সরকার পরিবর্তনের পর দেশের প্রায় সব ক্রীড়া ফেডারেশনেই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশ প্যারালিম্পিক কমিটি ২৮ আগস্ট প্যারিসে শুরু হতে যাওয়া প্যারালিম্পিক গেমসে দল পাঠাচ্ছে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ১৬ সদস্যের এই দলে ক্রীড়াবিদের সংখ্যা মাত্র ২ জন! গত ১৮ জুলাই এই সফরের জন্য সরকারি আদেশ (জিও) হয়েছে।
জিওর তালিকা অনুযায়ী, দুই ক্রীড়াবিদ আল-আমিন হোসেন ও ঝুমা আক্তার খেলবেন আর্চারি ইভেন্টে। কোচ হিসেবে যাচ্ছেন নিশীথ দাস ও চিকিৎসক মনিরুল ইসলাম। বাকি ১২ জনই যাচ্ছেন কর্মকর্তা পরিচয়ে। তাঁদের মধ্যে আছেন কমিটির মহাসচিব মাকসুদুর রহমান, দলনেতা হিসেবে যাচ্ছেন উপমহাসচিব ফখরুদ্দিন হায়দার। সঙ্গে যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রীও। অবশ্য জিওতে উল্লেখ আছে তাঁর স্ত্রী যাচ্ছেন নিজ খরচে।
প্যারালিম্পিক কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শেখ আবদুস সালামও যাচ্ছেন সস্ত্রীক। জিওতে তাঁর স্ত্রীও নিজ খরচে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ আছে। এ ছাড়া জিও করা হয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সানাউল হক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, প্যারা আর্চারির সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহসান উল্লাহর নামে। সফরে দুই ক্রীড়াবিদ, কোচ, চিকিৎসক ও দলনেতার ব্যয়ভার আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি বহন করলেও বাকিরা যাচ্ছেন বাংলাদেশ প্যারালিম্পিক কমিটির খরচে।
প্যারালিম্পিকের মহাসচিব মাকসুদুর রহমান অবশ্য দাবি করেছেন, সফরে যাঁরা যাচ্ছেন, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সফরে প্রয়োজনীয় লোকজনই যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি আমন্ত্রিত হিসেবে। এসব আসরে এমনিতেই মন্ত্রী ও সচিবেরা যান। সেখানে গিয়ে আমরা দেশের খেলাধুলার স্বার্থেই কাজ করি।’
তবে প্যারালিম্পিকের নির্বাহী কমিটির সদস্য পাপ্পু মোদকের দাবি, প্যারিস সফরের ব্যাপারে নির্বাহী কমিটির অনেক সদস্যই কিছু জানেন না, ‘মহাসচিব অনেক সিদ্ধান্তই নেন নির্বাহী কমিটিকে পাশ কাটিয়ে। কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে মে মাসে। প্যারিস সফর নিয়ে আমাদের সঙ্গে সেখানে কোনো আলোচনা করা হয়নি।’ একই অভিযোগ নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য আসিফ ইকবাল চৌধুরীর, ‘কমিটির একজন সদস্য হয়েও আমি প্যারিস সফরের বাজেট, কতজন যাচ্ছেন—এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। মহাসচিব অনেক সিদ্ধান্তই নিজের খেয়ালখুশি মতো নেন।’
মাকসুদুরের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও আছে শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের। গত রোববার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে এ নিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ করেছেন। প্যারা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় রবিউল ইসলামের অভিযোগ, ‘আমি জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েও এখনো বিদেশে কোনো বড় টুর্নামেন্ট খেলতে পারিনি। গত জুনে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য একজনকে বিদেশে খেলতে নিয়ে যান মহাসচিব।’ সুইমার নাফিউর রহমানের দাবি, ‘গত প্যারা এশিয়ান গেমসে আমার কোনো কোচ ছিলেন না। মাকসুদুর রহমান তাঁর স্ত্রীকে কোচ বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
তবে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ঠিক নয় দাবি করে মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘আমার স্ত্রী সাবেক ক্রীড়াবিদ। তাঁকে হাংজু নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্যারালিম্পিক কমিটির সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। সে সময় প্যারা টেবিল টেনিসের একজন কোচের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় আমার স্ত্রীকে প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের দেখভালের জন্যই নিয়ে যাওয়া হয়।’
২০২২ সালে চার জাতি শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারালিম্পিক কমিটিকে ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার মনির হোসেনের প্রশ্ন, সেই টাকা দিয়ে প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হলো না কেন? তবে তিনি জানিয়েছেন, আর্থিক পুরস্কার হিসেবে খেলোয়াড়েরা সে সময় পাঁচ লাখ টাকা করে পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে প্যারালিম্পিক কমিটির প্রতিষ্ঠাতা, সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)-এর বাংলাদেশ প্রধান ভ্যালেরি এ টেলর বাংলাদেশ প্যারালিম্পিক কমিটিরও সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০২৩ সালে মাকসুদুর রহমানের বিভিন্ন স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণেই তিনি পদত্যাগ করেন বলে অভিযোগ আছে।
মাকসুদুর রহমান অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অনেকেই নানা অভিযোগ করছেন। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। অভিযোগ করলে উচিত তথ্য-প্রমাণ হাজির করা। যে ১০ কোটি টাকার কথা বলা হচ্ছে, সেই টাকার হিসাব নিয়ে কোনো লুকোচুরি নেই। যে কেউ সেই হিসাব দেখতে পারেন।’