, সেটা আসলে মানুষ ভুলেই গেছে। ১৯৯৯ সালে খেলা ছাড়ার পর কিছুদিন আমি কোচ বা কর্মকর্তা হিসেবে ছিলাম শুটিংয়ে। কিন্তু ১০-১২ বছর ধরে শুটিং ফেডারেশনে আর যাই না।’ কিছুটা ক্ষোভ ঝরে এসএ গেমসে তিনটি সোনাজয়ী শুটারের কণ্ঠে। এখন এসএ গেমস নাম নেওয়া একসময়কার সাফ গেমসেও বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে প্রথম সোনা জয়ের কৃতিত্ব কাজী শাহানার (১৯৯১ সালে কলম্বোয়)।
শুটিং সংগঠক স্বামী গিয়াসউদ্দিন প্রয়াত হয়েছেন ২০১৫ সালে। কানাডাপ্রবাসী একমাত্র মেয়ে এখন বেড়াতে এসেছেন ঢাকায়। কাজী শাহানার জন্ম নারায়ণগঞ্জে, তবে থাকেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে গত পরশু ফিরেছেন ঢাকায়। ছোট বোন সাবেক জাতীয় শুটার কাজী ফেরদৌসী পারভীন তাঁর সঙ্গে থাকেন। ক্রীড়াঙ্গনের কোনো অনুষ্ঠানে কাজী শাহানা আর আসেন না। নিজের বর্তমান দিনকাল সম্পর্কে বলেন, ‘এখন আসলে নিজের মতো থাকি। ধর্মকর্ম করি। এই চলে যাচ্ছে জীবন।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ৬২ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রথম নারী অলিম্পিয়ানের একটাই চাওয়া, জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণ যেন বাড়ে। অলিম্পিক গেমসে যেন পুরুষের সমানসংখ্যক নারীও থাকেন, ‘আমি যখন গিয়েছিলাম, কেউ ভাবতেই পারেনি বাংলাদেশের কোনো মেয়ে অলিম্পিকে খেলবে। কিন্তু আমার পরে অলিম্পিকে যাওয়া নারী অ্যাথলেটের সংখ্যা বাড়েনি। এটা বাড়া উচিত।’
১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে গিয়েছিলেন অ্যাথলেট নীলুফার ইয়াসমিন। ২০০০ সালে সিডনিতে গিয়েছিলেন তিনজন মেয়ে—অ্যাথলেট ফৌজিয়া হুদা, শুটার সাবরিনা সুলতানা ও সাঁতারু ডলি আক্তার। ডলি আক্তার পরের দুটি অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি, তিনবার অলিম্পিকে গেছেন ডলি। ২০০৮ বেইজিংয়ে তাঁর সঙ্গে আরেকজন মেয়ে ছিলেন অ্যাথলেট নাজমুন নাহার বিউটি।
আমি যে একজন শুটার ছিলাম, বা বাংলাদেশের প্রথম নারী অলিম্পিয়ান ছিলাম, সেটা আসলে মানুষ ভুলেই গেছে।কাজী শাহানা পারভীন
২০১২ লন্ডনে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন শুটার শারমিন আক্তার রত্না। ২০১৬ রিওতে দ্বিতীয়বারের মতো তিনজন মেয়ে ছিলেন বাংলাদেশের অলিম্পিক দলে—আর্চার শ্যামলী রায়, অ্যাথলেট শিরিন আক্তার ও সাঁতারু সোনিয়া আক্তার। ২০২১ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত ২০২০ অলিম্পিকে ছিলেন আর্চার দিয়া সিদ্দিকী ও সাঁতারু জুনাইনা আহমেদ।
আরেকটি অলিম্পিক গেমস বলতে গেলে কড়া নাড়ছে দুয়ারে। আগামী জুলাই-আগস্টে প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে ওয়াইল্ড কার্ডের জন্য ছয়জন খেলোয়াড়ের নাম পাঠানো হয়েছে। তাতে নারী মাত্র একজন—শুটার শায়রা আরেফিন। শায়রা ওয়াইল্ড কার্ড না পেলে প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলে কোনো নারী থাকবেন না। তাহলে বড় কষ্ট পাবেন বাংলাদেশের প্রথম নারী অলিম্পিয়ান কাজী শাহানা পারভীন।