৪২.১৯৫ কিলোমিটারের ম্যারাথন বেশ কিছুক্ষণ আগে। নেদারল্যান্ডসের পতাকা গায়ে জড়িয়ে সিফান হাসানের সোনা জয়ের উল্লাস-উদ্যাপনও শেষ ততক্ষণে। তবে প্রায় আড়াই ঘণ্টার দৌড়ে সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেললেও সিফানের লড়াই তখনো শেষ হয়নি। দ্বিতীয় হওয়া তিগস্ট আসেফাকে শেষ মুহূর্তে ধাক্কা দিয়েছেন, এমন একটি অভিযোগ গেছে কর্তৃপক্ষের কাছে। সিফানের সোনা কেড়ে নিতে অলিম্পিক কমিটির কাছে অভিযোগ করেছে ইথিওপিয়া।
৩১ বছর বয়সী সিফানের মনে তখন কী ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, অনুমান করা কষ্ট নয়। এই ইথিওপিয়াতেই তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠাও। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে জন্মভূমিতে থাকতে পারেননি। ১৫ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে পাড়ি দেন নেদারল্যান্ডসে। সেই নেদারল্যান্ডসের হয়েই অলিম্পিক ম্যারাথনে এই প্রথম। প্রথমবারেই সোনা। আর তা কি না আটকে যাচ্ছে ওই ইথিওপিয়ার কারণেই!
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইথিওপিয়ার অভিযোগ আমলে নেয়নি প্যারিস কর্তৃপক্ষ। বিলম্বে হলেও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সোনার পদক পরিয়ে দেওয়া হয়েছে সিফানের গলাতেই। প্রথমবার অলিম্পিক ম্যারাথনে অংশ নেওয়া সিফান দৌড় শেষ করেছেন অলিম্পিকের নতুন রেকর্ড ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ইথিওপিয়ার আসেফার শেষ রেখা স্পর্শ তিন সেকেন্ড দেরিতে (ব্রোঞ্জ কেনিয়ার হেলেন ওবিরির)। প্যারিসে ম্যারাথনের আগে ৫ হাজার আর ১০ হাজার মিটারেও দৌড়েছেন সিফান। দুটিতেই জিতেছেন ব্রোঞ্জ। আর সব কটি ইভেন্টই খেলেছেন গত ১০ দিনের মধ্যে।
অর্থাৎ হিট এবং চূড়ান্ত পর্ব মিলিয়ে মাত্র ১০ দিনে ৬২ কিলোমিটারের বেশি দৌড়েছেন সিফান। গত সাত দশকের মধ্যে অলিম্পিকের একই আসরে ৫ ও ১০ হাজার এবং ম্যারাথনে পদক জয়ের কৃতিত্ব এটিই প্রথম। সোয়া শ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে এমন কীর্তি আছে আর একটিই—১৯৫২ হেলসিংকিতে চেক কিংবদন্তি এমিল জাতোপেকের।
এমন ইতিহাস গড়া সোনা জয়ের পর সিফানের প্রতিক্রিয়াই বলে দিচ্ছিল তাঁর অর্জনের মাহাত্ম্য, ‘দুটি ঘণ্টা কী ছিল কল্পনা করতে পারবেন? প্রতিটি পদক্ষেপে মনোযোগ দেওয়া। আমার জীবনে এতটা মনোযোগী আর কোনো দৌড়ে ছিলাম না। আমি এখন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। আর কী বলার আছে? আমি আগেও অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। কিন্তু এটা বিশেষ কিছু।’
প্যারিসের আগে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন সিফান। এর মধ্যে ৫ হাজার ও ১০ হাজার মিটারে জিতেছিলেন সোনা, ১৫০০ মিটারে ব্রোঞ্জ। এবার ১৫০০ মিটারে দৌড়াননি। কিন্তু বাকি দুটিতে অংশ নিয়ে সোনা খুইয়ে ব্রোঞ্জে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সিফানের মূল লক্ষ্য ছিল অবশ্য ম্যারাথন। গত বছর লন্ডন ম্যারাথনে প্রথম দৌড়েছেন। আজ প্যারিসে আরেকবার দৌড়াতে নেমে প্রথম কিছুটা শঙ্কাতেই পড়েছিলেন, ‘দৌড়াতে দৌড়াতে আক্ষেপ করছিলাম কেন যে ৫ আর ১০ হাজারে অংশ নিয়েছি। নিজেকে নিজে বলছিলাম ওইগুলো খেলা উচিত হয়নি। নয়তো আজ খুব ভালো দৌড়াতে পারতাম।’
তবে দৌড়ের একেবারে শেষ ৩০০ মিটারে রীতিমতো স্প্রিন্টার হয়ে ওঠায় সেই আক্ষেপ কেটে গেছে সিফানের। শেষের ওই দৌড়ের মধ্যেই ধাক্কা লেগেছিল আসিফার সঙ্গে। যেটার জেরে পদক অনুষ্ঠান শুরু হয় বিলম্বে। ইথিওপিয়া নিয়ে সিফানের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নতুন নয়। রাজধানী আদ্দিস আবাবার দক্ষিণ-পূর্বের অঞ্চল ওরোমিয়ায় জন্ম তাঁর। থাকতেন মা ও দাদির সঙ্গে। ওরোমিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইথিওপিয়া থেকে স্বায়ত্তশাসন চেয়ে আন্দোলন চলছিল। ওই অবস্থার মধ্যেই ২০০৮ সালে নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমান সিফান।
নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশ ছেড়েছেন কি না, সেটা অবশ্য কখনোই প্রকাশ্যে আনেননি তিনি। তবে নর্দান নেদারল্যান্ডসে আসার পর শুরুটা সময়টা যে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল, সেটি উঠে এসেছে ডাচ সংবাদমাধ্যম ডি ভলকস্ক্রান্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। জুইদলারেনের একটি আশ্রমে থাকতে প্রতিদিনই নাকি কাঁদতেন, ‘আমি ছিলাম সেই ফুলের মতো, যার ওপর কখনো সূর্যের আলো পড়েনি।’
একটা পর্যায়ে নেদারল্যান্ডসে থাকা অন্য ইথিওপিয়ানদের সঙ্গে মিশে স্থানীয় অ্যাথলেটিকস ক্লাবে যাতায়াত শুরু করেন সিফান। আইন্দহফেন অ্যাথলেটিক কোচিং টিমের প্রেসিডেন্ট অ্যাড পিটার্স অবশ্য শুরুর দিকেই ‘হীরা’ চিনে ফেলেছিলেন, ‘প্রথম দিকেই বোঝা গেছে, সে খুব প্রতিভাবান। এতটাই যে একটা অন্ধ ঘোড়াও বুঝতে পারবে সিফান ভালো দৌড়বিদ।’
সিফানের মধ্যে বিশেষ কিছু আছে বোঝার পরই তাঁকে পেশাদার জগতের জন্য প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেয় নেদারল্যান্ডস। আর সেটিরই সুফল আসতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। সে বছরই বেলগ্রেডে ইউরোপিয়ান ক্রস কান্ট্রি চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-২৩ দৌড়ে সোনা জেতেন সিফান। পরের বছর সোনা জেতেন মারাকেশে অনুষ্ঠিত কন্টিনেন্টাল কাপের ১৫০০ মিটারে। একই বছরে একই ইভেন্টে আসে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সোনাও। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে অবশ্য তেমন কিছু করতে পারেননি। ১৫০০ মিটারে হন পঞ্চম, ৮০০ মিটারে ২১তম।
তবে ২০১৯ দোহা চ্যাম্পিয়নশিপে ১৫০০ ও ১০ হাজার মিটারে সোনা জয়ের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ান দারুণভাবে। এরপর টোকিও অলিম্পিকে আসে দুই সোনা ও ১ ব্রোঞ্জ। সেটি ছিল এক আসরে এই তিন ইভেন্টেই পদক জয়ের প্রথম ঘটনা। এবার প্যারিসে এসেছিলেন ম্যারাথনে প্রথমের লক্ষ্য নিয়ে। আর সেটি আসার পর সিফানের উচ্ছ্বাস যে বাঁধভাঙা হবে, সে তো সহজেই অনুমেয়, ‘(গত বছর) লন্ডন ম্যারাথন জিতে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আজ আরও বেশি খুশি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমি অলিম্পিক ম্যারাথন চ্যাম্পিয়ন!’