প্রায় ১০ বছর তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে পরিবার। আদতে তিনি কেমন আছেন, সেটিই নিশ্চিত নন ঘনিষ্ঠজনের বাইরে কেউ। সেই মাইকেল শুমাখারেরই একটি ‘সাক্ষাৎকার’ কিনা প্রকাশ করে ফেলা হলো!
এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে জার্মানির সাপ্তাহিক সাময়িকী ‘ডি আকতুয়েলা’। স্বাভাবিকভাবেই রক্তমাংসের শুমাখার এই সাক্ষাৎকার দেননি। শুমাখারের নামে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। ফর্মুলা ওয়ানের রেকর্ড সাতবারের চ্যাম্পিয়ন শুমাখারের এমন সাক্ষাৎকার প্রকাশের কারণে সাময়িকীটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে তাঁর পরিবার। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এ বিষয়ে মন্তব্য পেতে বুধবার শুমাখারের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। বিবিসি জানিয়েছে, শুমাখারের পরিবার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারটি রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে।
২০১৩ সালে ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালায় স্কি করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হন শুমাখার। মস্তিস্কে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে কোমায় চলে যান তিনি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে শুমাখারের শারীরিক অবস্থা নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রেখেছে তাঁর পরিবার। ফেরারি কিংবদন্তিকে তাই জনসম্মুখে দেখা যায় না।
রয়টার্স জানিয়েছে, শুমাখারের কাছে তাঁর খুব কাছের মানুষদের যাতায়াতও সীমিত। জার্মান কিংবদন্তির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যতটা সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রেখেছে তাঁর পরিবার। এর মধ্যে ‘ডি আকতুয়েলা’র সর্বশেষ সংস্করণে শুমাখারের সাক্ষাৎকার দেখে সবার চমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যে লোকটিকে জনসম্মুখে দেখা যায় না, যাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়েও তেমন কিছু জানার সুযোগ নেই, হুট করে সেই মানুষের সাক্ষাৎকার যদি প্রকাশ হয়, তাহলে ভ্রুকুটি জাগাই স্বাভাবিক।
সাময়িকীটির প্রচ্ছদে শুমাখারের হাসিমুখের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘মাইকেল শুমাখার, প্রথম সাক্ষাৎকার।’ আর প্রচ্ছদের সাব–হেডিংয়ে লেখা, ‘সত্যি বলে ধোঁকা খেতে পারেন।’ আদতে সাক্ষাৎকারের ভেতরে প্রশ্নোত্তর অংশে শুমাখারের হয়ে উত্তরগুলো দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। মেইল অনলাইন জানিয়েছে, সাক্ষাৎকারটিতে সাময়িকীটির পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে, ‘একবার তার সঙ্গে কথা বলুন। জিজ্ঞেস করুন, সে কেমন আছে। আর শেষ পর্যন্ত আপনি সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ১০ বছর পরের উত্তরগুলো পাবেন।’
‘আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে’—সাক্ষাৎকারে শুমাখারের এই মন্তব৵ প্রকাশ করা হয় যা আদতে তিনি বলেননি। তাঁর হয়ে বলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। শুমাখারের রূপে আরও বলা হয়েছে, ‘আমার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের জন্য সেটা খুব ভয়ংকর সময়। আমি এতটাই আঘাত পেয়েছিলাম যে মাসের পর মাস কৃত্রিম কোমায় থাকতে হয়েছিল। অন্যথায় শরীর (আঘাতের সঙ্গে) লড়াই করতে পারত না। খুব কঠিন সময় গেলেও হাসপাতালের কর্মীরা আমাকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ জানিয়েছে, সাক্ষাৎকারের শেষে এসে বোঝা গেছে মন্তব্যগুলো আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির।
যুক্তরাজ্যের আরেকটি সংবাদমাধ্যম মেট্রো জানিয়েছে, এই সাক্ষাৎকারে শুমাখারের উত্তরগুলোর মূল উৎস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ওয়েবসাইট ‘ক্যারাক্টারডটএআই’। এখানে প্রোগ্রাম এমনভাবে বানানো, যাতে সেটি বাস্তবের মানুষের মতোই উত্তর দেবে। সেটি হতে পারেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস কিংবা ফরাসি বীর নেপোলিয়ন অথবা কল্পনার কোনো চরিত্রও!
স্বাভাবিকভাবেই শুমাখারের এমন ভার্চ্যুয়াল সাক্ষাৎকারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ফর্মুলা ওয়ান সমর্থকদের মাঝেও। সাময়িকীটির ‘শালীনতার অভাব’ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। জার্মানির মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বরিস রোজেনক্রাঞ্জ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, কাজটা ‘এতটাই বোকার মতো যে বিশ্বাস করা কঠিন।’
অবশ্য জার্মানির এই সাময়িকীর সঙ্গে শুমাখার পরিবারের বিরোধটি। ২০১৫ সালে শুমাখারের স্ত্রী কোরিনা শুমাখারকে প্রচ্ছদ বানিয়েছিল ‘ডি আকতুয়েলা’। শিরোনাম ছিল, ‘কোরিনা শুমাখার—নতুন ভালোবাসায় তিনি সুখী।’ এই শিরোনাম নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ায় আদালতে মামলা ঠুকে ৫০ হাজার ইউরো দাবি করেছিলেন কোরিনা। কারণ লেখার বিষয়বস্তু ছিল কন্যা জিনা মারিয়ার প্রতি কোরিনার ভালোবাসা। শুমাখারদের পারিবারিক আইনজীবী এ বিষয়ে মামলা করলেও আদালত তা খারিজ করে দেন।
অবশ্য ২০২১ সালে নেটফ্লিক্সের এক তথ্যচিত্রে কোরিনা শুমাখারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা একসঙ্গে থাকি। তাকে থেরাপি দিই। মাইকেলের ভালোর জন্য যা যা করা সম্ভব, সবই করি। এটা আমাদের পরিবার, এটাই আমাদের বন্ধন। আর সেই সব সময় বলেছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাই। তাই তার গোপনীয়তা রক্ষা করাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একসময় সে আমাদের আগলে রেখেছে। এখন আমরা তাকে আগলে রাখছি।’
শুমাখারের ছেলে মিকও এখন ফর্মুলা ওয়ানে। গত মৌসুমে হাসে থাকলেও এবার আসন হারিয়েছেন, তবে শুমাখারের সাবেক দল মার্সিডিজের রিজার্ভ ড্রাইভার হিসেবে আছেন।