বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। সামাজিক বাধা পেরিয়েও কীভাবে খেলার মাঠে আলোড়ন তুলতে হয়, সেটা রওশন আক্তার ছবি দেখিয়েছিলেন অর্ধশতাব্দী আগে। ষাটের দশকে অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাকের রানি ছিলেন। হয়েছেন দ্রুততম মানবী। হার্ডলসে সে সময় পাকিস্তানের জাতীয় রেকর্ডটা ছিল তাঁর। পাকিস্তানে ক্রীড়াবৈষম্যের প্রতি সেটি ছিল রওশন আক্তারের একটা জবাব।
গতকাল সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে ২০২২ সালের আজীবন সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় রওশন আক্তারের হাতে। মঞ্চে পুরস্কার হাতে নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘পুরস্কার পেতে কার না ভালো লাগে! প্রথম আলোর কাছ থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়ে আমারও ভালো লাগছে। তবে এই পুরস্কারটা আরও আগে পেলে আরও ভালো লাগত।’ কিছুটা আবেগাপ্লুতও হলেন তিনি। পুরস্কার নিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সমসাময়িক ক্রীড়াবিদদের কথা, ‘এই ধরনের পুরস্কার একটু জ্যেষ্ঠতা বিচার করে দিলে খুব ভালো হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই এমন কিছু না পেয়েই চলে গেছেন।’
রওশন আক্তার ২০০১ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের আজীবন সম্মাননাও তাঁকে অন্য রকম গর্বের অনুভূতি দিচ্ছে, ‘পুরস্কারটা যখন হাতে নিলাম, তখন সবাই করতালি দিয়ে সম্মান জানাল, ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছে আমার খেলোয়াড়ি জীবন সার্থক।’
১৯৬৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় গেমস তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের স্মরণীয় এক অধ্যায়। ৮০ মিটার হার্ডলসে রওশন আক্তার ছবি গড়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় রেকর্ড, ‘আমার সঙ্গে আরও তিন নারী অ্যাথলেট সেবার সোনার পদক জিতেছিলেন। সুলতানা আহমেদ, ইশরাত আরা ও সুফিয়া খাতুন। সেবারই প্রথম আমরা চার বাঙালি নারী সোনার পদক জিতেছিলাম। অনন্য সেই অর্জন। খুব মনে পড়ে। আমার খেলোয়াড়ি জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়।’
রওশন আক্তার যে সময় খেলাধুলায় এসেছিলেন, তখনকার সামাজিক অবস্থায় সেটি সহজ ছিল না। তবে পরিবার থেকে তাঁর খেলাধুলায় কোনো বাধা ছিল না, ‘আমার বাড়িতে কেউ খেলায় বাধা দেয়নি। তবে নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নিজের জেদ ছিল, তাই সাফল্যের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশ নিতে পেরেছি।’
খুব আনন্দ পান যখন দেখেন এখন অনেক মেয়ে খেলাধুলায় আসছে, সাফল্য পাচ্ছে। মেয়েদের সাফল্য দেখে তাঁর মনে হয়, যে লড়াইটা তাঁরা শুরু করেছিলেন, সেটি ভুল কিছু ছিল না, ‘এই যে ফুটবলে, ক্রিকেটে মেয়েরা ভালো করছে, অন্য খেলায় সাফল্য পাচ্ছে। খুব ভালো লাগে। মেয়েদের জন্য আরও পরিকল্পনা দরকার। সেগুলো হলে মেয়েরা আরও সাফল্য এনে দেবে দেশকে। এখনকার ক্রীড়াবিদদের দেখে মনে হয়, ৫০ বছর আগে আমরা কয়েকজন যে লড়াইটা লড়েছিলাম, সেটিই এখনকার মেয়েরা এগিয়ে নিচ্ছে।’
আজীবন সম্মাননা পাওয়ার দিনে রওশন আক্তারের মনে পড়ছিল তাঁর অকালপ্রয়াত ছেলের কথা। ২০২২ সালে হারিয়েছেন আদরের সন্তানকে, ‘আজ ছেলেটাকে খুব মনে পড়ছে। ও থাকলে খুব খুশি হতো।’